জুবায়ের চৌধুরী

  ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

প্রশ্ন ফাঁসের হোতারা আড়ালেই

একজনেরও সাজা হয়নি ৩৮ বছরে

সারা দেশে গ্রেফতার ১৬০

পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগে পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের মূল উৎস এখনো পুরোপুরিভাবে চিহ্নিত হয়নি। তবে ফাঁসের অভিযোগে গ্রেফতার হচ্ছেন মূলত বহনকারী ও সুবিধাভোগীরা। কিন্তু উৎস চিহ্নিত না হওয়ায় ফাঁস রোধে এর মূলে পৌঁছানো সম্ভব হচ্ছে না বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। ফলে ফাঁস রোধে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপেরও সুফল মিলছে না। মূল হোতারাও থেকে যাচ্ছেন আড়ালেই। এদিকে প্রশ্ন ফাঁসের আলোচিত কোনো ঘটনায় মূল হোতারা ধরা পড়ার নজির নেই।

কীভাবে প্রশ্ন ফাঁস হচ্ছে, টিআইবির এমন তদন্ত বলছে, কিছু কোচিং সেন্টার ফাঁসের কেন্দ্র বিন্দু। যোগাযোগ করলে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘কোচিং সেন্টারগুলোকে কেন্দ্র করে একটি সিন্ডিকেট গড়ে ওঠেছে। ওই সিন্ডিকেট প্রশ্ন ফাঁস করছে।’

বিভিন্ন সময় মামলা দায়ের ও গ্রেফতার হলেও আসল চক্র থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ফাঁসের বিষয়ে সরকারি অনুসন্ধানের কোনো প্রতিবেদন শেষ পর্যন্ত প্রকাশ করে মানুষকে ফাঁসের উৎস ও হোতাদের সম্পর্কে জানানো হয়নি। এমনকি আলোচিত ঘটনার পরও অতীতে সরকার কোনো তদন্ত কমিটি গঠন না করার নজিরও আছে। এছাড়া প্রশ্ন ফাঁসের মূল উৎস সম্পর্কে সরকারি সংস্থা ও মন্ত্রণালয়ের তদন্তেও কিছু ভিন্নতা থাকছে।

প্রশ্ন ফাঁস রোধে ১৯৮০ সালে আইন প্রণীত হয়। পরে ১৯৯২ সালে সংশোধিতও হয়। প্রশ্ন ফাঁসের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির কমপক্ষে তিন থেকে দশ বছরের কারাদন্ডসহ অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, আইন প্রণয়নের এই ৩৮ বছরে প্রশ্ন ফাঁসের অপরাধে ওই আইনে কারো শাস্তি হয়নি। অথচ ১৯৭৯ সাল থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেটসহ (এসএসসি) পাবলিক ও বিভিন্ন পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে আসছে। ২০১২ সালের পর থেকে অন্তত ৮২টি বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ আছে। ২০১৫ সালে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, চার বছরে বিভিন্ন পরীক্ষায় ৬৩টি বিষয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে।

প্রশ্ন ফাঁসের উৎস নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও আছে ধোঁয়াশায়। একের পর এক উদ্যোগ নিয়েও ফাঁস ঠেকাতে পারছে না মন্ত্রণালয়। শিক্ষা সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ) সোহরাব হোসাইন এ বিষয়ে ‘অসহায়ত্ব’ও প্রকাশ করেন। তিনি মনে করেন, ‘বর্তমান পদ্ধতির পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ করা সম্ভব নয়।’

বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘ফাঁস রোধে ও ফাঁসকারীদের আইনের আওতায় আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও জোরালো ভূমিকা দরকার। আমাদের দেশের গোয়েন্দারা অনেক দক্ষ। বিভিন্ন বিষয়ে তাদের দক্ষতা প্রমাণিত। প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরার বিষয়ে তাদের ওই রকম দক্ষতা আমরা দেখছি না।’ অবশ্য সোহরাব হোসাইন এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘গোয়েন্দারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ফাঁস চক্রের হোতাদের ধরতে।’

এবারের এসএসসি পরীক্ষায় টানা প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ১২টি বিষয়ের মধ্যে ১১টিরই প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে। পরীক্ষার দিন সকালে ও পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা দেড়েক আগে অনলাইনকেন্দ্রিক ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের অন্য মাধ্যমে প্রায় একই কায়দায় প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ে। এবারের মতো ধারাবাহিকভাবে ফাঁসের ঘটনা আগে ঘটেনি বলে জানান শিক্ষাবিদরা।

তথ্য মতে, প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে চলতি মাসে সারা দেশে গ্রেফতার হন কমপক্ষে ১৬০ জন। গতকাল সোমবারও ঢাকায় পাঁচজনসহ সারা দেশে আটজন গ্রেফতার হয়েছেন। এর আগে গত বছর গ্রেফতার হয়েছিলেন ৭১ জন। তবে এসব এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত প্রশ্ন ফাঁস চক্রের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পারেÑ গ্রেফতারকৃতরা কেউ ফাঁস চক্রের সদস্য নন। এ মাসে গ্রেফতার হওয়াদের মধ্যে বেশিরভাগ ছাত্র, অভিভাবক ও শিক্ষক। ছাত্ররা ফাঁসের সুবিধাভোগী, অভিভাবকরা সন্তানকে ভালো ফলের জন্য ও শিক্ষকরা কিছু বাড়তি টাকা কামানোর জন্য এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কিছু সাধারণ শিক্ষার্থী টাকা উপার্জন ও কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার যুবকরা ফাঁসের সঙ্গে জড়াচ্ছেন বলেও সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকাংশ কর্মকর্তা মনে করেন, প্রশ্ন ফাঁসের জন্য দায়ী কিছু অসাধু শিক্ষক। এক সময় বিজি প্রেস থেকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ থাকলেও গত ৮ থেকে ৯ বছরের মধ্যে মন্ত্রণালয়ের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কারণে সেখান থেকে আর ফাঁস সম্ভব হচ্ছে না। চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্ন কেন্দ্রে নেওয়ার সময় ও বিতরণের আগের মুহূর্তে ফাঁস হচ্ছে। পরীক্ষার কমপক্ষে দুই মাস আগে প্রশ্ন ছাপানো হয়। প্রশ্নের প্যাকেট সিলগালা করা থাকে। পরীক্ষা শুরুর ঘণ্টা দুয়েক আগে কেন্দ্রে পৌঁছায় প্রশ্ন।

তবে শিক্ষকরা প্রশ্ন ফাঁস করছেন, এ বিষয়ে পুলিশ এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) শীর্ষ পর্যায়ের কয়েক কর্মকতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে ফাঁস হওয়া সম্পর্কে জানান, ‘কিছু শিক্ষককে প্রশ্ন ফাঁসের জন্য চিহ্নিত করা গেছে। তবে মূল উৎস শিক্ষকরা নন। কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের কর্মচারী ও কিছু কর্মকর্তাও জড়িত।’ অন্যদিকে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে প্রশ্ন ফাঁসের উৎস বলা হয়েছে কোচিং সেন্টার ও কয়েকজন শিক্ষককে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist