জুবায়ের চৌধুরী

  ০৯ জানুয়ারি, ২০১৮

পুলিশ সপ্তাহ শুরু

সন্ত্রাস দমন ও হেফাজতে মৃত্যু আইন সংশোধনের দাবি

জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমন এবং হেফাজতে আসামির মৃত্যুবিষয়ক আইন সংশোধনের দাবিসহ সরকারের কাছে পুলিশের আরো চাওয়া-পাওয়া নিয়ে শুরু হয়েছে ‘পুলিশ সপ্তাহ-২০১৮’। গতকাল সোমবার কল্যাণ প্যারেডে এসব দাবি-দাওয়া প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরেছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তবে আজ মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশেষ বৈঠকে কিছু বাছাই করা দাবি উপস্থাপন করবেন তারা। এ ছাড়াও বড় ধরনের রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য এক ধরনের অনুমোদন ছাড়াই মামলা ও তদন্ত শেষ করার ক্ষমতা চাইছে পুলিশ। গতকাল পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপকালে এসব তথ্য জানা গেছে। সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করতে হলে পুলিশকে ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমোদন নিতে হয়। আবার তদন্ত শেষে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এই দুই অনুমোদনের জটে পড়ে যাচ্ছে গুরুতর অনেক অভিযোগ। পুলিশ বলছে, এ ধারার সংশোধন না হলে বিচার প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হতে পারে। আর তাই এ থেকে মুক্তির উপায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলবেন পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা এ আইনের সংশোধন করার দাবি জানাবেন। হেফাজতে আসামির মৃত্যুর জন্য প্রচলিত আইন শিথিল করার দাবিও উঠছে। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা সরকারিভাবে পোশাক চাইবেন। পুলিশের জন্য আলাদা মেডিক্যাল কলেজ এবং অ্যাভিয়েশন করে হেলিকপ্টার দেওয়ার দাবিও থাকবে। এ ছাড়া ব্যাংকের অনুমোদন মিললেও ব্যাংক চালুর জন্য তহবিলসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা করবেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্র জানিয়েছে, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পোশাক দেওয়া, হেফাজতে মৃত্যুর আইন শিথিল করা এবং মেডিক্যাল কলেজ স্থাপনসহ আরো বেশ কিছু দাবি জানাবেন পুলিশ কর্মকর্তারা। বর্তমান সরকারের আমলে শেষ পুলিশ সপ্তাহে গত চার বছরের কাজের মূল্যায়ন এবং নির্বাচন-পূর্ব আইনশৃঙ্খলা-বিষয়ক প্রস্তুতি নিয়েও আলোচনা হবে এবারের পুলিশ সপ্তাহে।

পুলিশের দায়িত্বশীল একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় জঙ্গিবাদ অত্যন্ত গুরুত্ব এক ইস্যু। জঙ্গিদের গ্রেফতারের পর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করা হয়। আইনটি ২০০৯ সালে প্রণীত। আইনের একটি ধারায় রয়েছেÑসরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া এ আইনের অধীনে কোনো অপরাধ বিচারের জন্য আমলে নেওয়া হবে না। এধারার ব্যাখা হিসেবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন রয়েছে। সেখানে বলা আছে, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা মামলার চার্জশিট দাখিলের আগে এর একটি অনুলিপি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠাতে হবে। এরপর সেখানে অনুমোদন পাওয়ার পর তা বিচারের জন্য আমলে নেওয়া হবে।

পুলিশ কর্মকর্তাদের ভাষ্য, বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে করা চাঞ্চল্যকর মামলার চার্জশিট অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে মাসের পর মাস আটকে থেকেছে। ২০১৫ সালে পুরান ঢাকার হোসনি দালানে জঙ্গি হামলার ঘটনায় করা মামলার চার্জশিটের ক্ষেত্রে বিড়ম্বনায় পড়ে পুলিশ। এ মামলার তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের মাঝামাঝিতে চার্জশিট দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন চার্জশিট অনুমোদনের জন্য আটকে থাকার পর গণমাধ্যমে লেখালেখি শুরু হয়। এরপর চার্জশিটে অনুমোদন দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, অন্য কোনো ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে এ ধরনের বিধান না থাকলেও কেন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে এমন ধারা যুক্ত করা হবে?

আরো যা চায় পুলিশ : নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু আইনের সংশোধন চায় পুলিশ। তারা বলছে, আইনে নির্যাতন যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তা আরো পরিষ্কার হওয়া জরুরি। আইনে মানসিক কষ্ট বলতে কী বোঝায়, সে বিষয়টি আরো স্পষ্ট করার দাবি পুলিশের। পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় আসামির মৃত্যু নিয়ে বাহিনীকে বিব্রত ও দেশ-বিদেশে সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়। মানবাধিকারের প্রশ্ন উঠে। হেফাজতে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগই বেশি। কালেভদ্রে পুলিশের সাজাও হয়। তবে আইনের কিছু অস্পষ্টতা দূর করতে চায় পুলিশ।

