ইরানী বিশ্বাস
স্বপ্নভঙ্গ
অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে মারিনো। ইউনিভার্সিটিতে যেতে হবে। ইতালির এ রাস্তাটা বড়ই নির্জন। তার ওপর শীত প্রায় এসেই পড়েছে। মারিনো মূলত ভারতীয় মায়ের ইতালীয় বাবার বংশোদ্ভূত। এ জন্য গায়ের রং এবং কালচার কিছুটা মিক্সড। তবে বাংলা বা হিন্দি কোনোটাই বলতে পারে না। ইতালীয়দের এই একটা দোষ তারা ইংরেজি ভালো বলতে পারে না। নিজেদের ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষাকে প্রাধান্য দিতে পারে না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর অগত্যা মারিনো হাঁটতে শুরু করেছে। কিছুদূর যেতেই দেখে একটি ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে আছে। মনে মনে খুশি হলো। কাছে যেতেই দেখে ট্যাক্সি ড্রাইভার সিটে বসে মাথা নিচু করে আছে। কাছে গিয়ে মারিনো ড্রাইভারকে ডাকার চেষ্টা করছে। প্রথম দুই ডাকে কোনো সাঁড়া পেল না। বন্ধ গ্লাসের মধ্যে চোখ রাখতেই মারিনো অবাক হয়ে গেল। একটা বই মেলে আছে চোখের সামনে, অন্য দুটি বই পাশে রাখা আছে। বন্ধ বইয়ের মলাটের লেখা দেখে আবার অবাক হয়ে গেল। তারপর গ্লাসে আঙুলের টোকা দিতেই সম্ভিত ফিরে পেল ড্রাইভারটি। সঙ্গে সঙ্গে বই বন্ধ করে গেট খুলে বেরিয়ে এলো। মারিনো কোনো কথা বলল না। ড্রাইভারের পাশের সিটে বেশ আয়েশি ভঙ্গিতে বসে রইল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বাঁ-দিকে মুখ করে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যেতে হবে? মারিনো তার ইউনিভার্সিটির রাস্তা বলে দিল। কিন্তু কারো মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না।
প্রায় এক ঘণ্টার রাস্তা ওরা দুজন একটি ট্যাক্সি ক্যাবে পাশাপাশি বসে আছে। অথচ কারো সঙ্গে কোনো কথা হলো না। গন্তব্যস্থলে পৌঁছে গেছে। নামার আগে মারিনো একটি কার্ড দিয়ে বলল, এটা আমার কার্ড। এখানে আমার কন্ট্যাক্ট নাম্বার আছে। প্রত্যেকদিন ঠিক এই টাইমে তুমি আমাকে ওই জায়গা থেকে নিয়ে আসবে। ঠিক আছে? ড্রাইভার মাথা ঝাঁকিয়ে সম্মতি জানাল, ঠিক আছে। মারিনো চলে গেল। ড্রাইভার অন্য কোনো যাত্রীর অপেক্ষা করতে লাগল।
ক্লাস শেষে একটা সংস্থায় কাজ করে মারিনো। আজ কিছুতেই মন বসছে না কাজে। কেন এমন হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। মনে মনে ভাবে ক্লাবে গেলে হয়তো মনটা ভালো হয়ে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হবে, সাথে কিছু পানীয় পাওয়া যাবে। মোবাইলের বাটন টিপে এক বন্ধুকে ফোন করে জানিয়ে দিল, সে আসছে। বন্ধু মহলে মারিনোর বেশ সমাদর। কারণ মারিনোর গায়ের রং এতটা ফর্সা নয়। দেখতে অনেকটা ভারতীয় বলে এ দেশের পুরুষদের কাছে বেশ প্রশংসার দাবিদার। মারিনোর উপস্থিতিতে সবাই বেশ আনন্দিত হয়ে উঠেছে। গ্লাসে গ্লাসে চিয়ার্স দিয়ে আড্ডায় মশগুল হয়ে উঠেছে ওরা। ওদের মধ্যে কারো কারো ধারণা ছিল, আজ রাতটা হয়তো মারিনো ওদের আস্তানায় থাকবে। কিন্তু না, মারিনো সারা দিন কাজ করে, লেখাপড়া করে, আড্ডা দেয় কিন্তু বাইরে কখনো রাত কাটায় না। তাই অনেকের পীড়াপীড়ি সত্ত্বেও বাসায় যাওয়ার তাগিদ দেয়। নিজের গাড়ি নেই। বাবা-মায়ের গাড়ি সে ইউজ করে না। ছোটবেলা থেকে মারিনো একটু ভিন্ন স্বভাবের হয়েছে। নিজেকে কখনোই বিত্তশালীদের কাতারে দেখতে চায় না। হয়তো এ জন্যই তাকে সবাই এত ভালোবাসে। নিজের করে পেতে চায় অনেকেই। তাদের মধ্যে রয়েছে সমাজের বিত্তশালী থেকে জ্ঞানী-গুণীরাও। তাতে কী, মারিনো তাদের থোড়াই কেয়ার করে।
ঘড়ির কাঁটা তার নিজের নিয়মে ঘুরে যাচ্ছে। মারিনো এখনো চোখ খুলেনি। গতরাতে একটু বেশি পড়েছিল পেটে। তাই হয়তো ঘোর কাটেনি। বালিশের নিচে রাখা মোবাইল ফোনটি বেশ জোরে বেজে উঠেছে। কি কর্কশ রে বাবা! নেশা ধরা চোখে তাকায় মোবাইলের স্ক্রিনে। না কোনো পরিচিত নম্বর নয়। বিরক্ত হলো নম্বরটি দেখে। মনে মনে বলল, পরিচিত কেউ হলে তা-ও মানিয়ে নেওয়া যেত। কিন্তু এই অপরিচিত নম্বরটির জন্য তাকে এত সুখের ঘুম ভাঙতে হলো! অনেক অবহেলা নিয়ে ফোন রিসিভ করে।
Ñ হ্যালো, কে বলছেন? ও পাশ থেকে একটি অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ ভেসে আসে,
Ñ আমি স্বপ্ন।
স্বপ্ন একটি বাংলা শব্দ। এর কোনো অর্থই মারিনো বুুঝতে পারেনি। তবু মারিনো জিজ্ঞেস করল, কেন সে ফোন করেছে। উত্তরে স্বপ্ন ইতালীয় ভাষায় বলল,
Ñতাকে কার্ড দিয়ে বলেছিল, ফোন করে ইউনিভার্সিটিতে পৌঁছে দিতে।
স্বপ্নর কথা শুনে মারিনো ধড়ফড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সত্যি তো, সে এ কথা কাল বলেছিল ট্যাক্সি ড্রাইভারকে। অথচ সে এখনো বিছানায় শুয়ে আছে? আজ একটা ইম্পর্টেন্ট ক্লাস আছে। উ., সে এখন কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। পড়িমড়ি করে ড্রেস চেঞ্জ করে খাবারের বক্স হাতে নিয়ে দৌড়ে গেল সেখানে। দেখে ট্যাক্সি নিয়ে বসে আছে স্বপ্ন। মারিনো ঠিক আগের জায়গায় বসে গা এলিয়ে দিল। সামনে রাখা খাবারের বক্স খুলে স্যান্ডুইসের এক কোনা কামড়ে নিয়ে তাকায় স্বপ্নর দিকে। তার পর ভদ্রতা দেখিয়ে তাকে অন্য স্যান্ডুইসটা খেতে বলে। স্বপ্ন স্বাভাবিক থেকে বলে, নো থ্যাংস।
খাওয়া শেষে নড়ে চড়ে বসে মারিনো। সামনে থাকা বইগুলোর দিকে চোখ পড়তেই স্বপ্নর দিকে তাকায়।
Ñএগুলো তোমার বই? স্বপ্ন উত্তর দেয়, হ্যাঁ। তারপর মারিনো একটার পর একটা প্রশ্ন করে,
Ñতুমি ল’ পড়ছো? উত্তরে স্বপ্ন জানায়।
সে বাংলাদেশ থেকে এসেছে। এখানে পড়ালেখার খরচ চালানোর জন্য তাকে ট্যাক্সি চালাতে হচ্ছে। পাশের একটি গির্জায় সে রাত কাটায়। এখানে থাকার মতো কোনো আত্মীয়-স্বজন নেই। তা ছাড়া ঘরভাড়া করে থাকার মতো এত অর্থ তার নেই। মারিনো স্বপ্নকে বেশ পছন্দ করেছে মনে হচ্ছে। তাই মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ ভেবে বলল, তুমি আমার বাসায় থাকতে পারো। আমি একা থাকি। অনেক বড় আমার বাড়িটা। ইচ্ছা করলে তুমি অর্ধেকটা ব্যবহার করতে পারো। তোমার নিজের মতো করে। স্বপ্ন রাজি হয়ে যায়। মনে মনে ভাবে, যাহোক অন্তত থাকার একটা জায়গা হলো। এবার পড়ালেখায় মন দেওয়া যাবে।
পরদিন চার্চের ধর্মশালা থেকে যাবতীয় জিনিস নিয়ে মারিনোর বাসায় উঠেছে। সন্ধ্যার মধ্যে ট্যাক্সি মালিকের হাতে বুঝিয়ে দিয়ে বাসায় চলে আসে স্বপ্ন। রাত জেগে পড়ালেখা করে। সামনে ল’ পরীক্ষা। এ পরীক্ষায় পাস করতে পারলেই সে প্র্যাকটিস শুরু করবে। ভাবতে ভাবতে পাশ ফিরে শোয় স্বপ্ন।
আজকাল প্রায় রাতে একটা দুঃস্বপ্ন দেখে। একটা মু-ুহীন মৃত ছেলে কবর থেকে উঠে আসে। তার হাতে বড় একটা রামদা। দায়ের এক পাশ চকচক করছে। কয়েক ফোঁটা রক্ত লেগে আছে। মনে হয় ছিন্ন মাথাটির চুল ধরে ছেলেটি তার দিকে হেঁটে আসছে। খুব কাছে আসতেই স্বপ্নর ঘুম ভেঙে যায়। বিছানায় উঠে বসতেই ভীষণ কষ্ট হয় বুকের ঠিক বামপাশে। আজ বেশ কয়েক দিন এ ধরনের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ক্লান্ত হয়ে উঠেছে। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না। এমন কেন হচ্ছে! তবে কি... না তা কি করে সম্ভব! সেই কবেকার কথা। এত দিনে পচেগলে মাটির সাথে মিশে গেছে। তবে কেন এমন হচ্ছে? হয়তো মনের দোষ ভেবে নিজেকে মিথ্যে সান্ত¦না দেয়।
বিকেল হতে না হতেই বাসায় ফিরেছে স্বপ্ন। কয়েক দিন পর এক্সাম আছে, তাই বেশ কঠোর হয়ে পড়ালেখায় মনোযোগ দিয়েছে। কিচেনে গিয়ে ভাবছে, রান্না করা যায় কি না। এ কয়দিন মারিনো তাকে খাইয়েছে। আজ কেন যেন মনে হলো, বেচারি প্রতিদিন তাকে রান্না করে খাইয়েছে। আজ ও ফিরতে না ফিরতেই সারপ্রাইজ দেওয়া যাবে।
রাত প্রায় ১২টা হবে। দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছে মারিনো। এ কয়দিনে প্রায়ই মারিনো আগে ফিরত। ডাইনিংয়ে খাবার খেয়ে স্বপ্নর জন্য রেখে নিজের রুমে যেত। কখনো কখনো বই পড়ত, টিভি দেখত অথবা টেলিফোনে সবার সঙ্গে আড্ডা দিত। আর স্বপ্ন হটবাথ সেরে ডাইনিংয়ের খাবার নিয়ে নিজের রুমে চলে যেত। কখনো কখনো পড়া শেষে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পড়ত। দুজনের তেমন দেখা বা কথাও হয়নি। আজ ডিনার বানিয়েছে স্বপ্ন। অনেক ঘুরে বাঙালি দোকান থেকে পোলাও চাল, চিকেন কিনেছে। বেশ মজা করে চিকেন ঝালফ্রাই ও পোলাও রান্না করেছে। নিজে খেয়ে বাকিটা হটপটে রেখে নিজের রুমে পড়ালেখায় মনোযোগ দিয়েছে। মারিনো দরজা খুলে ঢুকতেই একটা নতুন গন্ধ পেল। মনে মনে খুঁজছে, কোথা থেকে গন্ধটা আসছে। ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে দেখে হটপট সাজানো আছে। ঢাকনা খুলতেই মিষ্টি একটা গন্ধ টের পেল। বেশ মজা করে খেয়েছে। এর আগে কখনো সে বাঙালি খাবার খায়নি তা নয়। কারণ মায়ের কাছ থেকে চলে এসেছে ১৫ বছর বয়সে। তারপর থেকে একা একা জীবন কাটানো। বাইরে থেকে ফিরে এমন করে খাবার সাজানো পায় না অনেক দিন হলো। তারপর বাঙালি খাবার। আজ মেজাজটা বেশ ফুরফুরে। খাওয়া শেষে ইচ্ছে হলো স্বপ্নর সঙ্গে বসে গল্প করতে। ডাইনিং থেকে ভেতরের দিকে যেতে স্বপ্নর রুম। দরজা গলে আলো এসে পড়েছে মেঝেতে। বুঝতে পারল, জেগে আছে। দরজায় দাঁড়াতেই স্বপ্ন ঘাড় ঘুরিয়ে বলল,
Ñআরে আপনি! আসেন আসেন। মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে স্বপ্নকে ঘেঁষে দাঁড়াল মারিনো। তারপর ইতালিয়ান ভাষায় বলল,
Ñঅনেক মজা হয়েছে তোমার রান্নায়। বাঙালিরা সত্যি রান্না জানে! মারিনোর কথায় স্বপ্ন বেশ মজা পেল। তাই সাহস করে বলেই ফেলল,
Ñবাঙালি কাউকে বিয়ে করো। মজার মজার খাবার খেতে পারবে।
অনেক কথার জালে দুজনে জড়িয়ে গেল। সারা রাত কেটে গেল মারিনোর চোখে স্বপ্ন বুনে। সে রাতটা বড্ড বেশি ছোট ছিল ওদের জীবনে। তবু রাত কোনো না কোনো সময় ভোরের আহ্বানে বিদায় নেয়। আসে পৃথিবীতে আলোর বার্তা নিয়ে সোনালি সকাল। ওদেরও এসেছিল। দিনগুলো বেশ ভালোই কেটে যাচ্ছিল। ওদের দুজনকে মায়ার বন্ধনে শক্ত করে ধরে রাখতে একটি ছোট্ট ফুটফুটে সন্তানের জন্ম হলো। স্বপ্ন এখন ইতালীয় হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করে। বেবি কেয়ারে বড় হতে থাকে ছোট্ট ড্রিম। মারিনো ওকে ডাকে জুনিয়র ড্রিম। সুখে আর স্বাচ্ছন্দ্যে কেটে যেতে থাকে ওদের জীবন।
রাত তখন প্রায় তিন-চারটা হবে। ঘুমের মধ্যে চিৎকার করে ওঠে স্বপ্ন, হেল্প মি... হেল্প মি...। মারিনোর ঘুম ভেঙে যায়। বেড সুইচে চাপ দিয়ে আলো জ্বেলে দেয়। কী হয়েছে, জানতে চায় মারিনো। স্বপ্ন শুধু তাকিয়ে থাকে মারিনোর মুখের দিকে। আজ আবার সেই দুঃস্বপ্নটা ওকে তাড়া করছে। কেন এমন হচ্ছে? মারিনোকে নিয়ে ঘর বাঁধার পর এতটা বছর সে একবারও ওই স্বপ্নটা দেখেনি। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর মারিনোর চোখে চোখ রেখে পাথর দৃষ্টিতে তাকায়। মারিনো ভয় পেয়ে যায় স্বপ্নের এমন দৃষ্টিতে। সে দেখতে পাচ্ছে ভয়ংকর এক অতীত নিয়ে জীবনযাপন করছে স্বপ্ন। ভালোবাসার ছোঁয়া দিয়ে মারিনো স্বপ্নকে সাহস জোগায়। স্বপ্ন বলতে শুরু করে...
আজ থেকে অনেক বছর আগে। স্বপ্ন তখন ঢাকার একটি কলেজের ছাত্রনেতা। এ দেশে স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তার মধ্যে ছাত্র রাজনীতিতে একটি বিরাট পরিবর্তন হয়েছে। ছাত্ররা হাতে হাতে অস্ত্র পেয়েছে। ক্ষয়ে যেতে বসেছে তাদের আদর্শ। অস্ত্র আর ক্ষমতার জোরে তারা সার্টিফিকেট পায়, চাকরি পায়। তাদেরই একজন ছিল স্বপ্ন। বাবা-মা অনেক স্বপ্ন নিয়ে ছেলেকে কলেজে ভর্তি করেছে। ছেলে এক দিন বড় হয়ে তাদের মুখ উজ্জ্বল করবে। বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর আর অসীম সাহসের জোরে ছাত্রনেতা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছে। তবে অনেক অন্যায় কাজ তাকে করতে হয়েছে। তবে মানুষ খুন করার মতো কোনো কাজে সে নিজেকে জড়ায়নি।
সেদিন রাত ১০টা হবে। দুই বন্ধু এসে চুপি চুপি স্বপ্নকে জানায়, অপারেশন করতে হবে। সঙ্গে একটি ছেলেকে নিয়ে এসেছে। মুখে টেপ দেওয়া, দুহাত পেছনে মোড়ানো দড়ি দিয়ে বাঁধা। ১২টা বাজতে না বাজতেই দুই বন্ধু ছেলেটির মু-ুচ্ছেদ করল। স্বপ্নর চোখের সামনে এমন একটি দৃশ্য সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু সবাই তাকে সাহসী হিসেবে জানে। তরুণ বয়সে হেরে যাওয়ার প্রবণতা বোধ করি কারোরই থাকে না। অন্যদের কাছে ভীতু হয়ে থাকার মানুষ সে নয়। তাই দ্বীখ-িত লাশ সরিয়ে ফেলার পরামর্শ তাকেই দিতে হলো।
মানুষ যতই নিজেকে চালাক ভাবতে থাকে, নিয়তির কাছে সে সামান্যই বোকা ছাড়া আর কিছুই নয়। লাশ গুম করা হয়েছে। কিন্তু ধারালো রামদাটি তখনো রক্তমাখা অবস্থায় পড়ে আছে। বন্ধুরা যে যার মতো রুমে গেছে। স্বপ্ন নিজের রুমের দরজায় পা রাখতেই দেখে ভেতরে পুলিশ। মেঝেতে তখনো রক্ত ছিটকে আছে এখানে-সেখানে। হাতেনাতে ধরা পড়তে হলো স্বপ্নকেই। কিন্তু এত বড় একটা কেস, সহজেই তো আর মিটে ফেলা যায় না!
দিন গড়িয়ে রাত আসে। এভাবে জেলের বদ্ধঘরে স্বপ্ন ছিল প্রায় এক বছর। শেষে হাইকোর্টের আদেশে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে ফাঁসির রায় হয়। বাবা-মায়ের এক মাত্র ছেলে। তাদের কাছে তখন বেঁচে থাকাটাই যেন মিথ্যা হয়ে গেল। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার বিচিত্র রহস্যে বেঁচে গেল স্বপ্ন! তবে দেশ ছাড়তে হলো তাকে।
স্বপ্ন কথা শেষ করে চোখ নিচু করে থাকে। মারিনোর চোখে চোখ রাখতে সাহস পায় না। মারিনো সব কথা শুনে পাথর হয়ে গেল। তারপর স্বপ্নর চিবুকে হাত রেখে আলতো করে তুলে ধরে। তখনো স্বপ্ন নিচের দিকে দৃষ্টি ফেলে আছে। তারপর মারিনো বেশ আবেগ জড়ানো সুরে বলে,
Ñতুমি এত সাহসী পুরুষ। অথচ আজ আমার চোখে চোখ রাখার সাহস তোমার নেই! তুমি সত্যি একটা ভীতু। তুমি কখনোই মানুষ খুন করতে পারো না।
মুহূর্তে গর্জে ওঠে স্বপ্ন, না, মারিনো তুমি জানো না। আমি কতটা ঘৃণ্য। আমি... মারিনো নিজের হাতটি চেপে রাখে স্বপ্নর ঠোঁট দুটি।
ড্রিম এখন অনেক বড় হয়েছে। তার বায়না রাখতে ওরা একবার বাংলাদেশে আসে। ১০ বছরের ড্রিম ইতালিয়ান মায়ের সঙ্গে বাঙালি বাবার দেশে আসে। তাদের আসা উপলক্ষে পরিবারে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। প্রায় ১৫ বছর পর দেশে এসে চোখে তার বিস্ময়। দেশে অনেক পরিবর্তন এসেছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান অনেক পরিবর্তন হয়েছে। রাজধানী জুড়ে শুধু বহুতল ভবন নির্মাণ হচ্ছে। সরু রাস্তাগুলো দখল করে নিয়েছে বিদেশি প্রাইভেটকার। এসব পরিবর্তনে নিজের মনে শান্তি পায় স্বপ্ন।
এক সন্তানের মা হলেও মারিনো এ দেশে নববধূ। তাকে বরণ করতে সবাই যেন মরিয়া। আর ড্রিমের কথা বলাই বাহুল্য। প্রকৃতির এমন অপরূপ সৌন্দর্য দেখে মারিনো অভিভূত। একদিন চুপি চুপি স্বপ্নকে বলে,
Ñআমরা এখানে থেকে গেলেই তো পারি!
মারিনোর কথায় এক বাক্যে রাজি হয়ে যায় স্বপ্ন। তার দুচোখে সোনালি সুখ। ড্রিম এক দিন এ দেশে বড় হবে। প্রতিষ্ঠিত হবে। ঠিক তখনই মোবাইল ফোনটি বেজে ওঠে। পাশে রাখা মোবাইল রিসিভ করে দেখে সৌর। তারপর বলে,
Ñহ্যাঁ সৌর বল। এত রাতে?
ফিসফিস করে বলে,
Ñতুই এখন কোথায় আছিস?
Ñকেন? বাসায়, মারিনোকে নিয়ে... শোন আমি না ঠিক করেছি আর বিদেশ যাব না। মারিনো তাই চায়...
স্বপ্নর কথা শুনে রেগে ওঠে সৌর। হেয়ালি ছাড়। আমি যা বলি, তাই মন দিয়ে শোন। তোদের কি টিকিট কনফার্ম আছে? যদি না হয় তবে আমি সে ব্যবস্থা করব। সৌরর কথা শুনে অবাক হয়ে যায় স্বপ্ন।
Ñকী বলছিস তুই? কোনো প্রবলেম হয়েছে?
সৌর তেমন ভয়ার্ত গলায় বলে, গতকাল ডেভেলপাররা মাটি খুঁড়ে লাশের কঙ্কাল পেয়েছে। তার হাতে যে ব্রেসলেট আর আংটি ছিল। তা দেখে শনাক্ত করেছে সেই লাশ। সরকার পাল্টেছে। এ নিয়ে হাঙ্গামা হবে। হয়তো তোকে আবার এ বিষয়ে হয়রানি করতে পারে। তুই ইতালি চলে যা। খুব ভোরে তোদের বাসা ছেড়ে আমার বাসায় চলে আসবি। আমি তোদের যাওয়ার ব্যবস্থা করব।
স্বপ্ন অবাক হয়ে যায়, সৌরর কথা শুনে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে সৌরর হাতে বড় রামদা। ও এক কোপে দুখ- করল পিংকুর দেহ থেকে মাথা। উহ্... আজ এত বছর পরও তার রেহাই নেই। যারা অন্যায় করল তারা দিব্যি এ দেশে ঘুরছে। আর তাকে সারা জীবন পরদেশে থাকতে হবে। মারিনোর স্বপ্ন সে পূরণ করতে পারল না।
বাতি নিভিয়ে ওরা ঘুমিয়ে পড়েছে। আজ রাতে আবার সেই দুঃস্বপ্নটা দেখে স্বপ্নের ঘুম ভেঙে গেল।
"