গাজী শাহনেওয়াজ

  ৩০ জানুয়ারি, ২০১৮

চার বছর পূর্ণ করল দশম জাতীয় সংসদ

ওয়াকআউটহীন শান্ত অধিবেশন ছিল সমালোচনাও

দশম জাতীয় সংসদ নানা কারণে আলোচিত-সমালোচিত। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় দেশ-বিদেশে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এই সংসদ। নির্বাচন বর্জন করা বিএনপির অনুপস্থিতিতে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসা জাতীয় পার্টি আখ্যা পেয়েছে নামমাত্র বিরোধী দলের। অন্যদিকে এই সংসদের অধিবেশনগুলো ছিল শান্ত। ছিল না ওয়াকআউট। জনগণকে দেখতে হয়নি বিরোধী দলের এমপিরা জামার হাতা গুটিয়ে, ঘুষি উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছেন ট্রেজারি বেঞ্চের দিকে। এভাবেই পক্ষে-বিপক্ষে মতামত নিয়ে দশম জাতীয় সংসদের চতুর্থ বছর পূর্ণ হয়েছে গতকাল সোমবার।

বর্তমান সংসদের চলমান ১৯তম অধিবেশনের মধ্য দিয়ে পাঁচ বছরে পদার্পণ করল আইনসভা। রাজনৈতিক কারণে কিংবা দৈবদুর্বিপাকে রাষ্ট্রপতি সংসদ ভেঙে না দিলে আগামী বছর ২৯ জানুয়ারি শেষ হবে আলোচিত এ সংসদের মেয়াদকাল।

এর সঙ্গে চলতি সংসদ আরো আলোচিত হয়ে থাকবে দেশের ২১তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। ইতোমধ্যে সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, বর্তমান রাষ্ট্রপতিতেই আস্থা রাখছে সরকার। ফলে সংসদে নির্বাচন গড়ানোর আগেই আগামী ৫ ফেব্রুয়ারি সব জল্পনা-কল্পনার অবসান হবে, এমনটাই ধারণা করছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। এছাড়া আলোচিত-সমালোচিত দশম জাতীয় সংসদের জন্য বেদনাহতের ঘটনা কম নয়। কারণ সড়ক দুর্ঘটনা, দুর্বৃত্তের গুলিতে জনপ্রতিনিধি নিহতসহ ২৯ সাংসদকে হারিয়েছে এই সংসদ। এখানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্য রয়েছে।

ঘটনার সূত্রে প্রকাশ, যাত্রা শুরুর মাত্র ৯ মাসের মধ্যেই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর উদ্যোগ নেয় বর্তমান সংসদ। এতে দেশের প্রথম (১৯৭২ সালের) সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনঃস্থাপনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। গত বছরের জুলাইয়ে এই সংশোধনী বাতিল করে দেয় উচ্চ আদালত। এ বিষয়ক পূর্ণাঙ্গ রায়ে বর্তমান সংসদের যোগ্যতা ও সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হলে বিচার, নির্বাহী ও আইন বিভাগের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। এরই জেরে প্রধান বিচারপতিকে অসুস্থ ঘোষণা, তার ছুটির আবেদন, বিদেশ গমন, পদত্যাগ, দুর্নীতির অভিযোগসহ বিভিন্ন ইস্যু আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের ত্রিমুখী অবস্থানকে স্পষ্ট করে তোলে।

জটিলতা এখনো কাটেনি। তবে বর্তমান সংসদকে সফল, বিশেষত ‘বর্জন সংস্কৃতি অবসানকারী সংসদ’ দাবি করে আসছে প্রধান সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও শুরু থেকে তাদের তালে তাল মিলিয়ে ‘গৃহপালিত বিরোধী দল’ খ্যাতি পাওয়া জাতীয় পার্টি (জাপা)।

আর সংসদের বাইরে থাকা বিএনপি এটিকে ‘অবৈধ’ উল্লেখ করে বারবার এটি ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচনের দাবি তুলেছে। সংসদে না থেকেও প্রায় প্রতিটি সংসদীয় বৈঠকে আলোচনায় ছিল দলটি। কার্যত নিষ্প্রাণ চারটি বছর কাটানো এই সংসদ পঞ্চম বছরে পা রাখার প্রাক্কালে শুরু হওয়া ১৯তম অধিবেশনেও সংসদকে ওই দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ তাদের পরিবারের ১৫৫ পাতার দুর্নীতির ফিরিস্তি দিয়েছেন সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সংসদ সচিবালয়ের তথ্য মতে, বিগত চার বছরের চলমান সংসদসহ বৈঠক বসেছে ৩৪৩ দিন। সংসদে ১৩০ বিল পাস করা হয়েছে। সর্বসম্মতভাবে ১৪টি প্রস্তাব করা হয়েছে। গত নভেম্বরে শেষ হওয়া ১৮তম অধিবেশন অবধি সংসদে উত্থাপিত ৯১৫ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা দিয়েছেন আরো ৩৩ হাজার ৪৩৩ প্রশ্নের জবাব।

