মাহবুবুল আলম
ঈদের তাৎপর্য ও আর্থসামাজিক গুরুত্ব
ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানে খুশি। এ কথা আমরা সবাই জানি। ঈদের সামাজিক অর্থ উৎসব আর আভিধানিক অর্থ পুনরাগমন বা বারবার ফিরে আসা। তাই প্রতি বছরই মুসলমানদের জীবনে ফিরে আসে খুশির ঈদ। প্রথমটি উদযাপিত হয় দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর। যাকে আমরা বলি ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ, আর অন্যটি আত্মত্যাগের কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা। এই দুটি ঈদই হলো মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। বাংলাদেশে ঈদের দিন দুটি খুবই জাঁকজমকের সঙ্গে উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়। সবাই এদিন যার যার সাধ্যানুযায়ী ভালো পোশাক পরে। ঘরে ঘরে উন্নত মানের খাবারের আয়োজন করে। আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এ আনন্দের অংশীদার হয়। দরিদ্র ও গরিবাও এদিনটিকে যথাযোগ্য মর্যাদা ও আনন্দের সঙ্গে পালন করে। মুসলমানরা এদিন কৃতজ্ঞচিত্তে খুতবাসহ ঈদের দুই রাকাত নামাজ আদায় করেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কুশলবিনিময় করেন। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলিসহ সালাম ও শুভেচ্ছার হাত বাড়িয়ে দেন। ঈদকার্ড বিনিময় একটি জনপিয় প্রথায় পরিণত হয়েছে। আর তথ্যপ্রযুক্তির এ উৎকর্ষতার যুগে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মাধ্যমেও আনন্দ-খুশি ও ঈদের আবেগ ভাগাভাগি করে থাকে। সমাজের ধনী ও সক্ষম ব্যক্তিরা নির্দিষ্ট হারে গরিবদের ফিতরা বা শর্তহীন অনুদান বিতরণ করে থাকেন, ধর্মীয় দিক থেকে ধনীদের জন্য যা বাধ্যতামূলক।
এই যে ঈদ, এই উৎসবের কিভাবে উদ্ভব হয়েছে, তার ইতিহাস ও তথ্য সঠিকভাবে আজও জানা যায়নি। নানা ইতিহাসগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক সূত্র ও তথ্য থেকে বাংলাদেশে রোজা পালন এবং ঈদুল ফিতর বা ঈদুল আজহা উদ্যাপনের যে ইতিহাস জানা যায়, তাতে ১২০৪ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গ দেশ মুসলিম অধিকারে এলেও এ দেশে নামাজ, রোজা ও ঈদোৎসবের প্রচলন হয়েছে তার বেশ আগে থেকেই। বঙ্গ দেশ যুদ্ধবিগ্রহের মাধ্যমে মুসলিম অধিকারে আসার বহু আগে থেকেই মধ্য ও পশ্চিম এশিয়া থেকে মুসলিম সুফি, দরবেশ ও সাধকরা ধর্ম প্রচারের লক্ষ্যে উত্তর ভারত হয়ে পূর্ব বাংলায় আসেন। অন্যদিকে আরবীয় এবং অন্যান্য মুসলিম দেশের বণিকরা চট্টগ্রাম নৌবন্দরের মাধ্যমেও বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। এভাবেই একটা মুসলিম সাংস্কৃতিক তথা ধর্মীয় প্রভাব পূর্ব বাংলায় পড়েছিল। ঢাকার ইতিহাসবিদ হাকিম হাবীবুর রহমান বলেছেন, ১৬৪০ খ্রি. বাংলার সুবেদার শাহ সুজার নির্দেশে তার প্রধান অমাত্য মীর আবুল কাসেম একটি ঈদগাহ
নির্মাণ করেন। এর দৈর্ঘ্য ছিল ২৪৫ ফুট ও প্রস্থ ১৩৭ ফুট। নির্মাণকালে ঈদগাটি ভূমি থেকে ১২ ফুট উঁচু করা হয়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর দিয়ে ঘিরে সেখানে মেহরাব ও মিনার নির্মাণ করা হয়। মুঘল আমলে দরবার, আদালত, বাজার ও সৈন্য ছাউনির কেন্দ্রে অবস্থিত ছিল এ ঈদগাহ। প্রথমদিকে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজন-বান্ধবরাই এখানে নামাজ পড়তে পারতেন। পরে ঈদগাহটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এই ঈদগাহর পাশে উনিশ শতকের শেষদিক থেকে একটি মেলারও আয়োজন করা হয়। এই ঈদগাহর পার্শ্বে একটি সুন্দর সেতুর চিহ্নও রয়েছে। ঈদগাহটি এখন সংরক্ষণ পুরাকীর্তি।
শামসুজ্জামান খান তার ‘বাংলায় ঈদ, বাঙালির ঈদ’ নিবন্ধে বলেছেন, ‘ঈদোৎসব শাস্ত্রীয় ইসলামের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। তবে দ্বাদশ শতকের বাংলায় ইসলাম এলেও চার-পাঁচশ বছর ধরে শাস্ত্রীয় ইসলামের অনুপুঙ্খ অনুসরণ যে হয়েছিল, তেমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। সেকালের বাংলায় ঈদোৎসবেও তেমন কোনো ঘটা লক্ষ করা যায় না। এর কারণ হয়তো দুটি : এক. গ্রামবাংলার মুসলমানরা ছিল দরিদ্র; এবং দুই. মুসলমানের মধ্যে স্বতন্ত্র কমিউনিটির বোধ তখনো তেমন প্রবল হয়নি। ফলে ধর্মীয় উৎসবকে একটা সামাজিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর অবস্থাও তখনো সৃষ্টি হয়নি। আর এটাতো জানা কথাই যে সংহত সামাজিক ভিত্তি ছাড়া কোনো উৎসবই প্রতিষ্ঠা লাভ করে না। বৃহৎ বাংলায় ঈদোৎসব তাই সপ্তদশ, অষ্টাদশ এমনকি উনবিংশ শতকেও তেমন দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়।
নবাব-বাদশারা ঈদোৎসব করতেন, তবে তা সীমিত ছিল অভিজাত ও উচ্চবিত্তের মধ্যে, সাধারণ মানুষের কাছে সামাজিক উৎসব হিসেবে ঈদের তেমন কোনো তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা ছিল না। তবে গোটা উনিশ শতক ধরে বাংলাদেশে যে ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন চলে তার প্রভাব বেশ ভালোভাবেই পড়েছে নগরজীবন ও গ্রামীণ অর্থবিত্তশালী বা শিক্ষিত সমাজের ওপর। মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাও এই চেতনাকে শক্তিশালী করেছে। আর তাই এই অনুকূল পরিবেশেই ইসলামীকরণ প্রক্রিয়া ধীরে ধীরে এক শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাকে কেন্দ্রে রেখে পরিচালিত বাংলাদেশ আন্দোলন এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার যে নবরূপায়ণ ঘটেছে তাতে ঈদোৎসব রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে নতুন গুরুত্ব পেয়েছে।’
আমেজের দিক থেকে পবিত্র ও স্নিগ্ধ, আচরণের দিক থেকে প্রীতি ও মিলনের উৎসব ঈদুল ফিতর। ইসলামের ধর্মীয় উৎসব হিসেবে ঈদুল ফিতরের আনুষ্ঠানিকতার দিকটি প্রধানত মুসলমানদের মধ্যেই সীমিত থাকে। তবে ইসলাম সাম্য-মৈত্রী, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম ও ঈদের অর্থ আনন্দ বিধায় প্রকারান্তরে ঈদ সব মানবের জন্যই কল্যাণ বয়ে আনে। জাতীয় জীবনে এর রূপময়তা সর্বত্র চোখে পড়ে। সবক্ষেত্রে এর ইতিবাচক প্রভাব অসাধারণ হয়ে ধরা দেয়। ভিন্ন ধর্মের মানুষও ঈদের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সুফল ভোগ করে। ঈদ উৎসবে গতানুগতিক জীবনধারার অধ্যাত্মবাদের সঙ্গে যোগ হয় প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ভিন্নমাত্রিক জীবনধারা। তাই ঈদের আর্থসামাজিক গুরুত্বও অপরিসীম। ঈদের সঙ্গে রমজানের আত্মশুদ্ধির কথাও বলা যেতে পারে। কারণ রোজার সঙ্গে ঈদের সম্পর্ক প্রত্যক্ষ। তাতে বদল হয়েছে ধর্মের অবিমিশ্র ও শুদ্ধ রূপেরও। যে কারণে বাংলাদেশের মুসলমানের সঙ্গে আরব, মধ্যপ্রাচ্য ও ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনচর্চা এক হলেও উৎসব অনুষ্ঠানে রকমফের সহজেই চোখে পড়ে। এর মুখ্য কারণ পোশাক-আশাক ও খাদ্যাভ্যাসে জাতীয় বৈশিষ্ট্য বিশেষভাবে প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের তো বটেই, বিশ্বের মুসলমানদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ। ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর সামাজিক তাৎপর্য ছাড়াও রয়েছে অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ও গুরুত্ব। ঈদ ও পূজা উপলক্ষে পোশাক ছাড়াও রয়েছে অন্যান্য কেনাকাটার প্রস্তুতি, অতিথি আপ্যায়নের ধুমধাম। শহরে আলো ঝলমলে, সুসজ্জিতকরণ প্রক্রিয়ায় ব্যস্ত থাকেন অনুষ্ঠানস্থলের আয়োজকবৃন্দ। সেই সঙ্গে ধর্মীয় সংস্কৃতির অনুষ্ঠানাদি, কার্ড বিতরণ, আলোচনা ও ঘনিষ্ঠজনদের সংশ্লিষ্টতা রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। উৎসবকেন্দ্রিক আয়োজন কম নয়। কে কত প্রতিযোগিতাপূর্ণভাবে সৌন্দর্য প্রদর্শন করতে পারে, বিনোদনের আয়োজনে সফল হতে পারে তার একটি প্রবণতা বা ঝোঁক লক্ষণীয় হয় ওঠে।
ঈদ সামনে রেখে প্রতিবারই ঈদের বাজার চাঙা হয়ে ওঠে, এতে একই সঙ্গে চাঙা হয়ে ওঠে দেশের অর্থনীতি। পুরো অর্থব্যবস্থা আবর্তিত হয় দেশের সবচেয়ে বড় এ ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে কেন্দ্র করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ঈদের বাজার প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা কমবেশি লেনদেন হয়েছে বলে অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতৃবৃন্দ মনে করেন। যা এ যাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ রেকর্ড হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা। দারিদ্র্য হ্রাস, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি এবং জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের ফলে ঈদকেন্দ্রিক লেনদেন প্রতি বছর বাড়ছে। ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স দেশে পাঠান। ঈদের সময় বৈদেশিক আয়ের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া গ্রামীণ অর্থনীতিও চাঙা হয়ে ওঠে। চাঙা হয়ে ওঠে ব্যাংক খাতও। এ উপলক্ষে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি লেনদেন হয়।
মুসলমানদের জীবনের ঈদের তাৎপর্য অনেক। ঈদ অর্থ খুশি এবং ফিতর এসেছে ফিতরা থেকে। সুতরাং ঈদুল ফিতরের অর্থ দাঁড়ায় দান-খয়রাতের মাধ্যমে পবিত্র ঈদের উৎসবকে আনন্দে উদ্ভাসিত করে তোলা। জাকাত-ফিতরার মাধ্যমে ধনী ও গরিবের মধ্যকার ভেদাভেদ দূরীভূত হয়। আর এতেই হয় মুসলিম হৃদয় উদ্বেলিত। ঈদুল ফিতরের যাবতীয় আনুষ্ঠানিকতায় পরস্পরের শুভেচ্ছা, আন্তরিকতা ও সহমর্মিতা বিনিময়ের মাধ্যমে মানবিক ও সামাজিক সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের সামাজিক তাৎপর্য। সমগ্র বিশ্বের প্রত্যেক মুসলমান যাতে ঈদুল ফিতরের আনন্দ উপভোগ করতে পারেন, সেজন্য রমজান মাসে বেশি হারে দান-খয়রাত, জাকাত ও ফিতরা প্রদানের কথা বলা হয়েছে। এটা হলো ঈদুল ফিতরের অর্থনৈতিক তাৎপর্য। ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, সাদা-কালো নির্বিশেষে একই কাতারে মিলিত হওয়া মানব সম্প্রীতির এক অনন্য নিদর্শন পবিত্র ঈদ। ঈদুল আজহাও এর ব্যতিক্রম নয়।
আজকের দিনে ঈদের প্রকৃত তাৎপর্য থেকে মানুষ অনেক দূরে সরে যাচ্ছে। কলহ-বিবাদ, হিংসা-বিদ্বেষের ফলে গোটা সমাজ তলিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান ঈদ নামমাত্র আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে। মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, ‘অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ ঈদের বাজারের দিকে তাকিয়ে দেখলেই বোঝা যায়; সবাই কেমন অসহনীয় প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। তারা অধিক মূল্যবান পোশাক-আশাকে সুসজ্জিত হয়ে সবার দৃষ্টিতে আকর্ষণের চেষ্টা করেন। পরিশেষে এই বলে শেষ করব, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন উম্মতে মোহাম্মদীকে সম্মানিত করে তাদের এ দুটো ঈদ দান করেছেন।
আর এ দুটো দিন বিশ্বে যত উৎসবের দিন ও শ্রেষ্ঠ দিন রয়েছে তার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ দিন ও সেরা ঈদ। ইসলামের এ দুটো উৎসবের দিন শুধু আনন্দ-ফুর্তির দিন নয়, বরং এদিন দুটোকে আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে সঙ্গে জগৎসমূহের প্রতিপালকের ইবাদত-বন্দেগি দ্বারা সুসজ্জিত করতে পারলেই ঈদের তাৎপর্য আরো বেশি উদ্ভাসিত হবে।
"