বিশেষ প্রতিনিধি
বন্দুকের নলের সামনে বুক চিতিয়ে বাঙালি
রেসকোর্সে ভাষণের দুদিন পর, অর্থাৎ ’৪৮ সালের ২৩ মার্চ, একই ভুল করল জিন্নাহ। সেদিন যেমন উর্দুর পক্ষে কথা বলতে গিয়ে রোষানলে পড়েছিল বাঙালির, সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল একইভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও। একই ভুল করে সেদিন জিন্নাহ আবারও ঘোষণা দিল ‘অখ- পাকিস্তানের ভাষা হবে উর্দু।’
সমাবর্তন সভার মাঝেই বিরোধিতা করে উঠলেন ভাষা মতিন। চিৎকার দিয়ে বললেন, ‘না, না, তা হবে না।’ সমাবর্তন অনুষ্ঠান মঞ্চ রূপ নিল রাষ্ট্রপ্রধানের সামনে ভাষা আন্দোলনের দাবির ক্ষেত্র। সে আগুন ছড়িয়ে পড়ল সবখানে।
এভাবেই বিক্ষোভের সিঁড়ি বেয়ে আসে ’৫২-র আগুনঝরা ফেব্রুয়ারি। গোটা পূর্ব পাকিস্তান তখন আন্দোলনে উত্তাল। জাগে গণজোয়ার। রাষ্ট্রভাষা বাংলা না হলে ঘরে ফিরবে না- বাঙালির এমন শপথ আরো বেশি তেজোদীপ্ত করে দাবিকে। দাবি আদায়ে পথে-ঘাটে, অলিগলিতে, গোটা পূর্ব পাকিস্তানে জ্বলে শানিত চেতনা। পথে নামে মিছিল।
খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে ২ ফেব্রুয়ারি একটি লিখিত ইশতেহার প্রকাশ করে কমিউনিস্ট পার্টি।
৪ ফেব্রুয়ারি অগ্নিমুখ হয়ে ওঠে ঢাকা। সর্বত্র পালিত হয় ধর্মঘট। অচল হয়ে পড়ে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। পথে নামে ছাত্র-ছাত্রীদের তখনকার সময়ের সবচেয়ে বড় মিছিল। ঢাকা ছাড়া বরিশাল, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, চাঁদপুর, কুমিল্লা, নারায়ণগঞ্জ ও খুলনাসহ দেশের সর্বত্র ধর্মঘট, সভা ও শোভাযাত্রা হয়।
৫-১৪ ফেব্রুয়ারি- ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলে গণমাধ্যমে যুদ্ধ।
৫ ফেব্রুয়ারি করাচি থেকে প্রকাশিত সরকার সমর্থিত ডন পত্রিকায় পূর্ব পাকিস্তানের ভাষা আন্দোলনকে প্রাদেশিকতা বলে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করা হয়।
১২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক পাকিস্তান অবজারভারে এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে খাজা নাজিমুদ্দিনের ব্যাপক গুণকীর্তন করা হয়। পরের দিন সে সম্পাদকীয় নিন্দা করে এক যুক্ত বিবৃতি দেন মওলানা আকরম খান, রাগীব আহসান, মাওলানা গফুর, মাওলানা সামসুল হক, হাফিজ সোলায়মানসহ আরো অনেকে।
রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও দেশ বহির্ভূত আনুগত্যের অভিযোগ এনে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে অবজারভার পত্রিকার মালিক হামিদুর হক চৌধুরী ও সম্পাদক আবদুস সালাম খানকে গ্রেফতার করে সরকার। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে পত্রিকার প্রকাশনা ও আল হেলাল প্রেসটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদে যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ দেশের বিভিন্ন সংগঠন বিবৃতি দেয় ও প্রতিবাদ সভা করে।
৬ ফেব্রুয়ারি ১৪০ মোগলটুলী, ঢাকায় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ভাষা আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহে ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে পতাকা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ছাত্র-ছাত্রীরা ১১ ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা পতাকা বিক্রি করে অর্থ সংগ্রহ করে এবং ২১ ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘট পালনের জন্য প্রচারণা চালায়।
২০ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভাঙা নিয়ে মতানৈক্য দেখা দেয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদে।
অন্যদিকে, ২১ ফেব্রুয়ারির সাধারণ ধর্মঘট বানচালে বিশেষ তৎপর হন পাকিস্তান সরকারের প্রধান সেক্রেটারি আজিজ আহম্মদ। ধর্মঘটের দিন বিভিন্ন সরকারি ব্যবস্থাপনায় প্রবেশের চেষ্টা থেকে ছাত্র-জনতাকে বিরত রাখতে ২০ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩০ দিনের জন্য গোটা ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। নিষিদ্ধ করা হয় সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল। সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসএম হলে ফকির শাহাবুদ্দিন আহম্মদ ও ফজলুল হক হলে আবদুল মমিনের সভাপতিত্বে দুটি পৃথক সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত হয়। সন্ধ্যায় ৯৪ নওয়াবপুর রোডে আওয়ামী মুসলিম লীগ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার পরিকল্পনা প্রণয়ন হয়।
"