মনসুর হেলাল
৪৫ বছরে ‘অনঙ্গ বউ’
অস্কারজয়ী চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়। তার ট্রিলজি চলচ্চিত্র পথের পাঁচালি, অপুর সংসার ও অশনিসংকেত। এ ধারার শেষ ছবি অশনিসংকেত। কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি ১৯৭৩ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তি পায়। ইতোমধ্যে ছবিটি মুক্তির ৪৫ বছর পূর্ণ হয়েছে। এই ছবির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ‘অনঙ্গ বউ’। যে চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলাদেশের নন্দিত অভিনেত্রী ববিতা। অশনিসংকেত ছবিতে ববিতার বিপরীতে ছিলেন আরেক কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। এই ছবির মাধ্যমেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রাঙ্গনে ববিতার প্রবেশ।
এ প্রসঙ্গে ববিতা বলেন, ‘সত্যি বলতে কী, অশনিসংকেত ছবিটি এখনো আমার জন্য গর্বের বিষয়। কারণ, এ ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে আমি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিতি লাভ করেছি। অভিনয় দিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলাম চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কাছে। অশনিসংকেতে সেই অনঙ্গ বউ চরিত্রের কথা এলেই নাম আসত বাংলাদেশের অভিনেত্রী ববিতার কথা। আমার নামে আগে আসত আমার দেশের নাম, সে জন্য অশনিসংকেত আমার প্রিয় চলচ্চিত্রের একটি। আর চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য আমি সর্বভারতীয় শ্রেষ্ঠ নায়িকার পুরস্কারও পাই।’
১৯৭২ সালে ‘অশনিসংকেত’ নামে একটি যুদ্ধবিরোধী ছবি বানানোর পরিকল্পনা করেন সত্যজিৎ। তবে ছবিটির জন্য পছন্দের নায়িকা পাচ্ছিলেন না। এমনই একসময় তিনি ববিতা সম্বন্ধে খোঁজখবর নেন। তার ছবি তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতীয় ক্যামেরাম্যান নিমাই ঘোষ বাংলাদেশে আসেন। নিমাই ঢাকায় এসে ববিতার অন্তত ২০০ ছবি তুলে নিয়ে গেলেন। কিছুদিন পর ‘অশনিসংকেত’ ছবিতে ববিতার প্রাথমিক মনোনয়নের খবর জানিয়ে ভারতীয় হাইকমিশন থেকে চিঠি এলো। সুচন্দাকে সঙ্গে নিয়ে ববিতা ভারত গেলেন সত্যজিতের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি ববিতাকে প্রথম দেখে অনেক লাজুক ভেবেছিলেন। তাই ইন্দ্রপুরের স্টুডিওতে তার আরেকটি পরীক্ষা নেওয়া হলো। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সত্যজিৎ বললেন, ‘আই অ্যাম সো হ্যাপি। আমি অনঙ্গ বউ পেয়ে গেছি।’ ছবি তৈরি হলো। বাংলাদেশ ছাড়িয়ে ববিতার নাম ছড়িয়ে পড়ল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে।
ববিতা বলেন, ‘এই ছবির জন্য বেশ কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেছি। কিন্তু সবচেয়ে বড় অর্জন, সত্যজিতের একটি উক্তি। ছবিটিতে আমার অভিনয় দেখে তিনি বলেছিলেন, আমি তার মতো এত ভালো অভিনেত্রী এর আগে দেখিনি। এর চেয়ে বড় অর্জন আমার জন্য আর কী হতে পারে!’
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ববিতা বলেন, ‘তার ছবিতে কাজ করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা। তিনি কখনো রোদে শুটিং করতেন না। সেটগুলো এমনভাবে সাজাতেন যেন সবকিছু জীবন্ত। কেউ কিছু না পারলে শান্তভাবে বলতেন, তোমার কাজ ভালো হয়েছে, তবে আমি আবার শট নিতে চাই। তিনি সিনেমাটোগ্রাফিরকাজ করতেন খুব যতœ করে। নিজেই ক্যামেরা চালাতেন এবং স্ক্রিপ্টের ডান পাশে শটের ছবি এঁকে রাখতেন।’
অন্যদিকে, কলকাতার টেলি-সিনে অ্যাওয়ার্ডের ১৭তম আসরে অভিনেত্রী ববিতাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়েছে। ‘অশনিসংকেত’ মুক্তির ৪৫ বছর পর গতকাল কলকাতার নজরুল মঞ্চে ববিতার হাতে এই সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়। এ বিষয়ে টেলি-সিনে অ্যাওয়ার্ডের জেনারেল সেক্রেটারি মৃন্ময় কাঞ্জিলাল জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের চলচ্চিত্রে বিশেষ অবদান রাখার জন্যই ববিতাকে এই সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে সম্মাননার জন্য নির্বাচিত করায় সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানান ববিতা। এ ব্যাপারে উচ্ছ্বসিত ববিতা বলেন, ‘এই সম্মাননাটি যেন আমার জীবনে অশনিসংকেতের ভূমিকা আরো পরিপূর্ণ করে তুলেছে।’
"