সরকার ও বিরোধী দলের দাবি মতে, গত চার বছরে জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে আলোচনায় নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি অধিবেশনে অতীতের চেয়ে সরকার ও বিরোধী দলের সদস্যদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণকে ইউনেসকো স্বীকৃতি নিয়ে সরব আলোচনা ছিল সংসদে। সংসদে সর্বসম্মত ধন্যবাদ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল দশম সংসদ। সর্বশেষ চার লাখ কোটি টাকার বাজেট পাস করে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করেছে এই সংসদ। যে কারণে অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে এই সংসদ অনেক বেশি কার্যকর বলে মনে করেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা। একই অভিমত সংসদের স্বতন্ত্র সদস্যদেরও।

তাদের সমর্থন করে সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ‘আমার মনে হয় সরকারি ও বিরোধী দল এবং স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা সক্রিয় অংশগ্রণের মধ্য দিয়ে দশম সংসদ একটি কার্যকর ভূমিকা রেখে চলেছে। যা দেশের গণতন্ত্রকে সুসংহত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।’ এক প্রশ্নের জবাবে স্পিকার বলেন, ‘বিগত চার বছরে বিরোধী দল প্রতিটি অধিবেশনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। কোনো কোনো ইস্যুতে তারা ওয়াকআউট করেছে। এই ওয়াকআউট সংসদীয় রীতির একটি বিষয়। তারা যখন কোনো বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করতে চেয়েছে, তখনই তারা ওয়াকআউট করেছে।’

এদিকে, বিরোধী দলের চেয়ে সরকারি দলের সদস্যরাই মাঝে মাঝে সরকারের নেওয়া জনবিরোধী সিদ্ধান্তগুলোর কঠোর বিরোধিতা করে সংসদকে প্রাণবন্ত রাখেন। বিভিন্ন ইস্যুতে দলীয় এমপিদের এই সংসদীয় আক্রমণে রীতিমতো বিব্রত হয়েছেন একাধিক মন্ত্রী। তবে এই সংসদ সংসদীয় গণতন্ত্রের দেশগুলোর সর্ববৃহৎ দুটি সংস্থার কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) ও ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সফল সম্মেলন আয়োজন করে নজর কাড়ে বহির্বিশ্বের। আর রোহিঙ্গা ইস্যুতে অনন্য নজির সৃষ্টি ছিল বিশ্ববাসীর কাছে চমক।

দেশের বর্তমান আইনসভা একইসঙ্গে সিপিএ ও আইপিইউর নেতৃত্ব দিয়ে ‘বিরল দৃষ্টান্ত’ স্থাপন করেছে উল্লেখ করে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সংসদের চতুর্থ বছরকে ‘সংসদীয় কূটনীতির মাইলফলক’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের গণতন্ত্র নিয়ে যারা সমালোচনা করেন, এই সংসদের সফলতা তাদের মুখে চপেটাঘাত করেছে। আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে।’ এর পাশাপাশি উল্টো চিত্রও ছিল। জাতীয় এবং জনগুরুত্বপূর্ণ হলেও বিভিন্ন আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে সংসদীয় কমিটির সুপারিশগুলো। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ দফতর-অধিদফতরের অনিয়ম এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে সংসদীয় কমিটি ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করলেও কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না; বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অনিয়ম এবং দুর্নীতিতে জড়িতদের শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করার খবরও মিলেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক কর্মকান্ডে নিরীক্ষা প্রতিবেদন দেখতে চেয়েছে সরকারি হিসাব সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু এখন পর্যন্ত তাতে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। একইভাবে জাতীয় সংসদকে ‘পুতুল নাচের নাট্যশালা’ বলায় টিআইবির নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশ করে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এই সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি। পাশাপাশি, গত দুই বছরে এ রকম ২২১টি সুপারিশ করেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এছাড়া তারা বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম খতিয়ে দেখতে ২৮টি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এসব কমিটি ঘটনা খতিয়ে দেখার পর অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত করে প্রতিবেদনও দেয়। কিন্তু দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist