শাশ্বত নিপ্পন
গল্প
একটি শবযাত্রা ও বৃষ্টিভেজা কান্না
‘বল হরি, হরি বল’, ‘বল হরি, হরি বল...’ কর্পূর আর ধূপকাঠির উৎকট গন্ধ বাতাসে ছড়াতে ছড়াতে শবযাত্রাটি এগিয়ে চলেছে। খাটিয়া বাহকেরা পা ফেলছে ছন্দময় গতিতে। খাটিয়ার সঙ্গে কীর্তনের একটা ছোট দল। কেউ কথা বলছে না। ব্যস্ত পথচারীরা স্বেচ্ছায় পথ ছেড়ে দাঁড়াচ্ছে। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে খাটিয়ার দিকে তাকাচ্ছে কেউ কেউ। শবযাত্রায় মানুষের কৌতূহল বেশি। আর সেই কৌতূহলের কারণেই নিজেদের মধ্যে কথা বলে ওরা,
কে মরল গো?
হিন্দু।
পুড়াবে নাকি মাটি দেবে?
মনে হয় পুড়াবে।
ইস! কষ্ট হবে না মুর্দার?
কেউবা কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করেই বসে, ‘কে মারা গেল গো?’ খাটিয়া বাহকেরা কথা বলে না। এমন ভাব করে যেন মৃত ব্যক্তির নাম নিতে নেই। তার পরও কেউ উত্তর দেয়,
হরদয়াল।
কোন পাড়ার?
ঐ কৈবর্ত পাড়ার হরদয়াল, দয়লা বুড়ো।
প্রশ্নকর্তা মুখ দিয়ে দুঃখ প্রকাশক শব্দ করে আর এই পার্থিব জগতের কুকর্মের ফলে পরকালের শাস্তির কথা ভেবে শিহরিত হয়ে ওঠে। শ্মশান বন্ধুরা সমস্বরে চিৎকার করে ওঠে, ‘বল হরি, হরি বল ...’
বলতে বলতে খাটিয়া বাহকেরা কাঁধ বদল করে। সে কারণে কাঁচা বাঁশের খাটিয়ার ওপর দুলে ওঠে হরদয়ালের আশি বছর বয়স্ক শরীরটা। দলটি প্রায় শ্মশানের কাছে চলে এসেছে। সকাল থেকে আজ ভীষণ গরম। আবহাওয়াটা কেমন যেন ভ্যাপসা আর নোনতা নোনতা। এর মধ্যেই জীবনের ওপারে চলে গেল হরদয়াল। তার তিন ছেলে ও তাদের সংসারের মাথায় হঠাৎ-ই আকাশটা ভেঙে পড়ল চৌচির হয়ে। তাদের বাবার জীবনে বড় সাধ ছিল, তাকে পৌর শ্মশানে দাহ করা হোক; তার শরীরটা বড়লোকের শরীরের মতো গন্ধ সাবান আর ঘি দিয়ে ¯œান দেওয়া হোক; একখ- চন্দন কাঠ দেওয়া হোক তার চিতায়। হরদয়াল তার জীবদ্দশায় যতবার অন্যদের শবযাত্রায় শ্মশানে এসেছে, ততবারই এসব দেখেছে আর মনে মনে এই ইচ্ছের গাছটাকে সযতেœ লালন করেছে। তারই অংশ হিসেবে হরদয়াল তার বাড়ির পেছনে একটা বাবলা গাছ লাগিয়েছিল। লক্ষ্য একটাই, মরার সময় এই গাছ বন্ধক দিয়ে কাঠগোলা থেকে যেন ছেলেরা ১২-১৪ মণ কাঠ নিতে পারে। এখন সেই বাবলা গাছ মস্ত বড় হয়েছে। দিগি¦জয়ী বীরের মতো মাথা উঁচিয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে বাতাসে দুলছে।
হরদয়ালের তিন ছেলে আর এক মেয়ে। লক্ষণ, সুভাষ আর বাদল; মেয়ে খেতুরী। সবাই দিন আনে দিন খায়। তাই এদের কাছে মৃত্যু যতটা শোকের তার চেয়ে অনেক বেশি বিড়ম্বনার। অথচ মৃত্যু ওসব তোয়াক্কা করে না, সে আসেই। লক্ষণের বাবা হরদয়াল মারা যায় আজ দুপুরে। আত্মীয়স্বজনকে খবর দেওয়া, শ্মশান বন্ধুদের অনুরোধ করে নিয়ে আসা, বাবার লাগানো বাবলা গাছ বন্ধক দিয়ে তেরো মণ কাঠ জোগাড় করাসহ নানা কাজ শেষ করে তার বাবার নিঃসাড় দেহটা নিয়ে শ্মশানের পথে রওনা হতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গেল। কীর্তনের সুরে হরদয়ালের দেহ ভাসতে ভাসতে ব্রজধামের উদ্দেশে, এখন প্রায় শ্মশানের কাছাকাছি। ভ্যাপসা গরমে সবাই ক্লান্ত, তবুও মাঝে মাঝে তাদের কেউ কেউ তারস্বরে ‘হরি’ ধ্বনি দিচ্ছে আর এতে যে ছন্দপতন ঘটছে তাতে কাঁচা বাঁশের খাটিয়াতে শুয়ে থাকা হরদয়ালের প্রাণহীন দেহটা সামান্য দুলে দুলে উঠছে। কিন্তু হঠাৎ-ই সবকিছু যেন পাল্টে গেল। আকাশের দক্ষিণ-পূর্ব কোণ ছেয়ে গেল কালো মেঘে। কেউ যেন জাদুকরী শক্তিতে আকাশের এই পাশটা ঢেকে দিল কালো রেশমি উলের চাদরে। সঙ্গে দমকা বাতাস। রাস্তার উত্তপ্ত ধুলো ওড়ে এসে একমুহূর্তে খাটিয়া বাহকসহ শ্মশান বন্ধুদের চোখ-মুখ অন্ধকার করে দিল। ছন্দপতন হলো কীর্তনের সুরে ও তালে। খাটিয়া বাহকদের চলার ছন্দ হারিয়ে গেল মুহূর্তে। আর তাতেই বেশ প্রবলভাবে দুলে উঠল খাটিয়ায় শুয়ে থাকা হরদয়ালের জীর্ণ নিঃসাড় দেহটা।
অনেক অনুনয়ে শবযাত্রায় যোগ দেয়া সিদ্ধেশ্বরী মন্দিরের পুরোহিত শ্রীযুক্ত বাবু গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “আজ প্রত্যুষ থেকেই অন্তরাত্মায় ‘কু’ ডাকছিল। আর এসব পারমার্থিক কার্যাবলিতে ত্রুটি থাকলে শাস্ত্রহানি হয়।” পুরোহিত মশাইয়ের কথাতে উপস্থিত সকলে আতঙ্কিত হয়। হরদয়ালের মৃত্যু-পরবর্তী ক্রিয়াকলাপের জন্য একে অন্যকে দোষারোপ করে, আর পরম করুণাময়ের কাছে তারা ক্ষমা ভিক্ষা করে মনে মনে। অসময়ে এই দুর্যোগের আয়োজন দেখে হরদয়ালের শ্মশানযাত্রায় সমবেত কৈবর্তপাড়ার শ্রমজীবী মানুষগুলোর কাছে শাস্ত্রজ্ঞ পুরোহিত মশাইয়ের এই বাণীকে অমোঘ বলেই মনে হয়। তাদের মনে হয়, নিশ্চয়ই কোনো কাজে ত্রুটি ছিল এই পরিবারের! এর মাঝেই কেউ একজন চিৎকার করে, ‘বল হরি...’। কিন্তু উত্তর মেলে না। দমকা বাতাসের বেগ বাড়তে থাকে, সঙ্গে বৃষ্টির গন্ধ। উপস্থিত সবার ঘর্মাক্ত দেহে হিমেল পরশ খুবই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। শারীরিক স্বস্তি ফিরে আসে। দেখতে দেখতে কালো মেঘে পুরো আকাশটাকে ছেয়ে ফেলল। আর বড় বড় ফোঁটায় শুরু হলো বৃষ্টি। ক্রমেই সে বৃষ্টি প্রবল বৃষ্টিতে রূপ নিল। মুষলধারায় রূপ নেওয়ার অনেক আগেই ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে হরদয়ালের শ্মশান বন্ধুরা। যে যার মতো সরে গিয়েছে বৃষ্টি শুরু হতে না হতেই। এতে তাদের দোষ নেই মোটেও। কৈবর্তপাড়ার সব পুরুষই শ্রমজীবী। কেউ মাছ ধরে নয়তো কেউ মাছের আড়তে কাজ করে। লক্ষণরা তিন ভাই তাদের নানা অনুরোধ করে বাবার শবযাত্রার সঙ্গী করেছে। অনুরোধে আসা বন্ধুরা এত হ্যাপা সহ্য করবেই বা কেন! প্রথমেই সরে গেছে কীর্তন দল, তাদের ‘শ্রী খোলে’ বৃষ্টির জল ঠেকলে খোলের চামড়া নরম হয়ে যাবে। তারপর পুরোহিত মশাই এবং অন্যরা। এখন একটা বড় কড়ই গাছের নিচে হরদয়ালের খাটিয়া রেখে লক্ষণরা তিন ভাই বসে আছে অসহায়ভাবে। আর গাছটিও যেন তার শতবর্ষী দেহটা দিয়ে ওদের আগলাতে চাচ্ছে প্রাণপণে।
হিন্দুর লাশ অন্য কারো বাড়িতে নিয়ে রাখাও যাচ্ছে না! লক্ষণরা ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। ইতোমধ্যে বৃষ্টি আরো আয়োজন করে বসেছে। থামার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই। কড়ই গাছের সবুজ ঘন পাতার ফাঁক গলে দু-এক ফোঁটা বৃষ্টির জল পড়তে শুরু করেছে হরদয়ালের ঠান্ডা হয়ে যাওয়া শরীরে। বাদল অসহায় ভঙ্গিতে ওপরের দিকে তাকায়। অদ্ভুতভাবে গাছটা দাঁড়িয়ে আছে। শূন্যতাকে ভেদ করে গাছটা তার দেহপল্লব নিয়ে উঠে গেছে বেয়াড়ার মতো। চাঁদের ¯িœগ্ধ আলো আর বৃষ্টির ধারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গাছটির সারা শরীরটা উজ্জ্বল করে তুলেছে। কড়ই গাছের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাতাগুলো ক্রমাগত কাঁপছে বৃষ্টির ফোঁটার আঘাতে, তবু তারা নির্ঘুম চেষ্টা করে চলেছে অসহায় আশ্রিতদের এই প্রলয়ের হাত থেকে বাঁচানোর। মাথার ওপরের শূন্যতার দিকে তাকিয়ে এই নিষ্ঠুর চরাচরে এই গাছটিকে বাদলের বড় আপনজন মনে হয়। মনে হয়, তার মাথার ওপরের শূন্যতা, কড়ই গাছটার ওপরেও শূন্যতা। শূন্যতা সমগ্রজুড়ে; এর যেন কোনো শেষ নেই! সুভাষ তার ঘাড়ের জীর্ণ গামছাটা বাবার মুখের ওপর দিয়ে দেয়। অন্তত মুখ যেন না ভেজে ...
চারপাশে ঝুম অন্ধকারের আভাস দিচ্ছে ঝিঁ ঝিঁ পোকার দল। হঠাৎই মনটা বড় উচাটন হয়ে ওঠে লক্ষণের, সেই সঙ্গে বিড়ির তেষ্টাটাও চনমনিয়ে ওঠে। কিন্তু বাবার লাশের পাশে বসে বিড়ি খাওয়া ঠিক সমীচীন হবে কি না ভেবে, বিড়ির ইচ্ছেটা প্রকাশ করতে সংকোচ করে সে। যদিও বাবার সামনেই বিড়ি খেত সে, এখন সংকোচ হচ্ছে। মনে হয় লাশের একটা অন্যরকম আবেদন আছে, আছে অব্যক্ত ভাষা। আরো কিছুটা গুমোট সময় ধীর পায়ে ঝিঁ ঝিঁ পোকার তীব্র আর্তনাদের মধ্যদিয়ে বিদায় নেয়। বৃষ্টির জল কড়ই গাছের ঘন পাতায় বাধা মানছে না আর। বাদল ইতোমধ্যে কয়েকটা মানকচুর পাতা নিয়ে এসে তার বাবার দেহটা ঢেকে দিয়েছে নিঃশব্দে। হঠাৎ কড় কড় কড়াৎ শব্দে কোথায় যেন বাজ পড়ে। বাজ পড়ার আগে চারদিক নীলচে আলোয় আলোকিত হয়ে যায়। লক্ষণ, সুভাষ আর বাদল একসঙ্গে কেঁপে ওঠে। লক্ষণ যেন একটু বেশি ভয় পায়। সে ভয়ের চোটে বাবার খাটিয়ার এক প্রান্ত চেপে ধরে, যেন মৃত বাবার কোলে আশ্রয় খুঁজতে চায়। লক্ষণের মনে পড়ে, বেশ ভিতু ছিল সে ছেলেবেলায়। বাবা তাকে সাহস দিত। নিজ হাতে সে লক্ষণকে সাঁতার শিখিয়েছেÑ ভৈরবের জলে পড়ে লক্ষণ যখন নাকানি-চুবানি খেত; বাবা তখন হাসতে হাসতে তাকে তুলে আনত। বাবাই তাকে শিখিয়েছে মরা সাঁতার, ডুব সাঁতার, গাছে চড়া, নৌকা বাওয়া, জাল ফেলা...