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি পুলিশ একাডেমি, প্রস্তাবিত সাইবার ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো গ্রেড-১, গ্রেড-২-সংক্রান্ত প্রস্তাব, পুলিশের যানবাহন বাড়ানো, মোটরসাইকেল কেনার জন্য উপপরিদর্শকদের দুই লাখ টাকা ঋণ প্রদান, প্রশিক্ষণ ভাতা বৃদ্ধি, পুলিশ বিভাগে বিদ্যমান সব আউটসোর্সিং পদ অর্থ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চতুর্থ শ্রেণিতে নিয়মিতকরণসহ ভবিষ্যতে আউটসোর্সিং হিসেবে নতুন পদ সৃষ্টি না করা-সংক্রান্ত প্রস্তাব তুলে ধরার কথা রয়েছে। এ ছাড়া ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পোশাকসামগ্রী সরকারিভাবে সরবরাহ করা, পুলিশের নামে বরাদ্দকৃত খাসজমির নামজারি, স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) পূর্বাচল নিউ টাউনে ১০ বিঘা জমি বরাদ্দ, পুলিশ মেডিক্যাল কলেজ, সারা দেশে নৌ-পুলিশের নামে ৮১ একর জমি দেওয়ার বিষয়টি পুলিশের আলোচ্য এজেন্ডায় রয়েছে। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-৭৪ সালে পুলিশকে ১৫৩টি বাড়ি দিয়েছিলেন। বাড়িগুলো পুলিশের নামে নামজারি করার প্রস্তাব, ডিএমপিতে ডাম্পিংয়ের জন্য ১০ একর জায়গা বরাদ্দ, পুলিশ বাহিনীর অনুকূলে পরিত্যক্ত জমি বরাদ্দ, ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার ও রেঞ্জ ডিআইজির আবাসিক ভবন নির্মাণ পুলিশের আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে রয়েছে।

পুলিশের একাধিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলছেন, জঙ্গি দমনে সরাসরি পুলিশের যেসব ইউনিট (বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল, সোয়াট ও কাউন্টার টেরোরিজম) কাজ করছে তাদের ২০০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা দেওয়া যেতে পারে। বর্তমানে কনস্টেবল থেকে এস আই পর্যন্ত সদস্যরা ৩০ শতাংশ ঝুঁকি ভাতা পেয়ে থাকেন। তবে সবার জন্য ভাতার ব্যবস্থা করার কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণে আলাদা ব্যাটালিয়ন গঠন করতে চায় পুলিশ।

পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, প্রতিবছর পুলিশ সপ্তাহে পুলিশের পক্ষ থেকে নানা দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে কিছু দাবি পূরণ হয়, আবার কিছু পূরণের আশ্বাস পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে পুলিশ সপ্তাহে বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয়। তা হলোÑথানা ও আলামত সংগ্রহের স্থান বাড়ানো, আবাসন সমস্যা নিরসন, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট গঠন, বিশেষায়িত ব্যাংক স্থাপন, থানাপ্রতি পাঁচটি পিকআপ ভ্যান, রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালকে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উন্নীতকরণ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পুলিশের একজন লিয়াজোঁ কর্মকর্তা নিয়োগ এবং মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, দুদক, পাসপোর্ট অফিস, বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট কর্তৃপক্ষ, কারা অধিদফতরসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গুরুত্বপূর্ণ পদে পুলিশ কর্মকর্তাদের প্রেষণে কাজের সুযোগ। এসব দাবির কিছু পূরণ হয়েছে, কিছু এখনো ফাইলবন্দি।

পদক পেলেন ১৮২ পুলিশ সদস্য : ২০১৭ সালে অসীম সাহসিকতা ও বীরত্বপূর্ণ কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ১৮২ পুলিশ সদস্যকে পদক দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসের প্যারেড গ্রাউন্ডে পুলিশ সপ্তাহের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী তাদের মেডেল পরিয়ে দেন। তাদের মধ্যে মরণোত্তর পদক পেয়েছেন দায়িত্ব পালনরত অবস্থায় নিহত র‌্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ, পুলিশ পরিদর্শক চৌধুরী আবু কয়ছর ও মনিরুল ইসলাম। গত বছরের ২৫ মার্চ সিলেটের শিববাড়ীর আতিয়া মহলের জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে এ তিনজন নিহত হন। তাদের পক্ষে পরিবারের সদস্যরা পদক গ্রহণ করেন।

আইজিপি ব্যাজ পাচ্ছেন ৩২৯ জন : ২০১৭ সালে পুলিশি সেবার মাধ্যমে ভালো কাজ করায় ছয়টি ক্যাটাগরিতে ৩২৯ জন পুলিশ সদস্যকে ‘আইজিপি গুড সার্ভিসেস ব্যাজ’ দেওয়া হচ্ছে। আগামীকাল ১০ জানুয়ারি রাজারবাগ প্যারেড গ্রাউন্ডে মনোনীতদের ব্যাজ পরিয়ে দেবেন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক।

সাত মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা : এবার পুলিশ সপ্তাহে প্রথমবারের মতো সাতটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনায় অংশ নেবেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মন্ত্রণালয়গুলো হলোÑঅর্থ, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, পরিকল্পনা, স্বরাষ্ট্র, ভূমি, জনপ্রশাসন এবং আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। সেখানে মন্ত্রণালয়ের সচিবরাও থাকবেন। আজ মঙ্গলবার বেলা ১১টায় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের সম্মেলন, সন্ধ্যায় রাজারবাগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কর্মকর্তাদের বৈঠক। রাতে সাত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। বুধবার দুপুরে বঙ্গভবনে ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন রাষ্ট্রপতি। বৃহস্পতিবার মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আইজিপির সম্মেলন ও শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী শুক্রবার আইনশৃঙ্খলা ও অপরাধ-সংক্রান্ত মতবিনিময় সভার মধ্য দিয়ে এবারের পুলিশ সপ্তাহের আয়োজন শেষ হবে। এর আগে গতকাল সকাল ১০টায় ‘জঙ্গি-মাদকের প্রতিকার, বাংলাদেশ পুলিশের অঙ্গীকার’Ñএ স্লোগানে পুলিশ সপ্তাহ-২০১৮-এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist