মোহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম

  ০৪ জুন, ২০১৯

মুসলিম জীবনে ঈদুল ফিতর

জীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং শক্তির ভারসাম্য বজায় রাখার ফলপ্রসূ পদক্ষেপ রয়েছে ইসলামী জীবন বিধানে। আদম (আ.) থেকেই তার যাত্রা এবং মহানবীর (সা.) মাদানি জীবনের মাধ্যমে তার পূর্ণতা ঘটেছে। আমাদের ঈদ সংস্কৃতি এ মাদানি জীবনেরই একটি অবিচ্ছেদ্য ঘটনা। কোরআনে পূর্ববর্তী যুগের বহু কুসংস্কার (কন্যাসন্তান জীবন্ত কবর দেওয়া, সৎমাকে বিবাহ করা, সুদ প্রতিহত করা, গৃহের পেছন থেকে বের হওয়া ইত্যাদি) দূর করে একটি উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। এ সময় অবাস্তবায়নযোগ্য ও সমাজে হানিকর কোনো পরিকল্পনা যেমন গ্রহণ করা হয়নি, তেমনি জাহিলিয়া বা তার পূর্ব যুগের সব আচার-আচরণের রহিতকরণেরও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। বরং পূর্ব যুগের কল্যাণকর অনেক রীতি ও অনুষ্ঠান বহাল রাখা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার সংশোধিত আকারে পূর্ব যুগের অনুষ্ঠান চালু রাখা হয়েছে। মোটকথা জাহিলিয়া যুগের কল্যাণকর কার্যাবলি এবং সৎ গুণাবলি ইসলামে সমাদৃত হয়েছে।

মুসলমানের জীবনে দুটি উৎসব পালনের নির্দেশ কোরআনের সঙ্গে জড়িত। কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক এক মাস সিয়াম পালন শেষে ঈদুল ফিতর উৎসব পালনের নির্দেশ পালিত হয়। আর ঈদুল আজহার সঙ্গে কোরআনে বর্ণিত মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সন্তান কোরবানি করার ঘটনার সঙ্গে জড়িত। দুটিই যেহেতু কোরআনের সঙ্গে জড়িত, তাই এটি মুসলিম জাতির জন্য মহাখুশিরও দিন। কোরআনে খুশি অর্থে ফারাহা/ইয়াফরাহু (২২ বার) বলে একটি শব্দ উল্লেখ আছে। যেখানে বলা হয়েছেÑ বলো, এই কোরআন তোমাদের প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়াস্বরূপ। সুতরাং এতে তারা আনন্দিত হোক (ফাল-ইয়াফরাহু), তারা যা জমা করে তা অপেক্ষা এটা শ্রেয়। (১০ : ৫৮, ১৩ : ৩৬)। মূলত কোরআনের কারণেই আমাদের ঈদ উৎসব পালনের নির্দেশ। একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান হিসেবে এটি অনুসৃত হলে মানবজীবন উন্নত এবং সমৃদ্ধ না হয়ে পারে না। এখান থেকেই ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার প্রকৃত শিক্ষা উপলব্ধি করা যায়।

মহানবী (সা.) মদিনায় হিজরতের পূর্ব পর্যন্ত মুসলমানদের জীবনে কোনো ঈদের বিধান চালু ছিল না। তিনি যখন সেখানে হিজরত করলেন, দেখতে পেলেন মদিনাবাসী দুটি দিন উৎসব পালন করছে। একটি নওরোজ এবং অন্যটি মেহেরজান উৎসব নামে পরিচিত। এটা ছিল পারসিক সংস্কৃতির উপাদান থেকে ধার করা। মক্কার পৌত্তলিকরা অগ্নি উপাসক পারসিক সংস্কৃতিতে প্রভাবিত ছিল। সুরা রুমের প্রথম আয়াতেই তার একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়। এখানে অশ্লীল, নাচ-গান, বাদ্যযন্ত্র, খেলাধুলা ও কবিতা আবৃত্তির ব্যবস্থা ছিল। মদিনায় আসার পর সাহাবিরা এর বিকল্প একটি উৎসব পালনের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তখনই কোরআন নাজিলের সঙ্গে সম্পৃক্ত রমজান মাসে সিয়াম পালন শেষে ঈদ উৎসবের নির্দেশ জারি করা হয়। দুনিয়ার জীবন থেকে আখেরাতের জীবনকে প্রাধান্য দেওয়ার অনুভূতি নিয়েই এ উৎসব পালনের নির্দেশ এসেছিল। ফলে পূত-পবিত্র অনুভূতি এবং আধ্যাত্মিক শক্তি নিয়ে, ধনী-গরিব সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে শামিল হয়ে মুসলিম শান্তি ও সংহতি প্রতিষ্ঠা পায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের জাতি-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক উৎসব পালন করে থাকে। তবে মুসলমানদের উৎসব ও অন্যান্য জাতি-গোষ্ঠীর উৎসবের মধ্যে পার্থক্য লক্ষ করা যায়। মুসলমানরা যেখানে এক আল্লাহতে বিশ্বাসী হয়ে উৎসব পালনে মেতে ওঠে, সেখানে অন্যরা বহু দেব-দেবীতে বিশ্বাসী হয়ে বছরে বিভিন্ন উৎসব পালন করে থাকে। কোরআনে ইব্রাহিম (আ.) এবং মুসা (আ.)-এর সম্প্রদায়ের লোকেরা মেলা তথা উৎসবের নামে অশ্লীল আয়োজনে মেতে উঠত বলে ইঙ্গিত রয়েছে। মক্কার ওকায মেলায় অশ্লীলতা ছিল বলে নবীজী এই মেলায় মাত্র এক দিন অংশগ্রহণ করেছেন বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। মূলত একটি রুচিশীল, পরিমার্জিত সমৃদ্ধ জীবন প্রতিষ্ঠার চিন্তায় তার সময় অতিবাহিত হয় এবং একসময় তিনি ওহিপ্রাপ্ত হয়ে সেই উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। ওকায মেলাসহ জাহিলিয়া যুগে প্রতিষ্ঠিত মেলার নামে সব অশ্লীলতা সংশ্লিষ্ট উৎসব বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং বলা হয়, ‘ইসলাম ছাড়া যারা বিজাতীয় সংস্কৃতির ধারক-বাহক, তারা আমাদের দলভুক্ত নয়।

মুসলমানদের জীবনে উৎসব পালিত হয় ভাবগাম্ভীর্য এবং তাকওয়া সৃষ্টির প্রেরণা নিয়ে, যা অন্যান্য ধর্মে পালিত উৎসবে কল্পনাও করা যায় না। নারী-পুরুষ ও শিশুদের মধ্যে পবিত্র ভাব সৃষ্টি করাই হয় তার মূল লক্ষ্য। এখানে নারী-পুরুষের মধ্যে অশ্লীলতার কোনো ছাপ থাকে না। মুসলমানদের জীবনের প্রতিটি উৎসবসদৃশ ইবাদতের মধ্যে একটি উন্নত জীবনের পরিচয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে। হোক তা হজ, সিয়াম কিংবা সালাত। ওজু-গোসল করে পূত-পবিত্র অনুভূতি নিয়ে এসব উৎসবে যোগদান করতে হয়। চোখ, হাত, পা- প্রতিটি অঙ্গকে শালীনতার সঙ্গে পরিচালনা করতে হয়। কেয়ামতের দিন এসব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তার কর্মের জন্য জিজ্ঞাসিত হবেÑ এই অনুভূতি নিয়ে মুসলমানদের প্রতিটি উৎসবে হাজির হতে হয়।

মুসলমানদের জীবনে সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন হলো ঈদের দিন। ঈদ শব্দটি আরবি। এর অর্থ আনন্দ উৎসব। যদি শব্দটি আদত থেকে উৎপত্তি হয়, তবে এর অর্থ হয় অভ্যাস। আর যদি আদা-ইয়াউদু থেকে উৎপত্তি হয় তবে এর অর্থ হয় ফিরে ফিরে আসা। বছরে বছরে এটা পালিত হয়, তাই তাকে ঈদ বলা হয়। কোরআনের একটি স্থানে এই ঈদ শব্দটি ভিন্নভাবে দেখা যায়। যেখানে বলা হয়েছেÑ ‘মারইয়াম পুত্র ঈসা (আ.) বলল, হে আল্লাহ, আমাদের প্রতিপালক! তুমি আমাদের জন্য আসমান থেকে খাবার সজ্জিত একটি খাজাঞ্চিখানা পাঠাও, এ হবে আমাদের জন্য, আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তীদের জন্য তোমার কাছ থেকে একটি আনন্দ উৎসব (ঈদ) এবং একটি নিদর্শন।’ (৫ : ১১৪)। ঈদের এই দিনে সব কুসংস্কার ও বিজাতীয় সংস্কৃতির ছোবল থেকে আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close