শুধু তাকে কেন, সুভাষ-বাদলকেও বাবাই একটু একটু করে বড় করে তুলেছে পরম মমতায়। ছেলেবেলায় বাবাই ছিল তাদের আশ্রয়। কিন্তু আজ লক্ষণরা তিন ভাই মিলে তাদের বাবাকে নিয়ে আশ্রয়হীন। আজ দীর্ঘদিন তিন ভাইয়ের মধ্যে কথা হয় না। সামান্য ছয় হাত জমিকে কেন্দ্র করে তিন ভাই আজ পর। প্রায়ই সুভাষ লাঠি নিয়ে তেড়ে আসে লক্ষণের দিকে। লক্ষণও তৈরি থাকে চকচকে দা হাতে নিয়ে। আর বৌগুলো চিল্লাতে থাকে, খিস্তি করে। একে অপরকে সতীনের মতো দেখে। কেউ কারো মুখ দেখে না। অথচ ছেলেবেলায় ফলসা গাছে লক্ষণ উঠত; জাম গাছে লক্ষণই উঠতÑআর সুভাষ বাদল থাকত নিচে। পাকা পেয়ারাটা সে কখনো সুভাষকে কখনো-বা বাদলকে দিত। সামান্য দূরের অতীতগুলো কত প্রাণোচ্ছল ছিল। লক্ষণ আর থাকতে পারে না। বুকের মাঝটা কেন জানি হাহাকার করে ওঠে। লক্ষণ আকুল কণ্ঠে বলে, ‘তর কাছে এগডা বিড়ি হবে রে, সুভাষ?’ অবিশ্রান্ত বৃষ্টি পৃথিবী ভাসিয়ে দিচ্ছে। কোনো নিচু জায়গা দিয়ে বৃষ্টির জল নামতে থাকে হড় হড় করে আরো নিচের দিকে। গড়িয়ে যাওয়া জলের তোড়ে রাস্তায় পাশের মাটির নরম পাড় অসহায়ভাবে ভেঙে পড়ে। বৃষ্টিভেজা নরম মাটির গলায় সুভাষ উত্তর করে,
আগুন আছে?
হ্যাঁ।
তালি, জ্বালাও।
প্রায় ভিজে যাওয়া দেশলাইয়ের কাঠিতে মুখের ‘হায়’ দিয়ে দিয়ে সতেজ করে কোনোমতে বিড়িটা জ্বালায় লক্ষণ। তারপর দক্ষতার সঙ্গে বৃষ্টির জল আড়াল করে কায়দা করে ধরে টানতে থাকে। প্রতি টানে বিড়ির আগুন আরো উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আর বিড়ির আঁচে লক্ষণের ডান হাতের আঙুলগুলো হিটারের তারের মতো লাল হয়ে ওঠে। জ্বলজ্বলে সে আগুনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাদল। সেও বিড়ি খায়। কিন্তু তার বিড়ির নেশা কেন যেন এখন জাগছে না। বাদল ভাবছে অন্য কথা, তার বাবা মারা গেছে দুপুরের আগে। এখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। নিশ্চয় বাবার শরীর পচতে শুরু করেছে। কিন্তু সে কোনো দুর্গন্ধ পাচ্ছে না কেন? বাবার শরীরপচা গন্ধ কি সন্তানের নাকে লাগে না! এদিকে বাজ পড়ার পর বৃষ্টিটা সামান্য কম হলেও এখন আবার আগের অবস্থা। হরদয়ালের মুখে দেওয়া জীর্ণ গামছাটা সম্পূর্ণ ভিজে গেছে ইতোমধ্যে। বাদল সেদিকে তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। হঠাৎ বাদলের মনে পড়ে, ছেলেবেলায় খেলতে গিয়ে তার বাম চোখের পাশে কেটে গিয়েছিল। ক্ষতটা গভীর হয়েছিল। মনে আছে, বাবা তাকে বুকে চেপে দৌড় দিয়েছিল হাসপাতালে। বাবার ময়লা ফতুয়া বাদলের রক্তে সম্পূর্ণ লাল হয়ে গিয়েছিল। তিনটে সেলাই দিয়েছিল গোলাম কম্পাউন্ডার। মনে আছে, রাতে বাবা পাউরুটি আর লজেন্স দিয়ে বাদলের ব্যথা ভুলিয়েছিল। মুহূর্তে বাদলের মনে হয়, তার বাবা নেই। তার বাবা মরেছে অনেকক্ষণ। আর এখনো সে তার বাবার সৎকার করতে পারেনি। মুষলধারে বৃষ্টির মধ্যে একটা কড়ই গাছের নিচে বাবার মৃতদেহ নিয়ে বসে আছে সে আর তার দুই ভাই। মনে হতেই সবার অলক্ষ্যে বাদল খাটিয়াটা ছোঁয়। আর মুহূর্তেই বাদলের বুকের মাঝটা হাহাকার করে ওঠে।
বৃষ্টির এই মহাপ্লাবনে মশাদের এসেছে মহোৎসব। দু-তিনটে মশা বেশ কিছুক্ষণ ধরে সুভাষের কানের কাছে রাগাশ্রিত তান শুনিয়ে চলেছে। ইতোমধ্যে তার পা দুটোর জায়গায় জায়গায় ফুলিয়ে দিয়েছে। সুভাষও প্রাণপণে মশা মারার চেষ্টা করছে দুই হাত দিয়ে। বিড়িতে একটা লম্বা টান দিয়ে লক্ষণ কাশতে শুরু করে প্রাণপণে। তার কাশিতে চারপাশের জমাট নিস্তব্ধতা ভেঙে পড়ে। লক্ষণের দিকে তাকিয়ে পরম মমতায় সুভাষ বলে, ‘দাদা, তুমি বিড়ি ছাড়ান দ্যাও... বয়েস হয়িচে তো...’
বিরামহীন বৃষ্টির রাতে আকাশে মস্ত চাঁদ উঠেছে। সে চাঁদের গায়ে একটু জল লেগে নেই। চাঁদটাকে মনে হচ্ছে বৃষ্টিভেজা বিলে সদ্য ফোটা পদ্ম। আর সেই পদ্মফুলের গা থেকে বিচ্ছুরিত হচ্ছে গলিত সোনার মতো জোছনা। অবিশ্রান্ত জলের ধারার সঙ্গে একাকার হয়ে যাচ্ছে সে জোছনা। বৃষ্টিধোয়া জোছনা শুক্লাদ্বাদশীর চেয়েও তীব্র আর মায়াময় হয়ে উঠেছে।
সুভাষ নরম গলায় আবার ডেকে ওঠে, ‘দাদা, ও দাদা, বিড়িটা হবার ছাড়ান দ্যান; বয়েস হয়িচে তো...
লক্ষণের মনে হয় বহু দূর পাড়ের কেউ তাকে ডাকছে, ‘ও দাদা’, ‘ও দাদা’ ... পেয়ারা, জাম, ফলশা আর পাকা বন কাঁঠালের গন্ধ মেশানো সে ডাক। তার মনে হয়, আজ অনেক বছর পর সুভাষ তাকে দাদা বলে ডাকল। লক্ষণের বুকটা আবার হাহাকার করে ওঠে। খুব ইচ্ছে হয় ভাইটাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে। ‘গুড়–ম’ ‘গুড়–ম’ করে মেঘ গর্জে ওঠে। লক্ষণের বুকের এক দলা বাষ্প গলার কাছে এসে আটকে যায়। হঠাৎ বাদল ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘বাবা..., বাবা গো..., বা...বা...’
ভাইদের মধ্যে সে-ই সবচেয়ে জোয়ান আর সাহসী। দুই ভাইকে অবাক করে সে কেঁদে ওঠে। কান্না সংক্রামক, সহজেই অন্য সবাইকে ভিজিয়ে তোলে। লক্ষণের মনে হয়, বাবার মরার পর তারা সেভাবে কেউ কাঁদেনি। আর পাঁচজনের মতো গলা ছেড়ে মৃত বাবার জন্য বিলাপ করেনি। কথাটা মনে হতেই একটা অপরাধবোধ তাকে গ্রাস করে। তারপর বৃষ্টির ছন্দ, আকাশের গর্জন আর ঝিঁ ঝিঁ পোকার সম্মিলিত কলতানকে তুচ্ছ করে লক্ষণ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে, ‘বাবা গো... বা... বা... গো...’ সুভাষ, বাদল আর লক্ষণের কান্না মিলেমিশে একটা কান্নায় পরিণত হয়। ওদের কান্নার শব্দটা বুনোদের পেতে রাখা ধরা ফাঁদে আটকাপড়া ক্লান্ত পশুর গোঙানির মতো শোনায়। বৃষ্টির জলের ছাঁটে এই অসহায় লোকগুলোর চোখের নোনাজল ধুয়ে যায়। তবুও তারা আশা ছাড়ে না। ওরা সবাই ক্রুদ্ধ হয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে। নিঃশব্দে তিন ভাইয়ের মধ্যে ঐক্য গড়ে ওঠে। দৃঢ় ইস্পাত কঠিন ঐক্য। বাবার অন্তিম ইচ্ছাপূরণে বদ্ধপরিকর হয় তারা। ঠিক তখনই আবার চারপাশ কাঁপিয়ে আকাশ গর্জে ওঠে। নীলচে উজ্জ্বল আলোয় চারপাশ প্লাবিত হয়।
বিকট শব্দ হওয়ার পর চারপাশটা আরো যেন নিবিড় নিস্তব্ধতার চাদরে ঢেকে যায়। ঝিঁ ঝিঁ পোকারা এমন নিস্তব্ধতায় আতঙ্কিত হয়ে হঠাৎ করেই স্তব্ধ হয়ে যায়। ক্রন্দনরত তিন ভাইও যেন স্তব্ধ হয়ে যায় নিজেদের অজান্তেই। তাদের কাছে মনে হয়, মুহূর্তের জন্য সমগ্র পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে গেছে। আর তখনই শব্দের মধ্যদিয়ে প্রাণের অস্তিত্ব প্রকাশ পায়। লক্ষণ চমকে সেই শব্দ অনুসরণ করে। সঙ্গে সুভাষও। সামনের ঝোপে দুটো জ্বলজ্বলে চোখ তাদের লক্ষ করছে অপলক। চাঁদের তীব্র আলোয় চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে। শিয়াল! বৃষ্টিতে সারা শরীর ভেজা। মানুষের শরীরপচা গন্ধে শিয়াল এসেছে খাদ্যের সন্ধানে। পচা শরীরের পাশে জীবন্ত মানুষ তাকে দ্বিধান্বিত করেছে। লতাপাতা সরিয়ে চেয়ে আছে অপলক, আর ভাবছে এখন তার কী করা উচিত! হিস হিস করে সুভাস বলে,
দাদা, শালা শিয়েল!
হ্যাঁ, শরীলপচা গন্ধে এয়েচে; খাতি।
আমাদের বাপের মাংস খাতি চাচ্ছে শিয়েলে; দাদা, ও দাদা!
সঙ্গে সঙ্গে বাদল তেড়ে ওঠে, ‘হুÑ যা শালা শিয়েল...যা...’ মুহূর্তে শরীরে বিদ্যুতের ঢেউ তুলে গুল্মলতার গভীরে হারিয়ে যায় ক্ষুধার্ত শিয়ালটা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ায় বাদল। দৃঢ়কণ্ঠে বলে, ‘চোখের সামনে বাপের শরীল শিয়েলে খাবে, তা হবে না, দাদা।’ বাদলের গলার স্বরযন্ত্রের মতো শোনায়। দুই ভাই চমকে ওঠে। নিজের ছোট ভাইকে অচেনা মনে হয় তাদের। বাদলের দৃঢ় কণ্ঠস্বর সুভাষ, লক্ষণকে সাহস দেয়। লক্ষণ উঠে দাঁড়ায়। সুভাষ বলে, ‘চোখের সামনে বাপের শরীর পোচপে না।’
বাদল আবার দৃঢ়স্বরে বলে, ওঠ দাদা, বাপকে চিতায় দেবই।
উঠে দাঁড়ায় লক্ষণ মুহূর্তেই। তারপর বলে, ‘খাটিয়া তোল, আমি একদিক ধরছি; তোরা দুজন পায়ের দিকটা ধর।’
তিন ভাই হরদয়ালের খাটিয়া তুলে নেয়। দৃঢ়চিত্তে শ্মশানের পথে পা বাড়ায়। বাদল চিৎকার দিয়ে ওঠে, বল হরি...
বাদলের চিৎকারে বৃষ্টিপতনের একঘেয়ে শব্দ চাপা পড়ে যায়। সুভাষ আর লক্ষণের মনে হয়, বৃষ্টিটা এখন বেশ ধরে এসেছে।
"