জুবায়ের চৌধুরী

  ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

প্রশ্নপত্র ফাঁসের রেকর্ড সর্ষের মাঝে ভূত!

* পরীক্ষা বাতিলের বিপক্ষে মূল্যায়ন কমিটি, বৈঠক আজ * এপ্রিলে এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে

প্রযুক্তির অপব্যবহার করে দিনকে দিন আরো বেপরোয়া হয়ে উঠছে প্রশ্নপত্র ফাঁস চক্রের সদস্যরা। তাদের এই নজিরবিহীন দৌরাত্ম্যে দিশেহারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পরও সফলতা মিলছে না। বরং চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনায় পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত বছর থেকে প্রাথমিকসহ বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষা, ব্যাংক নিয়োগ পরীক্ষাসহ এমন কোনো পরীক্ষা নেই যার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। প্রশ্ন ফাঁস এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁসে এক শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীই দায়ী। যাদের হাতে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধ হওয়ার কথা তারাই জড়াচ্ছেন অপরাধে। অনেকের মনে প্রশ্ন জাগছে, ‘সর্ষের মাঝে ভ‚ত নাকি ভ‚ত সর্ষেটাই!

কড়া নজরদারি ও কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা পরও ফাঁস হচ্ছে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার প্রশ্নপত্র। কোনোভাবেই তা ঠেকানো যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে এপ্রিলে শুরু হতে যাওয়া উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের (এইচএসসি ও সমমান) পরীক্ষা নিয়েও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পরীক্ষার বিষয় সংখ্যা বেশি হওয়ায় এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁসের আশঙ্কাও বেশি। এইচএসসির প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে নতুন কী পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারেÑ তা নিয়ে বিস্তর ভাবনা-চিন্তা চলছে। তবে এখন পর্যন্ত আশান্বিত হওয়ার মতো পথ খুঁজে পায়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। চলতি বছর প্রশ্ন ফাঁস এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, শিক্ষাবিদরা এখন পরীক্ষা কমিয়ে দেওয়ার পক্ষে অভিমত দিচ্ছেন।

সর্ষের মাঝে ভ‚ত নাকি ভ‚ত সর্ষেটাই : প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর জন্য গঠিত কমিটির কয়েকজন সদস্য আলাপকালে বলেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে, এটি সত্য। তবে পরীক্ষা বাতিল করার কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না তারা। আর প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে সরকারি অন্যান্য সংস্থার আরো জোরালো ভ‚মিকা চান তারা। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো দায় নিয়ে কাজ করতে হবে। তবে পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, সর্ষেতেই ভ‚ত আছে। প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে খোদ শিক্ষা বোর্ডেরই একটি সিন্ডিকেট যুক্ত। তারা বছরের পর বছর বোর্ডে ঘাপটি মেরে থেকে প্রশ্ন ফাঁসে সহায়তা করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের মালিক বনে গেছেন।

গোয়েন্দারা বলছেন, ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের গুটিকয়েক কর্মকর্তা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ভালো ফল করিয়ে দেওয়ার সহায়তা করতে গিয়ে এ ধরনের অনৈতিক কাজে জড়িয়ে গেছেন। পুলিশের হাতে আটক হওয়া ব্যক্তিদের তথ্যের ভিত্তিতে এই হোতাদের আইনের হাতে তুলে ধরার কাজও চলছে বলে জানা গেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের মূল হোতাদের শনাক্ত করতে রাঘববোয়ালদের নাম উঠে আসছে। এরই মধ্যে এই চক্রের মূল হোতাদের সম্পর্কে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। শিগগিরই তাদের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, প্রশ্ন ফাঁস এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। পুরো শিক্ষাব্যবস্থার জন্য এটা হুমকি হয়ে গেছে। এজন্য পরীক্ষানির্ভর শিক্ষা ব্যবস্থাকে দায়ী করছেন তিনি। তারা মতে, পরীক্ষা কমিয়ে আনলেই প্রশ্ন ফাঁস রোধ সম্ভব। তিনি বলেন, দেশে গোয়েন্দারা জঙ্গিসহ রাজনৈতিক ইস্যুতে দক্ষতা দেখালেও এখানে কেন পারছেন নাÑ এটিও দেখার দরকার।

প্রশ্ন ফাঁস হলেও বাতিল হচ্ছে না পরীক্ষা : প্রশ্নপত্র ফাঁস হলেও এসএসসিতে এ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত পরীক্ষাগুলো বাতিল হচ্ছে না বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। পরীক্ষা বাতিলের পক্ষে নন পরীক্ষা মূল্যায়ন কমিটির বেশিরভাগ সদস্য। ফাঁস রোধে প্রশ্ন প্রণয়ন পদ্ধতির আধুনিকায়ন ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরালো করার পক্ষে এ কমিটি। পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার সময় প্রশ্ন ফের ফাঁস হবে না, এ নিশ্চয়তা বর্তমান পরিস্থিতিতে দেওয়া সম্ভব নয় বলে মনে করে কমিটি। পরীক্ষা বাতিলের বদলে প্রশ্ন ফাঁস চক্রের সদস্যদের আইনের আওতায় আনা ও ফাঁস বন্ধে যথাযথ সুপারিশ করার কথা ভাবছে কমিটি। আজ রোববার কমিটির পক্ষ থেকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ জানানো হতে পারে বলে কমিটির কয়েক সদস্য জানিয়েছেন।

কমিটির কয়েকজন সদস্য মনে করেন, এবার অনুষ্ঠিত সব বিষয়ের প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ আছে। এত বিষয়ের আবার পরীক্ষা নেওয়া সম্ভব নয়। এসএসসি পরীক্ষা শেষ হলে আগামী ২ এপ্রিল থেকে শুরু হবে চলতি শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। এর মধ্যে এইচএসসির পরীক্ষার সূচিও প্রকাশ করেছে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড। দুইটি পাবলিক পরীক্ষা একসঙ্গে নেওয়া খুব দুরূহ বিষয়।

এবারের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার শুরুর আগে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ও শিক্ষা সচিব (মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ) সোহরাব হোসাইন ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যেকোনো বিষয়ে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার পরও প্রশ্ন ফাঁসের প্রমাণ মিললে তা বাতিল করা হবে।’ ১ ফেব্রæয়ারি থেকে পরীক্ষা শুরুর দিন প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ ওঠে। ফাঁসের অভিযোগ তদন্ত করতে গত ৪ ফেব্রæয়ারি ১১ সদস্যের ‘পরীক্ষা মূল্যায়ন কমিটি’ গঠন করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে মূল্যায়ন কমিটির এক সদস্য এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘১৭ ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত এসএসসির সবকয়টি বিষয়ে অনুষ্ঠিত প্রশ্নই ফাঁস হওয়ার অভিযোগ কমিটির কাছে আছে। এত বিষয়ের পরীক্ষা আবার নেওয়া কঠিন। তাছাড়া ফাঁস হওয়া প্রশ্ন পেয়েছে মোট পরীক্ষার্থীর মধ্যে সামান্য একটা অংশ। তাদের জন্য পরীক্ষা বাতিল করলে মেধাবী শিক্ষার্থীরা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা প্রস্তুতি নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। পরীক্ষা বাতিল হলে অভিভাবকরাও তা মেনে নেবেন না।’

পরীক্ষা মূল্যায়ন কমিটির আহŸায়ক ও শিক্ষা সচিব (কারিগরি ও মাদরাসা বিভাগ) মো. আলমগীর এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগগুলো কমিটি খতিয়ে দেখছে। ফাঁস হয়ে থাকলেও এসব প্রশ্ন কত শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রভাব ফেলেছে, এ বিষয়ের ওপর কমিটি জোর দিচ্ছে। হতে পারে ফাঁস হওয়া কোনো বিষয়ের প্রশ্ন পেয়েছে পাঁচ বা দশ হাজার শিক্ষার্থী। অথচ পরীক্ষার্থী আছে ২০ লাখের বেশি। বিষয়টি পর্যালোচনা করে পরীক্ষা বাতিলের করার সুপারিশের সিদ্ধান্ত নেবে কমিটি।’

কমিটির পর্যালোচনা বলছে, পরীক্ষার দিন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে ফেসবুক ও সামাজিক যোগাযোগের অন্য মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁস হয় বলে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সকাল ১০টা থেকে পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুযায়ী পরীক্ষার্থীদের পরীক্ষা কেন্দ্রে উপস্থিত থাকতে হয়। সাড়ে ৯টায় প্রশ্ন ফাঁস হলেও তা পরীক্ষার্থীদের দেখার সুযোগ নেই। ওই সময় তারা কেন্দ্রের ভেতরে থাকে।’

এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে কমিটির এক সদস্য বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আগেও নির্দেশ ছিল পরীক্ষা শুরুর আধা ঘণ্টা আগে পরীক্ষার্থীকে কেন্দ্রে উপস্থিত থাকার। সাড়ে ৯টার দিকে প্রশ্ন ফাঁস হওয়া ও সেগুলো থেকে শিক্ষার্থীদের দূরে রাখতে পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থী কেন্দ্রে প্রবেশের বিষয়ে মন্ত্রণালয় তাই আরো কড়াকড়ি আরোপ করে। ৩০ মিনিট আগে কেউ কেন্দ্রে প্রবেশ না করলে তাকে আর কেন্দ্রে প্রবেশ করতে দেয়া যাবে না বলে গত ১১ ফেব্রæয়ারি লিখিত নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ।’

এইচএসসি পরীক্ষা ঘিরে দুশ্চিন্তা বাড়ছে : আগামী ২ এপ্রিল থেকে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা শুরু হবে। গত ৫ ফেব্রæয়ারি থেকে এই স্তরের পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছাপা শুরু হয়েছে বিজি প্রেসে। আগামী ৩ মার্চ থেকে জেলা প্রশাসকের পাঠানো ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিভিন্ন জেলায় প্রশ্নপত্র পাঠানো শুরু হবে। ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অদ্বৈত কুমার রায় জানান, দেশের বাইরেও সাতটি কেন্দ্রে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। ওই কেন্দ্রগুলোতে প্রশ্নপত্র পাঠাতে ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত সময় লাগে। তাই অন্যান্য পরীক্ষার তুলনায় উচ্চমাধ্যমিক স্তরের প্রশ্নপত্র অনেক আগেই ছাপা শুরু হয়। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা পরিচালনার দায়িত্বে এই কর্মকর্তা আরও জানান, ছাপা শেষে পরীক্ষার অন্তত এক মাস আগেই এইচএসসির প্রশ্নপত্র জেলা প্রশাসকদের ট্রেজারিতে পাঠানো হবে। পরীক্ষা শুরুর আগ পর্যন্ত প্রশ্নপত্র গোপনীয়তার সঙ্গে সংরক্ষণ করা হবে।

কিন্তু এই গোপনীয়তার মাধ্যমে প্রশ্নপত্র ফাঁস কি ঠেকানো যাবে? এমন প্রশ্নের জবাবে আশার বাণী শোনাতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কেউ। শিক্ষা সচিব সোহরাব হোসাইনের বক্তব্যেও যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে তাদের অসহায়ত্বের চিত্র। গত বৃহস্পতিবার তিনি বলেছেন, বর্তমান পদ্ধতিতে পাবলিক পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস রোধ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তার মতে, প্রশ্নপত্র আগেও ফাঁস হতো, এখনও হচ্ছে। তবে বর্তমানে তা বিস্তৃত হচ্ছে ইন্টারনেটকে মাধ্যম করে। নৈতিক অবক্ষয়কেও এর জন্য দায়ী করেন তিনি। এরপরও প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আপ্রাণ চেষ্টা করছে এবং সবার মতামত নিয়ে নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে বলেও সান্ত¡না শুনিয়েছেন শিক্ষা সচিব।

যদিও প্রশ্নপত্র ফাঁসের বর্তমান পরিস্থিতিতে পরীক্ষার অনেক আগে এইচএসসি ও সমমানের প্রশ্নপত্র ছাপার সমালোচনাও করেছেন অনেকে। পরীক্ষার এত আগে প্রশ্ন ছাপলে ফাঁসের আশঙ্কা আরও বাড়বে বলে মনে করছেন তারা। এ ব্যাপারে অভিজ্ঞ শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্টজনরা নানামুখী পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। দিয়েছেন বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও। তবে প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকানোর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে জড়িতদের বিচার নিশ্চিত করার ব্যাপারেই জোর দিয়েছেন তারা। তাদের ভাষ্য, এই অপকর্মে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করার পাশাপাশি পরীক্ষার বিষয় কমিয়ে আনা ও নৈতিকতা চর্চা বৃদ্ধির মাধ্যমে এই দুর্যোগ মোকাবিলা করা সম্ভব।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist