কাইয়ুম আহমেদ ও হাসান ইমন

  ১৯ জানুয়ারি, ২০১৮

নতুন ওয়ার্ডের উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে শঙ্কা

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সঙ্গে আট ইউনিয়ন পরিষদ যুক্ত করে মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন বলেছিলেন, এই সব ইউনিয়নের অধিবাসীদের সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে আলোকিত করা হবে। এজন্য বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু গতকাল বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের এক নির্দেশে এসব নতুন ওয়ার্ডে কাউন্সিলর ও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে উপনির্বাচন ও সম্প্রসারিত অংশের কাউন্সিলর নির্বাচনও তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ফলে শুরুতেই হোঁচট খেলেন নতুন ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। এখন তাদের মধ্যে নাগরিক সেবাপ্রাপ্তি নিয়ে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে। অবিভক্ত সিটিতে নির্বাচনের আগের অবস্থা বর্ণনা করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন ওয়ার্ডে আবার সেই পুরনো অবস্থা ফিরে এলো। এদিকে, আয়তন দ্বিগুণ হলেও এতদিন কোনো এসব এলাকায় উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। সবকিছুই বেড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। ঘিঞ্জি অলিগলি, সরুপথ, খানাখন্দে ভরা এবড়োখেবড়ো রাস্তা। এসব এলাকায় নির্বাচন হলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে নিতে পারতেন, এলাকাবাসীর ভালো-মন্দ দেখভাল করতেন। কিন্তু নির্বাচন আটকে যাওয়ায় সেই উন্নয়ন কর্মকান্ড গতি হারাতে পারে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, ভোট স্থগিত হয়ে যাওয়ায় উন্নয়ন কর্মকান্ডে এর প্রভাব পড়বে না।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নতুন এলাকার বাসিন্দাদের ঢাকার সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ থাকলেও বছরের পর বছর নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন তারা। এলাকাগুলোর রাস্তা-ঘাট, নর্দমা, ফুটপাত, ড্রেনেজ ব্যবস্থাসহ সিটি করপোরেশন উপযোগী অবকাঠামোগত ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। অপরিকল্পিতভাবে বিচ্ছিন্ন উন্নয়ন ও অব্যবস্থাপনায় এলাকাগুলোর বেহাল অবস্থা। তাই এসব ইউনিয়নকে সিটি করপোরেশনের আওতায় নেওয়াটা ভালো হলেও জনপ্রতিনিধি না থাকলে নতুন ওয়ার্ডগুলো ঘিঞ্জি এলাকায় পরিণত হবে। সিটি করপোরেশনের বর্তমান কাঠামো ও ক্ষমতা বজায় রেখে আধুনিক নগর ব্যবস্থাপনার কাজটি কঠিন হবে। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা ঢাকা শহর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের মূল সমস্যা। তাই বাড়তি এলাকা নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে সংস্থা দুটিকে। এ ক্ষেত্রে জনবল নিয়োগ ও সক্ষমতা না বাড়ালে যুক্ত হওয়া নতুন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের পাশাপাশি রাজধানীবাসীও পর্যাপ্ত নাগরিক সুবিধা পাবেন না।

এদিকে, ঢাকা উত্তরের মেয়রের মৃত্যুর পর উন্নয়ন কাজের গতি শ্লথ হয়েছে। প্রয়াত মেয়র যেসব নাগরিকবান্ধব উদ্যোগ নিয়েছিলেন, সেসব কাজেও ভাটা পড়েছে। দাফতরিক কাজে গতিহীনতার পাশাপাশি উন্নয়নকাজও চলছে ধীরে। তাছাড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, টেবিলে টেবিলে ফাইলের স্তূপ, গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা ইত্যাদি মিলিয়ে স্থবির হয়ে পড়েছে গুলশান নগর ভবন। বিশেষ করে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শেষ পর্যন্ত তেজগাঁওয়ের যে অবৈধ ট্রাক স্ট্যান্ডটি অপসারণ করেছিলেন, তার অবর্তমানে রাস্তার ওপর আবারও পার্কিং শুরু করেছেন ট্রাকচালকরা। মাঝেমধ্যে অভিযান চালিয়েও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছে না ডিএনসিসি। তবে সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছেÑ সব ঠিক হয়ে যাবে।

গেল বছরের ২৬ জুলাই ডিএসসিসির আগের ৫৭ ওয়ার্ডের সঙ্গে যুক্ত হয় আরো ১৮টি ওয়ার্ড। ফলে ওয়ার্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭৫। নতুন যুক্ত হওয়া এলাকা হচ্ছে, শ্যামপুর, দনিয়া, মাতুয়াইল, সারুলিয়া, ডেমরা, মান্ডা, দক্ষিণগাঁও ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন।

সীমানা নির্ধারণের দায়িত্ব পালনকারী একাধিক সদস্য জানিয়েছেন, সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সংসদ সদস্য, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, ইউপি সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের মতামতের ভিত্তিতে ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিএসসিসির দক্ষিণগাঁও ইউনিয়নকে একটি ওয়ার্ড করা হয়েছে। নম্বর ৭৩। মান্ডা ইউনিয়নকে দুটি ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে। নম্বর ৭১ ও ৭২। ডেমরা ইউনিয়নকে দুটি ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে। নম্বর ৬৯ ও ৭০। এভাবে মাতুয়াইল ইউনিয়নকে ৬৩ ও ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে, সারুলিয়া ইউনিয়নকে ৬৬, ৬৭ ও ৬৮ নম্বর ওয়ার্ডে, দনিয়া ইউনিয়নকে ৬০ ও ৬১ নম্বর ওয়ার্ডে, শ্যামপুর ইউনিয়নকে ৫৮ ও ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডে ভাগ করা হয়েছে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বাড্ডা, ভাটারা, সাঁতারকুল, বেরাইদ, ডুমনি, উত্তরখান, দক্ষিণখান ও হরিরামপুর ইউনিয়নকে ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১, ৪২, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে।

নতুন করে ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত হওয়ায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকার আয়তন ১২৯ বর্গ কিলোমিটার থেকে বেড়ে ২৭০ বর্গ কিলোমিটার হয়েছে।

২০১৬ সালের ৯ জুন প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস-সংক্রান্ত জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটিতে (নিকার) ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আটটি করে মোট ১৬টি ইউনিয়ন যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরে ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন-২০০৯’ কাউন্সিলর নির্বাচনের উদ্দেশ্য সীমানা নির্ধারণ কর্মকর্তার সুপারিশ অনুযায়ী, করপোরেশনের ১৬টি ইউনিয়নকে ওয়ার্ডে বিভক্ত করা হয়েছে।

সূত্র জানায়, ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে কাউন্সিলরদের তত্ত্বাবধানে ১৭ ধরনের নাগরিক সেবা কার্যক্রম পরিচালনা হয়ে থাকে। এর মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক ধরনের সমস্যা কাউন্সিলররা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায়ই সমাধানে সক্ষম হতেন। কিন্তু এখন সবকিছু এসে জমা হচ্ছে আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক প্রতিদিনের সংবাদকে বলেন, জনপ্রতিনিধি না থাকলে উন্নয়ন কর্মকা- ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতাও প্রকট হয়ে ওঠে। আর জনগণও তাদের সমস্যা-দুর্দশার কথা বলার প্রতিনিধি পান না। তখন নাগরিক সেবা প্রাপ্তি নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। উন্নয়ন কাজ দীর্ঘায়িত হয় কিংবা আগায় না। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিরা দুর্নীতি করলেও একটা দায়বদ্ধতা থাকে, একটা কাঠামোর মধ্যে থাকে। কিন্তু যখন জনপ্রতিনিধির জায়গায় আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি চলে আসে তখন নাগরিকদের ভোগান্তি বাড়ে। এক কথায়, নাগরিক জীবনে স্থবিরতা নেমে আসে।

এ প্রসঙ্গে একজন স্থপতি বলেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি প্রথমে এসব এলাকাকে একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসেন। বিশেষ করে ওয়াসার পানির লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নিশ্চিত করা, ড্রেনেজ, স্যুয়ারেজ সিস্টেম শৃঙ্খলায় আনা। কিন্তু প্রতিনিধি না থাকায় জনগণ কাক্সিক্ষত সেবা থেকে বঞ্চিত হবেন। তা ছাড়া স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে সহজেই নাগরিকত্ব, জন্ম, ওয়ারিশ সনদসহ প্রয়োজনীয় সনদ সংগ্রহ নিয়েও সমস্যা দেখা দেবে। নির্বাচিত প্রতিনিধি না থাকায় এসব সনদ পেতে যেতে হবে দূরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে। ভাঙা রাস্তা, ময়লার স্তূপ, জলাবদ্ধতা, মশার উৎপাতসহ নানা সমস্যা নিয়েই থাকতে হবে নতুন ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের। আবার সেবা পেতে পদে পদে ভোগান্তিও মেনে নিতে হবে।

এ বিষেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী মো. আসাদুজ্জামান বলেন, নতুন ১৮টি ওয়ার্ডের সড়ক সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে গত বছরে। এরমধ্যে কয়েকটি এলাকায় সড়ক সংস্কারের কাজ চলছে। ওই এলাকায় নির্বাচন স্থগিত হলেও উন্নয়ন প্রকল্পে কোনো ধরনের প্রভাব পড়বে না। এসব উন্নয়ন কাজ নিজ গতিতে চলবে এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই শেষ হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist