বিনোদন প্রতিবেদক

  ০৮ জুলাই, ২০২০

প্লে-ব্যাক সম্রাটের গল্প...

১৯৫৫ সালের ৪ নভেম্বর রাজশাহীতে জন্ম প্লে-ব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোরের। গুরু আবদুল আজিজ বাচ্চুর অধীনে প্রাথমিকভাবে সংগীতে তালিম নেন তিনি। গেয়েছেন নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, আধুনিক, লোক ও দেশাত্মবোধক গান। বেতারের তালিকাভুক্ত শিল্পী হিসেবে পেশাদার গানের ভুবনে প্রবেশ তার। চলচ্চিত্রে প্লে-ব্যাক শুরু করেন ১৯৭৭ সালে আলম খানের সুরে ‘তুফান মেইল’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে। এরপর প্রতীক্ষা, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনীর পর নিজের ক্যারিয়ারের শুভসূচনা হয় ১৯৮২ সালে ‘বড় ভালো লোক ছিল’ সিনেমা দিয়ে। এ সিনেমার ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুশ’-এর জনপ্রিয়তার পাশাপাশি প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। কিংবদন্তি সুরকার আলম খানও এই সিনেমা দিয়ে প্রথম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। এই জুটির আরেক সাড়াজাগানো গান ‘তুমি যেখানে আমি সেখানে’। ‘আমার সারা দেহ খেয়ে গো মাটি থেকে আমার বুকের মধ্যিখানে’ গান বেজে উঠলেই মনে পড়ে যায় জাফর ইকবালের ‘নয়নের আলো’ সিনেমার কথা। বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা জনপ্রিয় গানের এই সিনেমার প্রতিটি গান ব্যাপক সাড়া ফেলে। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের কথা ও সুরে এই সিনেমার সব কয়েকটি গানে কণ্ঠ দেন এন্ড্রু কিশোর। জাফর ইকবালের লিপে এন্ড্রু কিশোর আরেক জনপ্রিয় গান ‘চাঁদের সাথে আমি দেবো না তোমার তুলনা’। আশির দশকে ইলিয়াস কাঞ্চনের কণ্ঠে তিনি দারুণ মানিয়ে নিয়েছেন, এই জুটি অসংখ্য জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন। সহযাত্রী সিনেমায় ‘পৃথিবীর যত সুখ’ থেকে ইন্ডাস্ট্রির সবচেয়ে ব্যবসাসফল সিনেমা ‘বেদের মেয়ে জোছনা’-এর সাড়াজাগানো টাইটেল গানটিও গেয়েছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এ ছাড়া ‘ভাই বন্ধু’ সিনেমার ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’ গানটি তো রয়েছেই, তবে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় বিখ্যাত সিনেমা ভেজা চোখ-এর ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’ গানটির কথা। বাংলা চলচ্চিত্রে সংগীতের দিক দিয়ে আরেক যুগান্তকারী সিনেমা ‘দুই জীবন’। জাতীয় পুরস্কারজয়ী এই সিনেমার জনপ্রিয় গান ‘আমি এক দিন তোমাকে না দেখলে’ থেকে শ্রুতিমধুর গান ‘তুমি আজ কথা দিয়েছো’ গান কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন এন্ড্রু কিশোর। এন্ড্রু কিশোর ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান ‘স্যারেন্ডার’ সিনেমার ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ গানটা গেয়ে। ‘ভালোবেসে গেলাম শুধু ভালোবাসা পেলাম না, তুমি আমার কত চেনা, তুমি আরো কাছে আসিয়া’Ñ আলমগীর অভিনীত অন্যতম এই সেরা গানগুলোও গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। আলমগীরের ঠোঁটেই ‘ক্ষতিপূরণ’ সিনেমার ‘এই দুটি ছোট্ট হাতে’র জন্য তৃতীয় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান এই গায়ক।

নব্বই দশকেও এন্ড্রু কিশোর ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় গায়ক। ‘অনুতপ্ত’ সিনেমার ‘তুমি এসেছিলে পরশু’ থেকে ‘বিয়ের ফুল’ সিনেমার ‘তোমায় দেখলে মনে হয়’-এর মতো জনপ্রিয় গানগুলো কণ্ঠে ধারণ করেছেন তিনি। সালমান শাহর ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমার ‘এইখানে দুইজনে নির্জনে’ থেকে ‘আনন্দ অশ্রু’র ‘তুমি মোর জীবনের ভাবনা’ গানগুলো আজও জনপ্রিয়। ‘স্বপ্নের ঠিকানা’র গানগুলো বেশ সাড়া জাগিয়েছিল। তবে এরমধ্যে ‘তোমাকে চাই’ সিনেমার রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর কথায় আহমেদ ইমতিয়াক বুলবুলের সুরে এন্ড্রু কিশোরের কণ্ঠে ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ গানটি আজও সমান জনপ্রিয়।

