ফারিহা হোসেন
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’
বাঙালি জাতীয়তাবাদের আত্মকথন
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ জাতির অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনে বড় নিয়ামক হিসেবে আমাদের পথ প্রদর্শন করবে এবং শক্তি জোগাবে। তার জীবনকর্ম, দর্শন ও ধ্যানধারণা আমাদের জন্য পাথেয়। তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ জাতির জন্য এক অনন্য স্বপ্নের রূপরেখা এবং আত্মকথনও বটে। একইভাবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও বিকাশের অনন্য দলিল। এ আত্মকথন নতুন রাজনীতির গতিপথ, জনমানুষের চাওয়া-পাওয়া, মানুষের অধিকার সম্পর্কে সচেনতনা সৃষ্টি ও একটি নতুন জাতির জন্ম, বলতে গেলে এসব ভাবনা নিয়েই বঙ্গবন্ধু মুজিবের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথনির্দেশিকা।
বঙ্গবন্ধুর এই ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ধ্রুপদী ভঙ্গিতেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ এবং জীবন কথক। যে বাঙালি হাজার বছর ধরে নিরন্তর সংগ্রামের পর নিজস্ব সত্তার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে এবং তার সুদীর্ঘ ২৪ বছরের রাজনীতির অমূল্য দলিল এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ। এই গ্রন্থের গোড়ার দিকে স্বাতন্ত্র্য প্রতিষ্ঠার আখ্যান পাওয়া যাবে অজ্ঞাত পূর্ব, অধুনা আবিষ্কৃত ও প্রকাশিত এই স্মৃতিকথনে। পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক আলাপন বন্দোপাধ্যায় এ গ্রন্থের আলোচনাকালে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে এই মন্তব্য করেন। পাক্ষিক ‘দেশ’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি এসব কথা বলেন। নিবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১২ সালের ২ ডিসেম্বর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ নিয়ে আলাপন বন্দোপাধ্যায়ের এ নিবন্ধ খুবই প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ। ‘জাতির জীবন : দেশ ও নায়ক’ শীর্ষক এই নিবন্ধে তিনি বলেন, একদিকে সুভাষ চন্দ্রের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি অনুরাগ; অন্যদিকে মুসলমানের জন্য শান্তির, সহমর্মিতার, সহনশীলতার এবং ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখান মানুষকে। এই দৃঢ়বিশ্বাস নিয়েই ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম যৌবন।
বঙ্গবন্ধুর এই আত্মজীবনীকে ভারতের সুরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, বিপিন চন্দ্র পাল, মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরু, সুভাষ চন্দ্র বসু, রাজেন্দ্র প্রসাদ, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো অনেক অগ্রগণ্য নেতা এবং সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রনায়ক লি কুয়ান ইউয়ে, স্বাধীন ঘানার পরিক্রমা এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কিংবদন্তি নেলসন ম্যান্ডেলার আত্মচরিতের সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের পুরোধা পুরুষ কেসলি হেফোর্ড, দক্ষিণ আফ্রিকায় সাদাদের দ্বারা কালো মানুষের ওপর নির্যাতন, নিপীড়ন, শোষণ ও বর্ণবৈষম্য নিরসনে সে দেশের কোটি কোটি মানুষের নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা, প্যালেস্টাইন নামক স্বতন্ত্র দেশ প্রতিষ্ঠার লড়াইতে আজীবন সংগ্রামী পুরুষ ইয়াসির আরাফাত, জাম্বিয়ার মার্কাস গার্ডে, জামাইকার কেনেথ কাউন্ডা কিংবা কেনিয়ার জোলো কেনিয়াটা প্রমুখের স্মৃতিচর্চাও একই গোত্রভুক্ত। দেশ নায়কে প্রবেশ করে, নায়ক দেশে প্রবেশ করেন, পরস্পরের স্নেহাবিষ্ট হয়ে উভয়ে একত্রে জগৎসভায় উজ্জ্বল স্থান দখল করেন। ঐতিহাসিকদের এই দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলে শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটিকে বাংলাদেশের ক্লাসিক্যাল জাতীয় আত্মকথা বলে গ্রহণ করা যেতে পারে।
একদিকে পশ্চিম পাকিস্তান ও উর্দুর ঘূর্ণায়মান এবং ক্রমবর্ধমান প্রভাব পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি মুসলমানকে অস্থির করে তোলে। কৃষক প্রজার জন্য এক ন্যায়ের স্বপ্ন, নবগঠিত পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার তীব্র আর্তি এবং অনাদৃত মাতৃভাষার জন্য অনির্বাচনীয় মমত্ব নিয়ে ক্রমেই জন্ম নিতে থাকে এক অন্যতর ও নতুনতর স্বাধীনতার সংকল্প; যা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বর্ণনায় ওঠে এসেছে। আলাপন বন্দোপাধ্যায় লেখেন, পশ্চিম পাকিস্তান ও মুসলিম লীগ ক্রমেই আগ্রাসী, ক্ষমতাতান্ত্রিক ও জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে, বৃহত্তর জনতার বিপুলতর আর্তিতে এক নতুন রাজনীতি ও নতুন জাতির জন্ম দরকারÑ এই কেন্দ্রীয় ভাবনা নিয়েই আত্মজীবনীর অসমাপ্ত উপহার। প্রায় সোয়া পৃষ্ঠার নিবন্ধের উপসংহারে বলা হয়, এই গ্রন্থ স্বহস্তে এক নতুন জাতির নির্মাণে এক নিঃসঙ্গ নায়কের কাহিনি সর্ব অর্থেই তার জাতির আত্মজীবনীর অসমাপ্ত পান্ডুলিপি হয়ে উঠেছে।
অবশ্য বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে প্রয়াত প্রথিতযশা উপন্যাসিক শওকত ওসমান বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব ত্যাগের আদর্শে পরিণত’ হয়েছিলেন। শওকত ওসমান ১৯৭১ সালে তার ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ উপন্যাসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির জন্য নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে মানুষের প্রেম ও বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে বলেন, ‘মানুষটি ত্যাগের আদর্শে পরিণত হলেন, কেউ তার এই আদর্শ কেড়ে নিতে পারবে না।’ এক ভদ্রলোক পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকবলিত একটি শহর থেকে নৌপথে পালিয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে নৌকার মাঝি তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘শেখ মুজিব কি গ্র্রেফতার হয়েছেন? যাত্রী বললেন, ‘হ্যাঁ’।
একটু নীরবতার পর নৌকার মাঝি আবার জিজ্ঞেস করল, ‘শেখ মুজিব কি গ্রেফতার হয়েছেন? যাত্রী আবার বললেন, ‘হ্যাঁ’।
একদা নীরবতা ভেঙে তিনি (নৌকার মাঝি) বলেন, ‘আপনি কিছুই জানেন না, কে তাকে গ্র্রেফতার করবে?’ তার (শওকত ওসমান) সার কথাটা ‘সাধনায় মানুষ ভাবমূতির্তে পরিণত হয়, ভাবমূর্তি, আদর্শ, চেতনা কেউ গ্র্রেফতার করতে পারে না।’ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত শওকত ওসমানের ‘জাহান্নাম হতে বিদায়’ উপন্যাসে মানুষের প্রতি বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ও ভালোবাসার বর্ণনা করা হয়েছে।
শওকত ওসমানের একটি লাইন উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু বিষয়ে ড. বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘ইতিহাসের দরজা উন্মুক্ত হয়েছে শেখ মুজিবের নামে’। তাকে শুধু বিশাল পর্বতের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। এটা মনে হতে পারে যে, পর্বতটি আমাদের পাশেই, কিন্তু এটি আমাদের কাছ থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সম্পাদিত ‘বঙ্গবন্ধু হত্যার দলিল’ শীর্ষক বইতে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে শওকত ওসমানের ‘কাছ থেকে দূরে, দূর থেকে কাছে শেখ মুজিব’ লেখাটিতে বর্ণনা এভাবেই তুলে ধরেন। নিবন্ধে তিনি মুক্তি সংগ্রামের পাশাপাশি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়েও লিখেছেন। একুশে পদক, স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার এবং বাংলা একাডেমি পুরস্কার বিজয়ী এই লেখক জাতির জনকের হত্যাকান্ড সম্পর্কে দুঃখ প্রকাশ করে
বলেন, ‘সেই ভয়ংকর রাতের পরে আমি স্বেচ্ছায় নির্বাসনে গিয়েছিলাম।’ বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী প্রসঙ্গে এ উক্তিগুলো প্রাসঙ্গিক বলেই
এখানে বিধৃত হয়েছে। একই সঙ্গে শিশু রাসেল এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধুসহ সেদিন যারা ঘাতকের বুলেটে শহীদ হয়েছেন তাদের
আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
"