মাহাবুব চান্দু. মেহেরপুর
হাতুড়ে ডাক্তার করেন জটিল রোগের চিকিৎসা, দেখার কেউ নেই
মেহেরপুরের হাতুড়ে ডা. খয়রদ্দিনের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট নেই। তিনি ১১ বছর ধরে জটিল রোগের চিকিৎসা করে যাচ্ছেন। প্রতিদিন ৫০ জনেরও বেশি রোগীর চিকিৎসা করছেন। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ, জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ তাকে কোনো বাধা দিচ্ছে না। চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিক সনদ না থাকা এই ব্যক্তি এলাকায় চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এই চিকিৎসকে কেন বেআইনিভাবে রোগী দেখতে দেওয়া হচ্ছে।
মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বাগোয়ান গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, দ্বিতল নিজ বাড়ির নিচতলায় একটি রুমে রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছেন ডা. দাবিদার কাজি খয়রদ্দিন (রবি)। চেম্বারের পাশে তার নিজস্ব বিশাল ফার্মেসি। এই ডাক্তারের বাবা ছিলেন কাজি আলাউদ্দীন রবি। তিনি ছিলেন গ্রামের পল্লী চিকিৎসক। চিকিৎসাক্ষেত্রে বাবার নাম-ডাক ছিল। তিনি ১১ বছর আগে মারা যাওয়ার পর ডাক্তার হয়ে বসেছেন খয়রদ্দিন রবি। চিকিৎসায় বাবার নাম-ডাকের কারণে বাবার ডাক-নামটি তিনিও ব্যবহার করছেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, এই চিকিৎসকের আজিজ মেডিক্যাল হল নামের চেম্বারের সামনে অনেক রোগীর ভিড়। তাদেরই একজন সদর উপজেলার রাজাপুর গ্রামের লুৎফর রহমানকে (৮০) দেখা গেল ৩৭ নম্বরের সিরিয়ালে চিকিৎসাসেবা নিতে রিকশা-ভ্যানে শুয়ে আছেন। তিনি স্ট্রোকে আক্রান্ত। তার ডাক পরে দুপুর ১টায়। সিরিয়াল পাওয়ার পর তাকে দুই সপ্তাহের চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। লুৎফর রহমান জানান, কোনো সুফল মিলছে না। অন্যের কথা শুনে এই ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে গিয়ে শুধুই টাকা খরচ হচ্ছে। গাংনীর হাড়িয়াদহের ব্রেনস্ট্রোকে আক্রান্ত মর্জিনা খাতুন (৬০) দুই মাস ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তিনি জানালেন, অনেকের মুখে ডাক্তার খুব ভালো শুনেছেন বলে চিকিৎসা নিতে এসেছেন। তাকে দেওয়া হয়েছে সেরিটন, ইকোস্প্রিন, ক্লোন, ইসোকেফ, পার্কিনিল, ভিডোগা। এসব ওষুধে তার শুধুই ব্যথা কমেছে, কিন্তু অন্য উপসর্গ থেকেই গেছে।
চিকিৎসকের চেম্বারের সামনে বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিদের অবস্থান দেখা যায়। বায়োফার্মার প্রতিনিধি সাদিক হোসেন জানান, তিনি প্রতি মাসে দেড় দুই লাখ টাকার ওষুধ বিক্রি করেন। ড্রাগ কোম্পানির প্রতিনিধি রাজন আলী, এসকেফের ওবায়দুল হাসান জানিয়েছেন এই ডাক্তারের সুবাদে তারা অনেক মেডিসিন বিক্রি করতে পারছেন।
কী রোগের চিকিৎসা করেন জানতে চাইলে খয়রদ্দিন জানান, ব্যথা, অবশ, হার্ট, স্ট্রোক, বেলসপালসিসহ (মুখবাকা) বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগের। তিনি ভিজিট ছাড়া রোগী দেখলেও প্রতি রোগীকেই এক সপ্তাহের ওষুধের দাম দিতে হয় ১১০০ টাকা। ওনার ডিসপেনসারিতে দেখা যায়, ১০ থেকে ১২ রকমের ওষুধে আলমিরা ভরে আছে। কুষ্টিয়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের নিউরো মেডিসিনের ডা. মো. আশাদুর রহমান শামীম জানান, উনি ব্যবস্থাপত্রে যেসব ওষুধের নাম লিখছেন সেগুলো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছাড়া কেউ ব্যবহার করতে পারেন না। একজন হাঁতুড়ে ডাক্তার রোগীদের এসব ওষুধ দিতে পারেন না। এতে রোগীর বিপদ হতে পারে।
মেহেরপুরের সিভিল সার্জন জি কে এম সামসুজ্জামান বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। এই অপচিকিৎসা বন্ধ হওয়া দরকার। অবশ্যই আমি আইনগত ব্যবস্থা নেব।’ জেলা প্রশাসক পরিমল সিংহ বলেন, ‘আমি এখনই মুজিবনগর ইউএনওকে দিয়ে তদন্তসাপেক্ষে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘ডা. খয়রদ্দিনের বাবা সাধারণ রোগের চিকিৎসা করতেন, এটা জানি। এখন তার ছেলে ডাক্তারি বিদ্যা ছাড়াই জটিল রোগের চিকিৎসা করছেন, তা তো জানি না।’
"