ওমর সানী ও পপি অভিনীত কুলি সিনেমার ‘আকাশেতে লক্ষ তারা চাঁদ কিন্তু একটাই’ এই গান এন্ড্রু কিশোরে ক্যারিয়ারে আরেক হিট গান। চিত্রনায়ক রিয়াজের ‘প্রাণের চেয়ে প্রিয়’ সিনেমার ‘পড়ে না চোখের পলক’ গানটিও এন্ড্রু কিশোরের গাওয়া। এ ছাড়া ‘তুমি হাজার ফুলের মাঝে’, ‘তুমি চাঁদের জোছনা নও’, ‘ঘুমিয়ে থাকো গো স্বজনী’, ‘না বলো না’ তো রয়েছেই। শাকিব খানের ক্যারিয়ারে জনপ্রিয় গান ‘আমার হৃদয় একটা আয়না’র গায়কও এন্ড্রু কিশোর। এ ছাড়া ‘কিছু কিছু মানুষের জীবনে’, ‘এক বিন্দু ভালোবাসা দাও’র মতো জনপ্রিয় গানও রয়েছে। এন্ড্রু কিশোর সর্বশেষ জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন শাকিব অভিনীত ‘কি জাদু করিলা’ সিনেমার ‘চক্ষু দুইটা কাজল কালো’ গানের জন্য।

প্লে-ব্যাকের বাইরে এসে নিয়মিত অ্যালব্যাম, টেলিভিশনেও নিয়মিত গান করতেন এন্ড্রু কিশোর। জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে তার প্রথম গান ‘পদ্ম পাতার পানি নয়’। পরবর্তীতে সংগীতবিষয়ক রিয়্যালিটি শোর বিচারকও হয়েছেন। প্লেব্যাকে রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমীন ও কনকচাঁপার সঙ্গে জুটি বেঁধে অসংখ্য জনপ্রিয় গান গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। সুরকারদের মধ্যে আলম খান ও আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সঙ্গে বেশি কাজ করেছেন। এ ছাড়া আলাউদ্দিন আলী, শেখ সাদী খান থেকে ইমন সাহা সবার সঙ্গে কাজ করে গেছেন তিনি।

১৯৮৬ সালে রাজেশ খান্না ও শাবানা অভিনীত বাংলাদেশ-ভারত যৌথ প্রযোজনার প্রমোদ চক্রবর্তীর পরিচালনায় ‘শত্রু’ সিনেমায়ও গান গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। এ ছবির গানের সুর করেছেন ভারতের খ্যাতিনামা সুরকার আর ডি বর্মন। গানগুলো রেকর্ডিংয়ের সময় স্বয়ং আশা ভোঁসলে হাজির হন স্টুডিওতে। গান দুটি হলোÑ ‘ম্যায় তেরা বিসমিল হু’ ও ‘সুরাজ চান্দা সাগার’। গান দুটি বাংলা ভার্সনেও গেয়েছেন এন্ড্রু কিশোর। গীতিকার হিসেবে গাজী মাজহারুল আনোয়ার, মনিরুজ্জামান মনির, মো. রফিকুজ্জামান থেকে কবির বকুল অনেকের লেখা গানই গেয়েছেন। দেশের গন্ডি পেরিয়ে কলকাতায়ও প্লেব্যাকে বেশ কয়েকটি গান করেছেন। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে উনি সেরা গায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন, পাঁচবার বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি (বাচসাস) পুরস্কার, মেরিল প্রথম আলো পুরস্কারসহ দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। গত বছরের ৯ সেপ্টেম্বর উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর যান এন্ড্রু কিশোর। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গত ১৮ সেপ্টেম্বর তার শরীরে নন-হজকিন লিম্ফোমা নামক ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়ে। এরপর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক লিম সুন থাইয়ের অধীনে তার চিকিৎসা শুরু হয়। সেখানে দীর্ঘ নয় মাস চিকিৎসা শেষে গত ১১ জুন দেশে ফেরেন তিনি। এরপর রাজধানীর মিরপুরের বাসায় কয়েক দিন থাকার পর নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য গ্রামের বাড়ি রাজশাহীতে যান।

রোববার থেকে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। রাজশাহীতেই তার চিকিৎসা চলছিল। এরপর তার শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হলে সোমবার দুপুরে বাড়িতে রেখেই তাকে অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়। এরপর সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে এপারের মায়া কাটিয়ে ওপারে পাড়ি জমালেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাক সম্রাট এন্ড্রু কিশোর।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close