বিশেষ প্রতিনিধি

  ২৯ জানুয়ারি, ২০১৮

নির্বাচন ঘিরে আলোচনায় কালো টাকা

বাজেট ও জাতীয় নির্বাচন এলেই ঘুরেফিরে আলোচনায় আসে কালো টাকার বিষয়টি। পাল্টাপাল্টি অবস্থান নেন অর্থনীতিবিদ ও সরকার। বাজেটের আগে অর্থনীতিবিদরা কালো টাকা সাদা করার সুযোগ না দেওয়ার পরামর্শ দেন। পক্ষান্তরে, নানা কৌশলে সাদা করার সুযোগ রাখে সরকার। একইভাবে নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব কমাতে তাগিদ দেন অর্থনীতি ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা। কিন্তু সে তাগিদ শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় না। প্রার্থী মনোনয়ন থেকে শুরু করে নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে কালো টাকা। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিয়ে উদ্বেগ থেকেই যায়।

এবারও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ঠিক একইভাবে আলোচনায় আসছে কালো টাকার বিষয়টি। বিশেষ করে চলতি অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার আগেই অর্থনীতিবিদরা আসন্ন নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করে দিয়ে আসছিলেন। সর্বশেষ গতকাল স্বয়ং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের ভোটের বছর কালো টাকার ছড়াছড়ি নিয়ে সতর্ক বার্তা- বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় এল।

গতকাল রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী জানান, দেশের ব্যাংকগুলোতে এই মুহূর্তে ঋণ ও আমানতের অনুপাত সাধারণ মাত্রার চেয়ে বেশি। বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত এটি নিয়ন্ত্রণ করা। কারণ এ বছর নির্বাচনের বছর। এ বছর টাকা পয়সার ছড়াছড়ি বেশি হবে, কালো টাকা হয়তো যথেষ্ট আসবে বাজারে, এ বছর সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।

অর্থমন্ত্রীর এই উদ্বেগের তথ্য মিলেছে দেশের ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে ঋণ ও আমানতের ভারসাম্যহীন চিত্র থেকে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রমতে, নতুন করে যে পরিমাণ আমানত আসছে, কয়েকটি ব্যাংক তার দ্বিগুণ ঋণ বিতরণ করছে। ফলে ঋণ আমানত অনুপাতের সীমা অতিক্রম করছে ওই ব্যাংকগুলো। এভাবে আগ্রাসী ব্যাংকিং করায় গ্রাহকদের আমানত ঝুঁকিতে পড়ছে। এতে পুরো ব্যাংক খাতে আমানতের চেয়ে ঋণ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অর্থাৎ ৫০ টাকা আমানত এলে ব্যাংকগুলো ঠিক ওই সময়ে ১০০ টাকা ঋণ বিতরণ করছে। ঋণের অর্থ জোগান দিতে অনেক ব্যাংক বিভিন্ন বিল ও বন্ডে থাকা বিনিয়োগ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। সংকটে থাকা কয়েকটি ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ধার করে ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব পড়তে পারেÑ সেটি সরকারকে চলতি বাজেট ঘোষণার আগেই বলা হয়েছিল। কিন্তু শোনেনি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রেখেছে। নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব কমাতে হলে বাংলাদেশ ব্যাংক ও নির্বাচন কমিশনকে সতর্ক থাকতে হবে। নির্বাচনের আগে ব্যাংকগুলোতে আর্থিক লেনদেন ও নির্বাচনী মাঠে অর্থ ব্যয়ের বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিশেষ করে অর্থ ব্যয়ের ব্যাপারে নির্বাচনী আইন মানতে সবাইকে বাধ্য করতে হবে।

এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, বাজেট ঘোষণার আগেই আমরা বলেছিলাম, আইন দিয়ে কালো টাকা সাদা করা যাবে না। সাদা করার সে সুযোগ রাখার দরকারও নেই। কিন্তু সেটা শোনা হয়নি। এখন নির্বাচন সামনে। ফলে কালো টাকার বিষয়টি সামনে চলে আসছে। নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার একেবারেই বন্ধ করা যাবে না। নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সেজন্য নির্বাচন কমিশন ও বাংলাদেশ ব্যাংককে ভূমিকা নিতে হবে।

সর্বশেষ ২০১৩ সালে প্রকাশিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০০৯ সালে দেশে কালো টাকার পরিমাণ ছিল প্রায় পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের বাজেটের দ্বিগুণেরও বেশি। এই কালো টাকা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সর্বনিম্ন ৪৬ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ প্রায় ৭৫ শতাংশ। অথচ ১৯৭৩ সালেও দেশে কালো টাকার হার ছিল সর্বনিম্ন ৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ মাত্র ৭ দশমিক ২ শতাংশ।

কালো টাকার কয়েকটি নেতিবাচক দিকের কথা জানিয়েছেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও কালো টাকার প্রভাব দিন দিন বাড়ছে। অথচ দেশের অর্থনৈতিক সূচকগুলোর প্রক্ষেপণ করা হচ্ছে বিপুল অঙ্কের এই টাকাকে বাদ দিয়েই। আবার এর ওপর ভিত্তি করেই প্রণয়ন করা হচ্ছে দেশের আর্থিক ও রাজস্বনীতি। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক নির্দেশনা পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি মূলধনের এই বিরাট অংশ আনুষ্ঠানিক অর্থনীতির বাইরে থাকলে সম্পদের বুদ্বুদ (এসেট বাবল) তৈরি হচ্ছে, যা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতেও।

অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, কালো টাকাকে অর্থনীতির মূল ধারায় আনতে স্বাধীনতার পর থেকেই চেষ্টা করা হচ্ছে। স্বাধীনতার পর দেশে এ পর্যন্ত বাজেট ঘোষণা হয়েছে ৪৬ বার। এর মধ্যে ২০ বার রাখা হয়েছে কালো টাকা সাদা করার বিশেষ সুযোগ। তবে আশানুরূপ সাড়া মিলছে না।

কালো টাকা সাদা করার ব্যক্তির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হলে অধ্যাপক আবু আহমেদ জানান, ক্ষমতাশালীরাই কালো টাকার মালিক। প্রভাব খাটিয়ে তারা নিজেদের অর্থ লুকিয়ে রাখছেন। এই শ্রেণির লোকজন সুযোগ না নেওয়ায় কালো টাকা সাদা করার করদাতার সংখ্যা কমতে পারে। এছাড়া দুদক এবং কর কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় কালো টাকা সাদা করতে চাইছেন না বলেও মত দিয়েছেন তিনি।

এর আগে চলতি অর্থবছরের বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখার ব্যাপারে আপত্তি জানিয়েছিল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। এ ব্যাপারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, কালো টাকা সাদা করার যে সুযোগ তা সংবিধানের ২০ (২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং সরকারের ঘোষিত ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপসহীন মনোভাব’ বা বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতির পরিপন্থী। অথচ কালো টাকা বৈধ করার এই অব্যাহত সুযোগ রাজস্ব আদায় বা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টিতে বাস্তবে কখনো কোনো উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারেনি। অথচ কোনো কোনো বিশেষ প্রভাবশালী সুবিধাভোগী মহলের অবৈধতাকে প্রশ্রয় দিয়ে সমাজে অনৈতিকভাবে সুরক্ষা দিয়ে সততার চর্চাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে কালো টাকার ছড়াছড়ি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর সতর্ক বার্তার সঙ্গে একমত অর্থনীতি বিশ্লেষকরাও। তাদের মতে, এই মুহূর্তে ব্যাংকে ঋণ ও আমানতের অনুপাত সাধারণ মাত্রার চেয়ে উঁচুতে থাকায় এই উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। এটার নিয়ন্ত্রণ দরকার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত আগস্টে ব্যাংকগুলোর আমানত দাঁড়িয়েছে নয় লাখ ৫৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এই সময়ে ব্যাংকগুলোর ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাত লাখ ৪৫ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। অথচ স্বাভাবিকভাবে আমানতের চেয়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ার কথা। আমানত ও ঋণের প্রবৃদ্ধি ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে ছিল যথাক্রমে ১৬ দশমিক ৬৮ ও ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। আর গত আগস্টে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৮ দশমিক ৯৫ শতাংশ। ওই সময়ে ঋণের প্রবৃদ্ধি বেড়ে হয়েছে ১৫ দশমিক ৭ শতাংশ।

এ ব্যাপারে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, ঋণ ও আমানতের অনুপাতিক ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংককে এই উদ্যোগ নিতে হবে। কিন্তু তা না করে উল্টো অর্থমন্ত্রী বলছেন, বাজেট থেকে ব্যাংকে অর্থ ভর্তুকি দেবে। এটা ঠিক না। ব্যাংক ব্যবসায় যারা জড়িত, তাদের দায় নিতে হবে। নতুবা এই ভারসাম্যের নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নির্বাচনে।

কালো টাকার নির্বাচনে প্রভাব প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর

অধ্যাপক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, কালো টাকা সাদা করার ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া ঠিক না। উদ্যোগ কাজ করে না। বরং কালো টাকা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গোয়েন্দা ইউনিটকে আরো প্রশিক্ষিত করতে হবে। তারা নজরদারিতে রাখবে। নির্বাচনে কালো টাকার প্রভাব ঠেকাতে হলে নির্বাচন কমিশনকে কঠোর হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে বেঁধে দেওয়া পরিমাণের বাইরে যেন কেউ অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় করতে না পারে। নির্বাচনে ঘুষ লেনদেন হয়। ভোট কেনাবেচা হয়। সেটা যেন বন্ধ করা যায়।

তবে অধ্যাপক আবু আহমেদের মতে, টাকা সাদা কি কালো তা পৃথক করা কঠিন। নির্বাচনী আইনে যে পরিমাণ টাকা ব্যয়ের বিধান রয়েছে, সেটা যেন হয়, নির্বাচন কমিশনকে তা নিশ্চিত করতে হবে। রঙিন পোস্টার করা যাবে না। ট্রান্সপোর্ট দিয়ে ভোটারদের আনা নেওয়া করা যাবে না। রাতের অন্ধকারে টাকা লেনদেন নিষিদ্ধ। এমন নিয়মগুলো কাগজে-কলমে না রেখে বাস্তবায়ন করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist