মুফতি আহমদ আবদুল্লাহ
স্মরণ
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও গৌরবময় বিজয়
বিশ্বের দেশে দেশে যত ইতিহাস আছে, তন্মধ্যে বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস অনন্য। বিশ্বে আর দশটি দেশের বা স্বাধীনতার সঙ্গে বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া কঠিন। শতাব্দীর পর শতাব্দী গৌরবোজ্জ্বল বাঙালি জাতি অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আসছে। অন্যায়, অবিচার, শোষণ, কুশাসন, নির্যাতন কখনো মাথা পেতে নেয়নি। ঝড়-ঝঞ্ঝা, জলোচ্ছ্বাস, দুর্যোগ, দুর্বিপাকে হারায়নি কখনো মনোবল। এক কথায় এদেশের বাঙালিরা অসীম সাহসী। পরাধীন হিসেবে বাংলাদেশের মানুষ কখনো বিবেক বিক্রি করতে বাধ্য হয়নি। উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হলেও এ জাতির বিদ্রোহের শির চিরদিনই উন্নত। তাই রণে ক্লান্ত না হয়ে রক্তাপ্লুত ইতিহাসের মাধ্যমে রচিত করেছে অনন্য ইতিহাস।
বাংলাদেশের গৌরবময় বিজয়ের ইতিহাস স্মরণকালের নৃশংস বর্বরতা ও হত্যাকান্ডের দলিল। সুদীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ ছিল এক বিভীষিকাময় সময়। সে সময়ে ঘরে ঘরে ছিল প্রচন্ড আতংক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। বিভীষিকাময় দিনগুলো ছিল বড়ই যন্ত্রণাক্লিষ্ট ও বেদনা-বিধুর। শান্তির বাতাবরণ ছিল সুদূরপরাহত। হানাদার বাহিনীর পদভারে এ জনপদ হয়ে পড়েছিল বিপদসংকুল। এ দেশের মানুষ প্রতিবাদী ও সংগ্রামী হয়ে ওঠে তখনই যখন জাতীয় স্বার্থের মূলে আঘাত লাগে। যখন তারা নিজস্ব স্বকীয়তা ও জাতিসত্তা বিপন্ন হতে দেখে। জাতিগত বিভেদ, অর্থনীতিক বৈষম্য ও ভাষাগত বঞ্চনা থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত ঘটে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল।
দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ গৌরবোজ্জ্বল বিজয় লাভ করে। যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এ যুদ্ধ ছিল পরস্পর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে। পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের উভয় দেশের জনগণ মুসলিম। ধর্ম-দর্শন ছিল এক ও অভিন্ন। কিন্তু ভাষা, বর্ণ ও সংস্কৃতি ছিল ভিন্ন। জাতিগত পরিচয়ও এক ছিল না। অনেকটা ব্রিটিশদের মতোই। ফলে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য দেখা দেয়। এ বৈষম্যের ব্যবধান দিনে দিনে বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেও এ দেশবাসী সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। তার প্রমাণ, ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের এক মাসের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি ওঠে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সর্বপ্রথম পূর্ব পাকিস্তানে সফরে এসে এক সমাবেশে বললেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ এরই ধারাবাহিতা রক্ষা করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও খাজা নাজিমুদ্দীন একই ভাষণ দেন। সব সমাবেশেই এদেশবাসী না-না-না বলে প্রতিবাদ জানায়।
বস্তুত ১৯৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকেই স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা গতি পায়। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে এ দেশবাসী। ভিন্ন ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি চাপিয়ে দিতে উদ্ধত হয় এক ধর্মের ভিন দেশের শাসকগোষ্ঠী। অথচ ভাষা-সংস্কৃতি দিয়ে জাতি তার নিজস্ব পরিচয় বিহন করে। সংস্কৃতির স্বাধীনতা একটি জাতিকে তার স্বকীয় মহিমায় ভাস্বর করে তোলে। উজ্জ্বল হয় তার স্বরূপ। সেই পরিচয় পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে চেয়েছিল। প্রতিবাদে আন্দোলন বেগবান হয়। প্রতিবাদ গড়ে তোলে সমগ্র জাতি। পরিণতিতে রাজপথ হয় রঞ্জিত। সরকার বাধ্য হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে। এরই ধারাবাহিতায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। মুসলিম লীগ নির্বাচনে পরাজয় বরণ করে। এরপর বাংলাদেশের জনগণ সুসংগঠিত হতে থাকে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। বিজয়ীদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে শুরু হয় গভীর ষড়যন্ত্র। এরই মাঝে ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাসনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় যুদ্ধের প্রস্তুতি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে এ দেশের মানুষের ওপর নেমে আসে ইতিহাসের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ। একই সময়ে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক অংশগ্রণের আহ্বান মানুষকে আলোড়িত করে। শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র যুদ্ধ। নয় মাস অবিরাম এ যুদ্ধ চলে। অবশেষে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে বিজয় পতাকা আকাশে উড্ডীন হয়। বাঙালিরা ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতার লাল সূর্য। তাই ১৬ ডিসেম্বর আমাদের জাতীয় জীবনে এক অনন্য স্মৃতিময় গৌরবময় দিন।
মাত্র নয় মাসের সশস্ত্র যুদ্ধে কোনো জাতির বিজয়ের ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ফিলিস্তিনীরা আজ নিজ দেশে পরবাসী। তারা ১৯৬৭ সাল থেকে আন্দোলন করছে। কাশ্মীরবাসী স্বাধীনতারর জন্য লড়াই করছে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে। ইরাক-আফগানিস্তানে রক্ত ঝরছে প্রায় প্রতিদিন। এসব দেশ কবে নাগাদ স্বাধীন ও নিরাপদ ভূমি হয়ে উঠবে তা বলা সহজ নয়। কিন্তু কেবল বাংলাদেশের জন্য ব্যতিক্রম ইতিহাস রচিত হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের দরবারে আমরা আলাদা জাতি হিসেবে স্বীকৃত। আমরা বাঙালি এবং বাংলাদেশিÑএটাই আমাদের পরিচয়। পাকিস্তান আমলে আমরা এই পরিচয়টুকু গড়ে তুলতে পারিনি। ভৌগোলিক ও জাতিগত পার্থক্যের কারণে তা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
জাতিসত্তার গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, জাতীয়তা। এটাও একটা বোধ এবং চেতনা। যার ভিত্তিমূলে থাকে স্বাধীনতার সচেতন ইচ্ছাশক্তি। আর এ বোধের জন্ম হয় তার জীবনদৃষ্টির ঐক্য থেকে। এ বোধকে জাগিয়ে তুলে জাতি তার দ্বন্দ্ব, সংগ্রাম, ভাষা, সাহিত্য ও আর্থ-সামাজিক সমস্যার সমাধানে সক্ষম। আর ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও জাতিগত বৈষম্য থেকেই জাতিসত্তা ও জাতীয়তাবাদের সূত্রপাত। এ প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বিস্তার লাভ করে। এ কারণে সমগ্র আরব বিশ্ব এক হওয়ার পরও আরব জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠতে পারেনি।
দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি এবং জাতিসত্তার মৌল বৈশিষ্ট্য। দেশপ্রেম মানুষের অন্তরে প্রোথিত থাকে। এ প্রেম কেউ নস্যাৎ করতে পারে না। দেশপ্রেমের আরেকটি দুর্বল দিক হলো, মাতৃভাষার প্রতি গভীর মমত্ব বোধ। দেশের প্রতি ভালোবাসা থাকার সুবাদেই আমরা বিজয় ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। বিজয় এমনিতে আসে না। আন্দোলন ও সংগ্রাম করে তাকে ছিনিয়ে আনতে হয়। এতে রক্ত ঝরা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আজ আমরা গৌরবান্বিত। স্বাধীন দেশে স্বাধীন জাতিসত্তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে অস্তিত্ববান হিসেবে দাঁড়িয়ে আছি। স্বাধীন দেশের নিজস্ব জাতিসত্তার ভিত্তি যতদিন অক্ষুণœ থাকবে, ততদিন আমরা মেরুদন্ডবান জনগোষ্ঠী শত্রু-মিত্র নির্বিশেষে সবার শ্রদ্ধার পাত্র। সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত এলে জাতিসত্তা নির্লিপ্ত থাকতে পারে না। এই স্বতন্ত্র জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা লালন-পালন, বিকাশ ও নিরাপত্তাই সার্বভৌমের মর্মকথা। একে রক্ষার জন্য আমরা অতীতে রক্ত দিয়ে লড়েছি, ভবিষ্যতেও লড়ব। বিজয় দিবসে আমাদের অঙ্গীকারÑরক্ত দিয়ে যে গৌরবোজ্জ্বল বিজয় ছিনিয়ে এনেছি, তা কখনো নস্যাৎ হতে দেব না।
লেখক : শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক
"