হাসানুজ্জামান তুহিন শাহজাদপুর থেকে

  ২৫ জুন, ২০১৬

শাহজাদপুরের নবরত্ন মন্দির

সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার পোতাজিয়া গ্রামের নবরতœ মন্দির একটি অন্যতম পুরাকীর্তি। ঐতিহাসিকদের মতে, মন্দিরটি সপ্তদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল। মন্দিরটি বর্তমানে প্রায় বিলুপ্তির পথে। তবে এর ভাঙ্গা স্তূপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আছে বহু কিংবদন্তি ও অলীক কাহিনি। এক সময়ের দৃষ্টিনন্দন এই মন্দিরের এখন শুধু কিছু ইটের টুকরো, বিক্ষিপ্ত দেয়াল ও মেঝের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট রয়েছে। কথিত আছে, এই গ্রামের এক সময়ের সমৃদ্ধিশালী বরেন্দ্র কায়স্থবংশীয় রায় পরিবারের গোবিন্দরাম রায় নামক এক ব্যক্তি ব্যয়বহুল এই মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন। তবে এ নিয়ে ঐতিহাসিক ও গবেষকরা বিভিন্নভাবে মতপ্রকাশ করেছেন।

১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে রাধারমণ সাহা কর্তৃক প্রকাশিত পাবনা জেলার ইতিহাস গ্রন্থে মন্দিরটি প্রসঙ্গে লেখা আছে, ‘ইহা ইষ্টক ও পরিচূর্ণ দ্বারা নির্মিত ছিল। ইহা ত্রিতল বেদমন্দির ও প্রত্যেক তলে তিনটি প্রকোষ্ঠ বর্তমান ছিল। সর্বসমেত ৯টি প্রকোষ্ঠ বর্তমান থাকায় এর নাম নবরতœ মন্দির হয়েছে। এর গায়ে নানা প্রকার কারুকার্য ও নানারূপ দেবদেবীর মূর্তি খোদিত ছিল। বর্তমানে মন্দিরটি একেবাইে বিনষ্ট হলেও ওই সমুদয় শিল্পকর্মের নিদর্শন অদ্যাপি ইতস্ত বিক্ষিপ্ত ইষ্টকাবলীয় কার্যাদিতে প্রতীয়মান হয়। মন্দিরে রাধাবল্লভ নামক বিগ্রহ স্থাপিত ছিল। এখন পর্যন্ত এখানকার রায়বংশীয়গণের গৃহদেবতা স্বরূপে পূজিত। প্রথম তলে পূজোপকরণ সামগ্রী রক্ষিত হতো। দ্বিতীয় তলে পূজোক ও পরিচালকবৃন্দ বাস করিতেন। তৃতীয় বা সর্বোচ্চ তলে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত ছিল। ইহার তলদেশের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ উভয় দিকেই প্রায় ৬০ হাতের উপর ছিল। ইহার উচ্চতা এতই অধিক ছিল যে, বহুদূরবর্তী প্রদেশ হইতে তারা দৃষ্টিগোচর হইতো। অধুনা মন্দিরটি বিনষ্ট হইলেও ভগ্নাবশিষ্ট অংশের উচ্চতা ২৫ হাতের কম নহে।’

অন্যদিকে ভবানীনাথ রায় নামক এক লেখক তার ‘হিন্দু বিজ্ঞান সূত্র’ নামক গ্রন্থে এই মন্দির সম্পর্কে বর্ণনা দিয়েছেন, ‘ইহার উচ্চতা এত অধিক ছিল যে, জনপথে তৎকালীন বঙ্গের রাজধানী ঢাকা হইতে যাতায়াতকালে নবাব এই মন্দিরের চূড়া দেখতে পান এবং ঈর্ষাপরবশ হয়ে তা ভাঙার নির্দেশ দেন। মন্দির স্বামী পরিবারস্থ লোকেরা তার পূর্বাভাস বুঝতে পেরে সপরিবারে বিগ্রহসহ কিছুদিনের জন্য স্ব-গ্রাম ত্যাগ করিতে বাধ্য হন। মুসলমানগণ পোতাজিয়া আক্রমণ করে। তাদের কাউকে দেখতে না পেয়ে পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি লুণ্ঠন করত মন্দিরের মধ্যে হিন্দু ধর্ম বিগর্হিত কার্যাদি সম্পাদন করেন এবং অগ্নি প্রদানে সমস্ত বাটি ভস্মীভূত করেন। তদবধি মন্দিরটি হতশ্রী হইতে থাকে। ’

তবে ইতিহাস গবেষক আক্তার উদ্দিন মানিক এসব তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। সিরাজগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘উপরের বক্তব্যগুলি অনুমান মাত্র। এটাকে সত্য হিসাবে সর্বাংশে গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি নবরতœ মন্দিরের অস্তিত্ব রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দিনাজপুরের কান্তজী’র মন্দির, সিরাজগঞ্জের হাটিকুমড়–লের নবরতœ মন্দির এবং পোতাজিয়ার নবরতœ মন্দিরগুলো সবই নবাবী আমলে নির্মিত হয়েছিল। নবাবদের হিন্দু বংশীয় দেওয়ান বা জমিদারগণ ওই মন্দিরসমূহ নির্মাণ করেন। পোতাজিয়া নবরতœ মন্দিরটিও ওই সময়ের, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কথিত পোতাজিয়া নবরতœ মন্দিরের নির্মাতা গোবিন্দরাম রায় ঢাকার নবাবদের দেওয়ানরূপে কর্মরত ছিলেন। এরূপ কথাও উল্লেখিত রয়েছে। ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ যাতায়াত নৌকাপথে করতে গেলে পোতাজিয়া গ্রামটি কোনোভাবেই চোখে পড়ার কথা নয়। কারণ পোতাজিয়া গ্রামটি প্রত্যন্ত গ্রাম জনপদ। কোনোভাবেই এটা পদ্মা বা যমুনা নদীর যাত্রাপথে চোখে পড়ার কথা নয়। আরও দুই একজন লেখক এই নবরতœ মন্দির সম্পর্কে নানা মন্তব্য করলেও এর ধ্বংসের প্রকৃত কোনো কারণ আজ পর্যন্ত জানা যায় না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভূমিকম্প বা কোনো দস্যুদলের আক্রমণেও এই নির্মাণটি ধ্বংস হতে পারে বলে এরূপ অনুমান করাই যথাযথ বলে মনে হয়।’(তথ্যসূত্র : সিরাজগঞ্জ জেলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থ )

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist