হাসান মোস্তাফিজুর রহমান

  ০৪ জুন, ২০১৯

নিঃশব্দ নিয়তি

ঝিমঝিম রোদের ভেতর দিয়ে হাঁটতে ভালো লাগে আমার। এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই এক দিন দেখা পেয়েছিলাম আশ্চর্য বিষণœ সুন্দর সেই মেয়েটার। সে কথায় অবশ্য পরে আসা যাবে।

সকাল থেকে সন্ধ্যে অবধি সারা দিন আমি হাঁটি। পুরো ঢাকা শহর চষে বেড়াই। এ শহরের নিষ্ঠুর সব অলিগলি আমার মুখস্থ। তবে সবচেয়ে ভালো লাগে রেললাইন দিয়ে হাঁটতে। ফকিরেরর পুলের এক মেসে থাকি। ওখান থেকে কমলাপুর স্টেশন কাছেই। একটা সিগারেট ধরিয়ে শেষ হওয়ার আগেই হেঁটে পৌঁছানো যায়। ওখান থেকে রেললাইন ধরে সোজা হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে কোনো কোনো দিন টঙ্গী স্টেশন পর্যন্ত চলে যাই। রেললাইনের দুধারের বস্তি দেখি, জনপদ দেখি, বিচিত্র সব মানুষকে কাছ থেকে দেখি; দুপাশ থেকে ধেয়ে আসা উথাল-পাথাল হাওয়ার তোড়ে কোথায় কোন অচিনপুরে যে ভেসে যাই!

দুটো টিউশনি আছে রাতে। ফকিরের পুলেই। যেখানেই থাকি না কেন ঝুপ করে সন্ধ্যে নামার সঙ্গেই ফিরে আসতে হয় মেসে। হাত-মুখ ধুয়ে জামাটা পাল্টে বেরিয়ে পড়ি।

প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা মেসে ফিরে আলতাফ ভাইকে তার বিছানায় পাবই পাব। চিৎ হয়ে শুয়ে সস্তায় কেনা মোবাইল সেটে খুব মনোযোগ দিয়ে এফএম ব্যান্ডের রেডিও শোনেন তিনি। আমাকে দেখেই ঝট করে কান থেকে ইয়ার ফোন খুলে শোয়া থেকে ওঠে বসেন। তারপর খুব আগ্রহ সহকারে জিজ্ঞেস করেন, ‘কি হে ব্রাদার, কোনো সুখবর আছে?’

তাকে নিরাশ করে প্রতিদিনই অসহায়ভাবে মাথা নাড়ি।

এতটুকু না চুপসে আলতাফ ভাই মহা উৎসাহে বলেন, ‘না না, ব্রাদার, এত ভেঙে পড়লে তো চলবে না। আজ না হয় কাল হবে। কাল না হয় পরশু হবে। এক দিন না এক দিন হবেই হবে। এই আমাকে দেখুন না : তিন তিন জোড়া বাটার মজবুত স্যান্ডেল ক্ষয় হয়ে গিয়েছিল এই কেরানির চাকরিটা জোগাড় করতে। অথচ কখনোই ধৈর্যহারা হইনি। জানতাম এক দিন আমার হবেই হবে। টুডে অর টুমরো। হাঃ হাঃ হাঃ।’

প্রতিদিন সন্ধ্যেয় ঠিক এভাবেই আমার চাকরির খোঁজ নেন আলতাফ ভাই। ঠিক এ কথাগুলো বলেই আমাকে সান্ত¡না দেন। সান্ত¡না দিয়েই ফের চিৎ হয়ে যান বিছানায়। ইয়ার ফোন কানে লাগিয়ে ফের শুনতে শুরু করেন রেডিও। কোনো গান বা অনুষ্ঠানের শব্দ কখনো কানে আসে না আমার।

এক দিন রাত সাড়ে ১২টায় ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললেন আমাকে। মিনমিন করে বললেন, ‘ব্রাদার, খুব রেডিও শুনতে ইচ্ছে করছে।’

‘তো আমি কী করব?’

‘আমার সঙ্গে একটু নিচে যেতে হবে, চার্জার কিনব। একা যেতে ভয় করছে।’

‘কেন, আগের চার্জারের কী হয়েছে? আজ সন্ধ্যেবেলাও তো রেডিও শুনতে দেখলাম আপনাকে!’

‘চুরি হয়ে গেছে রে ভাই। আমার চার্জারটা চুরি হয়ে গেছে।’

‘চুরি হয়ে গেছে মানে! মোবাইল সেট না নিয়ে চোর আপনার প্রাগৈতিহাসিক যুগের চার্জার নিয়ে সটকে পড়ল!’

‘ব্যাপারটা বুঝতে চেষ্টা করুন, ব্রাদার। মোবাইল নেবে কীভাবে? মোবাইল ছিল রুমে আর চার্জার তো ছিল ছাদে।’

‘ছাদে মানে!’

‘ছাদে মানে আমাদের ছাদে। ঠিকমতো চার্জ ডেলিভারি না দেওয়ায় প্রতিদিন রাত ১২টায় ছাদে রেখে আসি চার্জারটা, ভোরে নিয়ে আসি। সারা রাত শিশিরে ভিজে রিচার্জ হয়ে যায় চার্জার। চমৎকার চার্জ দেয়। আজও রেখে এসেছিলাম। একটু পর হঠাৎ রেডিও শুনতে ইচ্ছে করল খুব। ছাদে গিয়ে দেখি চার্জার উধাও। এদিকে একদম চার্জ নেই মোবাইলে।’

কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত লাগছিল। চার্জার রিচার্জ করার অদ্ভুত ফর্মুলা শুনে ঘুম উধাও হয়ে গেল দুচোখ থেকে।

‘শিশিরে ভিজে চার্জার রিচার্জ হয় মানে! আনকোরা নতুন চার্জারও তো এক রাতেই বরবাদ হয়ে যাওয়ার কথা!’ ভুঁড়ি চুলকাতে চুলকাতে গা দুলিয়ে হাসলেন আলতাফ ভাই। ‘দুনিয়ার সবকিছু কি সিধা ফর্মুলায় চলে, ব্রাদার? চলে না। এটি হচ্ছে উল্টা ফর্মুলা। তবে চার্জার শুধু খোলা আকাশের নিচে রেখে দিলেই হয় না। আনুষঙ্গিক আরো কাজ আছে। ফর্মুলাটা শিখেছিলাম আমাদের গ্রামের চিনু মেকারের কাছে। এক দিন শিখিয়ে দেব আপনাকে। যাহোক, মেসের সবাই তো ঘুমে অজ্ঞান এখন। কারো কাছ থেকে যে চার্জার ধার নেব, সে উপায়ও নেই। তাই এখন চলেন তো একটু আমার সঙ্গে।’

‘এত রাতে মোবাইলের দোকান তো খোলা থাকে না!’

‘আরে ব্রাদার, ফ্লেক্সিলোডের দোকানেও চার্জার পাওয়া যায় আজকাল। ডিপার্টমেন্ট স্টোর টাইপের অনেক মুদি দোকানেও থাকে। একটা না একটা দোকান অবশ্যই খোলা পাওয়া যাবে। চলেন না, প্লিজ?’

রাস্তায় নামতেই মাঘ মাসের শীত হুল ফোটাল শরীরে। একে শীতের রাত তার ওপর রাত প্রায় ১টাÑ মহল্লার মোবাইল ফোনের দোকান দূরে থাক, কোনো দোকানই খোলা নেই। আলতাফ ভাইয়ের পীড়াপীড়িতে চৌরাস্তা পর্যন্ত যেতে হলো। এখানেও একই অবস্থা। ঝাপ ফেলা সব দোকানের। সিরাজ মিয়ার ভাতের হোটেলও বন্ধ হয়ে গেছে। নিথর হয়ে আছে জমজমাট চৌরাস্তা।

মুখ আমসি করে মেসের দিকে হাঁটতে শুরু করল আলতাফ ভাই। শীতে হি হি করে কাঁপতে কাঁপতে পিছু নিলাম তার। হঠাৎ পাশের গলি থেকে ঘেউ ঘেউ করতে করতে দৌড়ে এলো তিন-চারটা কুকুর। মুহূর্তে ঘিরে ধরল আমাদের। রক্ত হিম করা গর্জন ছাড়ছে। ভয়ে জমে গেলাম আমরা। সাহায্যের আশায় আশপাশে তাকাচ্ছি। কেউ নেই।

ফিসফিস করে কাঁপা গলায় আলতাফ ভাই বললেন, ‘ব্রাদার, শিস দেন। জনপ্রিয় কোনো হিন্দি গানের শিস ধরেন, দেখবেন ঠান্ডা হয়ে গেছে হারামির বাচ্চাগুলো।’ বলে শিস দেওয়া শুরু করলেন। কাঁপা কাঁপা বিদঘুটে সুর বের হচ্ছে তার ঠোঁট থেকে। অদ্ভুত শিস শুনে আরো বেড়ে গেছে কুকুরগুলোর চিৎকার।

উপায় না দেখে ঠোঁট গোল করলাম। ভয়ে নাকি ঠান্ডায় ঠিক বলতে পারব না, থুতু বেরোতে লাগল মুখ দিয়ে, শিস বেরোল না।

হঠাৎ হুইসেলের শব্দ শোনা গেল, সঙ্গে বুটের আওয়াজ। কোত্থেকে যেন দৌড়ে হাজির হলো দুজন পুলিশ। পুলিশ দুজনকে দেখেই চিৎকার থামিয়ে দিল কুকুরগুলো। কুঁইকুঁই আওয়াজ তুলে দৌড়ে অন্ধকার গলিটায় ঢুকে পড়ল।

কুকুরও যে পুলিশকে ভয় পায়, এ তথ্য জানা ছিল না।

ঢ্যাঙামতো পুলিশটা বাজখাঁই গলায় বললো, ‘কী, কী হইতেছে এখানে? বিষয়ডা কী? হাতে মোবাইল মনে হইতেছে? এত রাইতে হাতে মোবাইল আইলো ক্যামনে!’

বিষয়টা পুলিশ দুজনকে বোঝাতে শুরু করলেন আলতাফ ভাই। কিন্তু বিষয় জুৎসই মনে হলো না তাদের কাছে।

আমাদের আপদমস্তক নিরীক্ষণ করতে করতে ঢ্যাঙার সঙ্গেরটা বললো, ‘থানায় চলেন, থানায় যাইতে হইবো আপনেগো। রাইত একটায় হাতে মোবাইল আইলো ক্যামনে!’

এ কোন ঝামেলায় পড়লাম! ভীষণ রাগ লাগছে আলতাফ ভাইয়ের ওপর। ছিনতাইয়ের আশঙ্কায় মানা করার পরও মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়েছেন, ইয়ার ফোন টেস্ট করে কিনবেন। থানায় নিয়ে এবার টেস্ট করাবে!

থানায় যাওয়ার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়লেন আলতাফ ভাই। বিস্ময়ে সঙ্গে বললেন, ‘রাত একটায় হাতে মোবাইল থাকতে পারবে না, এটা কোনো আইনে আছে, ভাই!’

ঢ্যাঙা বললো, ‘কতা না বাড়ায়া থানায় চলেন। যা বলার ওসি সাবেরে বলবেন।’

‘জানেন আমি একজন গভর্নমেন্ট সার্ভিস হোল্ডার?’

‘আমরাও গভর্মেন্টের পুলিশ। গভর্মেন্টের কামে বাধা দিলে খবর কইরা ফালামু! চলেন থানায়, সকালে চালান কইরা দিমু। জামিন লইতে কত খরচা হয় বুঝবেন নে। রাইত একটায় হাতে মোবাইল আইলো ক্যামনে!’

‘নো, ইট’স ইমপসিবল! এটা কেমন আইন? নিরীহ একজন নাগরিককে এভাবে অপদস্থ করতে পারেন না আপনারা। হোয়াই?’

বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে পুলিশ দুজনের সঙ্গে সমানে তর্ক শুরু করে দিলেন আলতাফ ভাই।

বাংলা ইংরেজি মেশানো তর্কাতর্কির একপর্যায়ে হঠাৎ হেডলাইটের আলোয় আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে পুলিশভর্তি টেম্পো হাজির হলো একটা। এগিয়ে গিয়ে এএসআইয়ের কানে কি যেন বললো ঢ্যাঙা। ক্রুর হেসে বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাতে দোলাতে আমাদের টেম্পোতে তুলে ফেলার নির্দেশ দিলেন এএসআই।

বিজয়ীর ভঙ্গিতে হেসে হাতের ব্যাটেন দিয়ে আলতাফ ভাইয়ের নিতম্বে ভয়াবহ এক খোঁচা দিল ঢ্যাঙা। ‘ওঠ টেম্পোতে। আমারে আইন শিখাস? আমার লগে তামশা? থানায় নিয়া তর ভিতরে তিন ফুট তামশা হান্দামু আইজ আমি!’

দুই

কী আশ্চর্য, আজও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকে হাসল মেয়েটা! গত দুদিনও ঠিক এভাবে হেসেছে। গত দুদিনের মতো আজও হাসি দেখে বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠল।

প্রতিদিন হাঁটতে হাঁটতে বিকেলের মুখে মুখে রেললাইনের পাশের এই হোটেলটায় ঢুকি। হোটেলের পুরোটাই বেড়া দিয়ে তৈরি। ওপরে অবশ্য টিনের চালা। হোটেলে ঢোকার মুখে নড়বড়ে দুটো বাঁশের খুঁটিতে গাঁথা বিশাল এক সাইনবোর্ড। তাতে লেখাÑ খবির মিয়ার ডালপুরির হোটেল। সাইনবোর্ডের ডানপাশে কাঁচা হাতে আঁকা একটা স্কেচÑ কড়াইতে ডালপুরি ভাজছে এক লোক। কড়াইয়ের পাশে লেখাÑ আট লাভলু আটস।

নামের সার্থকতা আছে খবির মিয়ার ডালপুরির হোটেলের। আসলেই শুধু ডালপুরি ভাজা হয় এখানে। তিনবেলাই। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল হওয়া সত্ত্বেও তেমন একটা ব্যবসা হচ্ছে না খবির মিয়ার। আশপাশের প্রতিটা কল-কারখানার পাশেই হোটেল রয়েছে। তবে দুপুরবেলা মোটামুটি ভালো খদ্দের পায় খবির মিয়া। সামান্য বেতন পাওয়া অনেক শ্রমিকই ভাতের বদলে ডালপুরি খায় দুপুরবেলা। টিনের প্লেটে করে আলু, আটা আর কী দিয়ে যেন তৈরি ঝোল দেওয়া হয় পুরির সঙ্গে। ঝোলে পুরি চুবিয়ে পরম তৃপ্তির সঙ্গে খায় ক্ষুধার্ত মানুষগুলো। মাঝে মাঝে ঝোলের প্লেট ঠোঁটের কাছে ধরে ফুড়–ত করে চুমুক দিয়ে ‘আহ্’ জাতীয় শব্দ করে। দুদিন দুপুরে হোটেলে ঢুকে নিজের চোখে দেখেছি এসব। চারটের বেশি ডালপুরি খেতে দেখিনি। প্রথমে দুটো অর্ডার দেয়। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে খেয়ে পরে আরো দুটোর। পুরি খেয়ে পেট পুরে পানি খায় সবাই। অ্যালুমিনিয়ামের জগ ভরে ভরে পানি এনে দেয় হোটেলের একমাত্র মেসিয়ার কামাইল্লা ওরফে কামাল।

ডালপুরি দিয়ে লাঞ্চ সেরে লুঙ্গির কোচ থেকে বিড়ি বের করে ধরায় অনেকে। অনেকে তিন টাকা দিয়ে সিঙ্গেল মানে হাফ কাপ চা খায়। খানিকক্ষণ গল্প-গুজব করে বিশ্রাম নিয়ে শরীরের ঘাম ভালোমতো না শুকোতেই ফের কারখানার দিকে রওনা দেয় লোকগুলো।

প্রায় প্রতিদিন অর্থাৎ যেদিন রেললাইন দিয়ে হাঁটি সেদিন বিকেলের মুখে মুখে খবির মিয়ার ডালপুরির হোটেলে ঢুকে পড়ি। হেঁটে বেড়াতে ভালো লাগলেও বিকেলের দিকে কেমন অবসন্ন হয়ে আসে পা। তাছাড়া টিউশনির জন্য সন্ধ্যের মধ্যে ফিরে যেতে হয়। ডালপুরি আর চা খেতে খেতে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ফিরতি পথ ধরি।

শ্রমিক শ্রেণির লোকজন ছাড়া আর কাউকে কোনো দিন ঢুকতে দেখিনি এ হোটেলে। আমার মতো বাধা খদ্দের পেয়ে খবির মিয়ে বেজায় খুশি। বেশ যতœআত্তি করে। প্রতিদিন আমাকে দেখলেই ‘কই রে কামাইল্লা!’ বলে ত্রাহি এক হাঁক ছাড়ে। হাঁক শুনে ময়লা ন্যাকড়াটা নিয়ে চিলের মতো উড়ে আসে মেসিয়ার কামাল। সালাম দিয়ে দাঁত বের করে হাসে। তারপর ময়লা ন্যাকড়াটা দিয়ে ঘষে ঘষে টেবিল আর বেঞ্চি আরো ময়লা করে দিয়ে ডালপুরি আনতে চলে যায়।

গত দুদিনের মতো আজও মুচকে হেসে জানালা থেকে সরে গেছে মেয়েটা। রাজহাঁসের মতো ধবধবে সাদা দোতলা বাড়িটা হোটেলের মুখোমুখি, রেললাইনের ঠিক ওপারে। এ সময়াটায় তেমন একটা খদ্দের থাকে না হোটেলে। জানালার পাশের জায়গাটা প্রতিদিনই ফাঁকা পেয়ে যাই। গত পরশুও এখানেই বসেছিলাম। ছোট ছোট চুমুক দিয়ে বেশ রসিয়ে খাচ্ছিলাম চাটা। হোটেলের চেহারা সুরত প্রাগৈতিহাসিক যুগের হলেও খবির মিয়ার পুরি আর চা অসাধারণ। তো চাটা বেশ ভালো লাগলেও কেন যে অস্বস্তি লাগছিল। অস্বস্তি কাটাতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেলাম মেয়েটাকে। সাদা বাড়িটার দোতলার জানালা দিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আমার দিকে।

শেষ বিকেলের আলোয় কী যে অপূর্ব লাগছিল মেয়েটাকে! চা খাওয়া ভুলে হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম ওর দিকে। হঠাৎ মুচকে হেসে জানালা থেকে সরে গেল মেয়েটা। পরদিন আর আজকেও ঠিক একই রকম আচরণ করল ও।

পুরি আর ঝোল দিয়ে গেছে কামাল। খেতে খেতে হোটেলের জানালা দিয়ে দৃষ্টি ফেলছি দোতলার জানালাটার দিকে। না, মুচকে হেসে যেন গায়েবই হয়ে গেছে, পাত্তা নেই। আজও কি আগের মতোই করবে? আর আসবে না জানালায়? দুর্নিবার এক আকর্ষণ বোধ করছি ওকে আরেকটিবার দেখার জন্য।

সন্ধ্যে হয়ে আসছে। এক্ষুনি না উঠলে সময়মতো হাজির হতে পারব না টিউশনিতে। সেদিন পনেরো মিনিট দেরি হওয়ায় মুখ কালো করে কথা বলেছেন নাজমুল সাহেব। আজকেও দেরি হয়ে গেলে কথা শুনতে হবে। আপনার আর আসার প্রয়োজন নেইÑ বলে দেওয়াটাও বিচিত্র নয়। ঢাকা শহরে টিউশনি যে আজকাল চাকরির মতোই দুষ্প্র্রাপ্য অভিভাবকরা বেশ ভালো করেই জানেন। জানেন বলেই সামান্য কারণে মুখের ওপর মানা করে দিতে বাধে না তাদের। যেকোনো মূল্যেই হোক টিউশনি দুটো চালিয়ে যেতে হবে আমাকে। টিউশনির জোরেই নিষ্ঠুর এ ঢাকা শহরে কোনো রকমে টিকে আছি। চাকরি খুঁজতে পারছি।

মেয়েটাকে এক নজর দেখার জন্য কেন যেন হাহাকার করছে বুকের ভেতরটা। সময় না থাকলেও উঠতে ইচ্ছে করছে না। গোল্লায় যাক টিউশনি।

বেঞ্চি ছেড়ে ওঠার আগে শেষবারের মতো তাকিয়েই জানালায় দেখতে পেলাম ওকে। দুহাতে জানালার গ্রিল ধরে বিষণœ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। গোটা অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে শেষ বিকেলের মায়াবী আলো ভেদ করে বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম ওই বিষণœ সৌন্দর্যের দিকে।

তিন

ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়েছে আমাদের তৃতীয় রুমমেট মারুফ সেজান। মোটা লেন্সের চশমার ভেতর দিয়ে বিস্ফারিত দেখাচ্ছে তার দুচোখ। ঠান্ডা স্বভাবের হালকা পাতলা গড়নের মারুফের এই অগ্নিমূর্তি দেখে একেবারে ভড়কে গেছেন আলতাফ ভাই। নিজেকে কেন্নোর মতো গুটিয়ে বিছানার এক কোণে গুটিশুটি মেরে বসে আছেন।

মারুফ সেজানের আরেকটা নাম আছে। নামটা আমরাই দিয়েছিÑ রোবট সেজান। রোবটের মতোই খাটতে পারে সে। চাকরি করে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে। নটা-পাঁচটা ডিউটি হলেও কোনো দিনই রাত দশটার আগে রুমে ফেরে না। সম্পাদক চলে যেতে বললেও অফিস ছাড়ে না। কাজ ছাড়া নাকি তার ভালো লাগে না! যেদিন পেস্টিং থাকে রাত বারোটা-একটার আগে মেসে ফিরতে পারে না। অফিসে পরদিন বারোটায় গেলেই চলে। সম্পাদক বলেছেনও তা, কিন্তু মারুফ সেজান ঠিক কাঁটায় কাঁটায় নটায় অফিসে হাজির হয়ে যাবে।

অনেক দিন রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর বারান্দায় পায়চারি করতে দেখেছি তাকে। রাতে সে কঘণ্টা ঘুমায় বা আদৌ ঘুমোয় কি না, তা এক রহস্য। দেশের বাড়ি রাজবাড়ীতে। বছরে দু-একবারের বেশি যায় না। এক মেয়ে মনে মনে ভালোবাসত তাকে। একসময় বিয়ে ঠিক হয়ে গেল মেয়েটার। মারুফের উদ্দেশে চিঠি লিখে আত্মহত্যা করে বসল বোকা মেয়েটা। ভীষণ শক পেল মারুফ সেজান। একটা মেয়ে তার জন্য মরে গেল অথচ সে কিছুই জানল না! মনের অতলান্ত দুঃখে এলোমেলো হয়ে গেল তার গোছানো জীবন। বাড়িতে গেলেই গোপনে সেই মেয়েটার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দোয়া করে আসে প্রতিবার।

তো টিউশনি থেকে ফিরেই মনে কষ্ট চাপা দেওয়া হাসিখুশি মিশুক স্বভাবের আমাদের প্রিয় মারুফ সেজানকে এই যুদ্ধংদেহি অবস্থায় পেলাম।

‘এই প্রচন্ড গরমে কোন আক্কেলে সিলিং ফ্যানটা বেঁচে দিলেন, আলতাফ ভাই!’ চিবিয়ে চিবিয়ে আবারও জানতে চাইল রোবট সেজান।

‘মাত্র একহপ্তা সময় দিন, ব্রাদার। বেতনটা পেলেই আনকোরা নতুন ভালো জাতের একটা ফ্যান কিনে নিয়ে আসব। এক পয়সাও দিতে হবে না আপনাদের কারো।’

‘চাঁদা তুলে কেনা ফ্যান আমাদের কাউকে জিজ্ঞেস না করে কোন সাহসে আপনি বেঁচে দিলেন, সেটা বলেন আগে।’

‘সাহস? বিপদে পড়লে কুঁইকুঁই করা কুকুরছানাও ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয় রে ভাই! সাহস জোগায় বিপদ।’

‘বিপদ! কোন বিপদে পড়ে এমন রামছাগলের মতো কাজ করলেন শুনি?’

‘বড় জঘন্য বিপদ। বলা যাবে না।’

‘জঘন্য বিপদ!’ বিড়বিড় করে কথাটার পুনরাবৃত্তি করল মারুফ সেজান। তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘ফ্যানটা কত টাকায় বেচেছেন?’

‘বারোশো পঞ্চাশ। গুলিস্তান মোড়ে দাঁড়িয়ে বিক্রি করেছি। চোরাই মাল ভেবেছিল পুলিশ। পঞ্চাশ টাকা দিতে হয়েছে ওদের।’

‘এক মাস আগে চব্বিশশো টাকায় কেনা ফ্যানটা মাত্র বারোশো পঞ্চাশ টাকায় বেঁচে দিলেন! পুলিশ চোর ভেবেছিল? পুলিশ তো ঠিকই ভেবেছে। আমাদের কাউকে জানাননি। আপনি তো মিয়া চোরই, পাকা চোর।’

‘কঠিন বিপদে পড়লে ভদ্রলোকও চোর হয়ে যায়, ব্রাদার। আমার মতো বিপদে পড়লে আপনিও হতেন।’

‘হতাম না। মাত্র বারোশো টাকার বিপদের জন্য আপনার মতো চোর হতাম না। আপনাদের কাছে ধার চাইতাম। না পেলে বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে থালা নিয়ে বসতাম। তবু চুরি করতাম না।’

‘বিপদে মাথা ঠিক ছিল না রে ভাই।’

‘বারবার বিপদ বিপদ না করেন, কী বিপদ সেটা বলুন!’

‘লজ্জার কথা। বলতে পারব না।’

‘আপনার লজ্জার খ্যাতা পুড়ি আমি! চোরের আবার কীসের লজ্জা? শিগগিরই বলুন, আলতাফ ভাই। নইলে বারান্দা দিয়ে নিচে ফেলে দেব আমি আপনাকে!’ বলে আলতাফ ভাইয়ের দিকে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে দুপা এগিয়ে গেল মারুফ সেজান।

আলতাফ ভাইয়ের দুমণি দেহটা মারুফ সেজান যে তুলতে পারবে না, সে কথা আমার মনে হয় আমার মতো আলতাফ ভাইও বোঝেন। কিন্তু কেন যেন ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।

‘বড়ই লজ্জার কথা, ব্রাদার। শুনলে আপনিও লজ্জা পাবেন।’

‘পেলে পাব। আমার কাছে ধার না চেয়ে ফ্যান চুরি করে বেচে ফেলেছেন। কোন সে বিপদ জানতেই হবে আমাকে।’

কমুহূর্ত আমার দিকে আর মূর্তিমান বিপদ মারুফ সেজানের দিকে পালা করে তাকালেন আলতাফ ভাই। তারপুর মুখে লালচে আভা ফেলে মুখ খুললেন তিনি।

‘বিপদটা আসলে আমার না, আপনাদের ভাবির।’

‘ভাবির বিপদ মানেই আপনার বিপদ। আপনার বিপদ মানেই আমাদের বিপদ। শুনি কী বিপদ?’ বিজ্ঞের মতো মাথা দোলাতে দোলাতে বলল মারুফ সেজান।

‘ব... বন্ধ হয়ে গেছে!’

‘বন্ধ হয়ে গেছে? কী বন্ধ হয়ে গেছে!’

‘মানে আপনার ভা... ভাবির আর কী! হেঃ হেঃ বুঝলেন না? মাত্র সতেরো বছর, বাচ্চা মেয়ে। বিরাট সমস্যা হয়ে যাবে এ বয়সে মা হতে গেলে। গতকাল চিঠি এসেছে বাড়ি থেকে। পড়ে তো আমার মাথায় বাড়ি।’

চোখ বড় বড় করে মারুফ সেজান বললো, ‘তো এর সঙ্গে সিলিং ফ্যান বেচার কী সম্পর্ক!’

‘এখনো বোঝেননি, ব্রাদার? এমআর, এমআর করাতে হবে। আর কদিন দেরি হয়ে গেলেই সাড়ে সর্বনাশ! হাজারখানেক টাকার ধাক্কা। ওদিকে বেতন পেতে মেলা দেরি। শেষে উপায় না দেখে...।’

একবার আমার দিকে একবার আলতাফ ভাইয়ের দিকে পালা করে তাকিয়ে শেষে প্রচন্ড হাসিতে ফেটে পড়ল আমাদের মারুফ সেজান।

চার

আমার জীবনটাই ওলট-পালট করে দিল ওই মেয়েটা।

মেয়েটাকে সেদিন দেখার পর থেকেই কী যেন হয়ে গিয়েছিল আমার। চুম্বকের মতো তীব্র এক আকর্ষণে প্রতিদিন বিকেলে রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে যেতাম খবির মিয়ার ডালপুরির হোটেলে। হোটেলের জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। মেয়েটাও জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকত। শুধু তাকিয়ে থাকত, কিছু বলত না, হাসত না, ইশারা করত না। চোখাচোখি হলেই কী যে বিষণœ দৃষ্টিতে তাকাত! ধড়ফড় করে উঠত বুক। দৃষ্টি সরিয়ে নিতাম।

এভাবেই চলছিল। রেললাইন পার হয়ে হোটেলের দিকে যাচ্ছিলাম এক দিন। হঠাৎ জানালার দিকে দৃষ্টি যেতে দেখি, দাঁড়িয়ে আছে ও। আমাকে তাকাতে দেখেই হাত দিয়ে ইশারা করে জানালার নিচে যেতে বললো। নিজের অজান্তেই রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে পড়লাম। শেষ বিকেলের অদ্ভুত সুন্দর মায়াবি আলো মুছে যাচ্ছে দ্রুত; সন্ধ্যে নেমে আসছে আকাশের গা বেয়ে। রেললাইন ধরে অলস পায়ে হাঁটাহাঁটি করছে অনেকে। অনেকে রেললাইনের ওপর জটলা বেঁধে বসে আড্ডা মারছে। কেউ যদি লক্ষ করে আমাদের! বুকের ভেতর গুড় গুড় করে উঠল ভয়ে।

ভ্যাবাচেকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। কী করব বা কী করা উচিত, বুঝে উঠতে পারছি না। মেয়েটা আবারও হাতের অস্থির ইশারায় জানালার নিচে যেতে বললো আমাকে। ওভাবে ডাকতে দেখে ভয়টা বেড়ে গেল আরো।

আমাকে জায়গা থেকে নড়তে না দেখে আরো দুবার হাত দিয়ে ইশারা করে হঠাৎ জানালা দিয়ে কী যেন ছুড়ে মারল ও। ছুড়ে দিয়েই সরে গেল জানালার পাশ থেকে।

হাওয়ায় ভেসে ভেসে সুতোকাটা ঘুড়ির মতো নিচে পড়ল নীল রঙের খামটা। খানিক দূরেই কাগজ কুড়াচ্ছিলো এক টোকাই। খামটা দেখে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে মাটি থেকে খামটা তুলে নিল। তৃপ্তির হাসি হেসে কাঁধে ঝোলানো বস্তায় ভরে ফেলল খামটা। তারপর হাঁটা দিল সামনের দিকে।

‘অ্যাই, অ্যাই ছেলে দাঁড়া!’

চমকে উঠে ঝট করে পেছনে তাকাল টোকাই। পরিষ্কার আতঙ্ক ফুটে উঠতে দেখলাম ওর দুচোখে। আমাকে ওর দিকে এগোতে দেখে একহাতে বস্তাটা শক্ত করে চেপে ধরে হঠাৎ দৌড়াতে শুরু করল।

সব হারানোর ভয়ে আমিও দৌড়াতে শুরু করলাম ওকে লক্ষ করে। সেই সঙ্গে সমানে চেঁচাচ্ছি, ‘অ্যাই! অ্যাই ছেলে! দাঁড়া! অ্যাই শোন ভয় পাসনে। অ্যাই! কিচ্ছু বলব না তোকে! অ্যাই ছেলে, অ্যাই...ই!’

কে শোনে কার কথা। আমাকে ওর পিছু পিছু দৌড়াতে দেখে জান হাতে নিয়ে দৌড়–তে শুরু করল ও। ছুটন্ত অবস্থায় মাঝে মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে বিস্ফারিত চোখে দেখছে আমাকে। রাস্তার লোকজন হাঁ করে দেখছে এই অসম দৌড় প্রতিযোগিতা। অসম হলেও দুজনের মাঝের দূরত্ব কিছুতেই কমিয়ে আনতে পারছি না। বরং ধীরে ধীরে বেড়ে যাচ্ছে দূরত্ব্।

দমের অভাবে হাঁসফাঁস করছে বুকের ভেতরটা। প্রাণপণে ছুটেছি। যে করে হোক পেতেই হবে চিঠিটা। দৌড়াতে দৌড়াতে হঠাৎ একটা এঁদো গলির ভেতর ঢুকে পড়ল টোকাই। ঝড়ের গতিতে আমিও ঢুকে পড়লাম। ডানে-বাঁয়ে ক্রমাগত বাঁক নিতে নিতে উল্টো দিকের মাথা দিয়ে বেরিয়ে এলাম। না, কোথাও নেই ও!

গলির মুখেই পান-সিগারেটের দোকান একটা। বস্তা হাতে এক টোকাইকে পালিয়ে যেতে দেখেছে কি না জিজ্ঞেস করায় উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল লোকটা, ‘বিষয়ডা কী? কী চুরি করছে?’

মেসে ফিরলাম অনেক রাত করে। রাত দশটা পর্যন্ত বসেছিলাম খবির মিয়ার হোটেলে। টিউশনিতে যাওয়ার মতো মানসিক শক্তি ছিল না। একবারের জন্যও জানালায় পাইনি মেয়েটাকে। পাওয়ার উপায়ও ছিল না। হোটেলে ঢুকেই বন্ধ দেখেছি ওর জানালা। রাগে দুঃখে একটার পর একটা সিগারেট টেনেছি আর খবির মিয়ার ক্যাশ কাউন্টারের একপাশে বসানো স্ক্রিন ঝিরঝির করা টিভিতে পুরোনো দিনের হিন্দিগান শুনেছিÑ ‘বাচপান কি মোহাব্বত ও ও/ দিল ভোলানে দে না ও ও...।’

আমাকে এত রাত পর্যন্ত ওভাবে বসে থাকতে দেখে বারবার ভুরু কুঁচকে তাকিয়েছে খবির মিয়া। শেষে কাউন্টার ছেড়ে উঠে এসে সহানুভূতির সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছে, ‘ভাইজানের মনডা কি আইজ খারাপ?’

মেসে ফিরে আলতাফ ভাইকে কানে ইয়ার ফোন লাগানো অবস্থায় সেই চিরায়ত ভঙ্গিতেই পেলাম। মারুফ সেজান ফেরেনি যথারীতি।

আমাকে গম্ভীর হয়ে থাকতে দেখে এফএম রেডিও অফ করে বিছানায় উঠে বসলেন আলতাফ ভাই। ‘কী হে ব্রাদার, মন খারাপ কেন?’

‘কই না তো!’

‘জহুরির চোখ, ব্রাদার। ফাঁকি দেওয়া অত সোজা না। চাকরির জন্য মন খারাপ করবেন না রে ভাই। চাকরি আজ না হোক কাল হবেই। সরকারি না হোক বেসরকারি তো হবেই। ইন্টারভিউ দিয়ে যান, দিতে থাকেন। এই আমাকে দেখেন না। ইন্টারভিউ দিয়েছিলাম তিরিশ বছর বয়সে। অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পেলাম তখন, যখন সরকারি চাকরির বয়স শেষ সেই একত্রিশ বছর বয়সে। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ।’

পরদিন বিকেলে যথারীতি হাজির হলাম খবির মিয়ার ডালপুরির হোটেলে। সারা বিকেল সন্ধ্যে অপেক্ষা করেও জানালায় পেলাম না ওকে। জানালা বন্ধ। একটিবারের জন্যও খোলা হলো না জানালা। পরদিনও একই অবস্থা। তার পরদিনও। এভাবে ক্রমাগত পাঁচ দিন। তত দিনে বুকের খুব গহিনে ভাঙচুর শুরু হয়ে গেছে। কোনো কিছু করতেই ভালো লাগে না। সারা রাত ছটফট করি, ঘুম আসে না। বিকেলের আগেই হাজির হয়ে যাই খবির মিয়ার হোটেলে। দেখা নেই তার। বিশাল জায়গা নিয়ে তোলা দোতলা বাড়িটার সীমানা সুউচ্চ দিয়ে পাঁচিল ঘেরা। এফডিসির সেই মোচু দারোয়ানের মতো ভয়ংকর দর্শন এক দারোয়ান সর্বক্ষণ পাহারায় রয়েছে গেটে। বাড়ির চারদিকে অনেক ঘুরে ঘুরেও এক ঝলকের জন্যও দেখতে পেলাম না বিষণœ সেই অবিশ্বাস্য সৌন্দর্যকে।

সাত দিনের দিন বিকেলে ওখানে গিয়েই চমকে উঠলাম ভীষণ। বিয়ের রঙিন সাজে সেজেছে দোতলা বাড়ি। ঝলমল করছে লাল-নীল নানা রঙের আলোয়। গেটের সামনে বানানো হয়েছে বিশাল এক তোরণ। সেই তোরণ থেকে অনেকটা পথ পেরিয়ে বাড়ি পর্যন্ত দারুণ সুন্দর আলোকসজ্জা। কেন যেন কী এক অজানা হাহাকারে অবশ হয়ে গেল বুকের ভেতরটা।

হোটেলে ঢুকে বরাবরের মতো জানালার পাশের সিটটা খালি পেলাম আজও। সেই জানালাটা আজ খোলা। তবে আজ দুহাতে জানালার গ্রিল ধরে বিষণœ দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেই সে। অনেক নারী-পুরুষের আনাগোনা দেখলাম জানালার ওপাশে। চা আর একটার পর একটা সিগারেট খেতে খেতে সারাক্ষণ তাকিয়ে থেকেও এক পলকের জন্যও পেলাম না ওকে।

একটার পর একটা সিগারেট টেনে যাচ্ছি। ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে মাথার ভেতর। ঠান্ডা মাথায় কিছু ভাবতে পারছি না। এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে সব। সন্ধ্যার মুখে মুখে কী মনে করে যেন হোটেল থেকে বেরিয়ে এলাম। রেললাইন পার হয়ে পা পা করে এগিয়ে গেলাম দোতলা বাড়িটার গেটের দিকে।

বেশ বড়সড় একটা ভিড় জমে আছে গেটের কাছে। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে ভেতর দিকে। দেয়ালের পাশে জটলা পাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য ভিখিরি আর টোকাই। তাদের কারো হাতে থালা, কারো হাতে পলিথিন ব্যাগ। দুটো নেড়ি কুকুর গেট পেরিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ার পাঁয়তারা করছে। দারোয়ানের হাতে বিশাল লাঠিটা দেখে সাহস করে উঠতে পারছে না।

ভিড়ের মাঝে মিশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কতক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, কখন রাত নেমে এসেছে কিছুই বলতে পারব না। হঠাৎ ভিড়ের মাঝে চাপা গুঞ্জন ওঠায় হতচকিত হয়ে উঠলাম। বাড়ির ভেতর থেকে সার বেঁধে এগিয়ে আসছে অনেকগুলো গাড়ি। ফুলে ফুলে রঙিন সামনের গাড়িটা। বনেটের ওপর গোলাপ দিয়ে বিশাল এক হৃদয় বানানো হয়েছে। বিয়ের গাড়িটার সামনে দুটো মোটরসাইকেলে দুজন করে চারজন আরোহী। হর্ন বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে মোটরসাইকেল দুটো।

নিজের অজান্তেই দিশেহারা মানুষের মতো ভিড় ঠেলে সামনে এগিয়ে গেলাম। পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছি গাড়ির দিকে। নববধূর সাজে গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে সে। বেনারসি আর সোনার অলঙ্কারে কী যে অপূর্ব লাগছে তাকে! বরবেশে পাশে বসা বয়সী লোকটা একেবারেই বেমানান তার সঙ্গে। বিশাল ভুঁড়ি বেরিয়ে আছে শেরওয়ানি ঠেলে। আমি নিশ্চিত টাকও আছে লোকটার মাথায়। পাগড়ির আড়ালে আড়াল হয়ে আছে তা।

কাছ থেকে গাড়ির জানালা দিয়ে মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য দেখতে পেলাম তাকে। হেডলাইটের আলোয় সামনেটা উদ্ভাসিত করে পেছনটা আঁধারে ডুবিয়ে সেই আঁধারে আমাকে ঠেলে দিয়ে নববধূবেশে চলে গেল সে।

পাঁচ

ঝিমঝিম রোদের ভেতর দিয়ে হাঁটতে ভালো লাগত আমার। এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই এক দিন দেখা পেয়েছিলাম আশ্চর্য সুন্দর বিষণœ সেই মেয়েটার। সেই মেয়েটা বদলে দিয়েছে আমার জীবন, বদলে দিয়েছে আমার জীবনমাত্রা। এখন আর ভালো লাগে বলে রোদের ভেতর দিয়ে হাঁটি না। হাঁটি ভেতরের তাড়নায়।

আমার মনের খুব ভেতর থেকে কে যেন বলে, এই ঢাকা শহরেরই কোথাও আছে সে। ক্রমাগত শহরের সব অলিগলি চষে বেড়াতে বেড়াতে তারে আমি খুঁজে ফিরি। এভাবে হাঁটতে হাঁটতেই হয়তো কোনো এক দিন কোনো দোতলা বাড়ির জানালায় পেয়ে যাব তাকে। দুহাতে জানালার গ্রিল ধরে বিষণœ দৃষ্টিতে হয়তোবা আমার আশাতেই পথ চেয়ে থাকবে সে।

রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে খবির মিয়ার হোটেলে গিয়ে হাজির হই মাঝে মাঝে। তেমনি আছে সেই জানালা শুধু সে নেই। নিষ্ঠুর এই ঢাকা শহরে, প্রাণহীন এই ঢাকা শহরে দুটো টিউশনির ওপর নির্ভর করে কোনো রকমে টিকে আছি। একটা চাকরির ভীষণ প্রয়োজন আমার। চাকরির খোঁজখবর জানতে চেয়ে বাড়ি থেকে প্রতি হপ্তায় চিঠি পাঠাচ্ছে বাবা। কিন্তু ইদানীং চাকরি খুঁজতে ইচ্ছে করে না আর। একটা প্রাইভেট ফার্মে ইন্টারভিউ ছিল গতকাল। বিশাল লাইন। প্রায় তিন ঘণ্টা বসেছিলাম। আর দুজনের পরই আমার ডাক পড়বে। হঠাৎ দুহাতে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বিষণœ এক নারীমূর্তি ভেসে উঠল মনের পর্দায়। সঙ্গে সঙ্গে উঠে বেরিয়ে এসে উদ্দেশ্যেহীন হাঁটতে শুরু করেছিলাম ঢাকা শহরের ব্যস্ত রাজপথ ধরে।

নীলখাম সেই চিঠিতে কি লিখেছিল সে জানি না। জানতেও পারব না কোনো দিন। তবে কোনো দিন যদি তার দেখা পাই, তাকে হাতজোড় করে বলব, ‘ওগো বিষণœ মেয়ে, সেই নীলখাম চিঠিতে তুমি যা লিখেছিলে তা কি আরেকটিবার লিখে আমাকে দেবে? যদি দাও, তোমার সেই চিঠি সারাটি জীবন বুকের ভেতর আগলে রাখব খুব যতনে।’

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close