ফয়জুন্নেসা মণি

  ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৭

মুক্তিযুদ্ধ

বিজয়ের স্বপ্ন ও সার্থকতার খোঁজে

বিজয় শুধু একটি শব্দ কিংবা কথার কথা নয়। প্রতিটি বিজয় অর্জনের পেছনের গল্পটি অনেক বেদনা ও আত্মত্যাগে রচিত ইতিহাস। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে টানা ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের বিজয় অর্জিত হয়েছে। আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা। একটি স্বাধীন দেশ, একটি মানচিত্র, একটি পতাকা পেয়েছি। এই অর্জন অত সহজে হয়নি। এই বিজয় অর্জনের পেছনে আছে দীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাস। অতীতে নির্যাতন, শোষণ আর পরাধীনতার গ্লানিময় শতাব্দী পেরিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে এসেছে এই বিজয়। এই বিজয় আমাদের অহংকার নাকি অলঙ্কারÑসেই ভাবনাটির সময় এসেছে আজ। কেননা অহংকার শব্দটি নেতিবাচক। এর মাঝে অহংবোধ বা প্রতিশোধ পরায়ণতা বা আক্রোশের ছায়া রয়ে যায়। অলঙ্কার শব্দটি ইতিবাচক গৌরবের অভিলাষ ও স্বপ্নময়। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত বিজয় আমাদের অলঙ্কারই হতে পারে, অহংকার নয়। বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের ৪৬ বছরে পদার্পণÑএকটি দীর্ঘ সময় পরিক্রমা। যাদের আত্মত্যাগে এই বিজয় অর্জিত হয়েছে শুধু আজকের দিনে নয়, আমাদের নাগরিক জীবনে সর্বময় তারা প্রেরণার উৎস। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদ, মুক্তিযোদ্ধা এবং বীরাঙ্গনা জননীদের সবসময় এ জাতি পরম শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটটি ছিল ভিন্ন। শত বছরের অত্যাচার, নির্যাতন, দুঃশাসন আর শোষণের জাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি জাতি স্বাধীনতার স্বকীয়তার জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে জীবনবাজি রেখে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী, পাকিস্তানপন্থি একটা গোষ্ঠী ব্যতীত সবার চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্য ছিল এক ও অভিন্ন। স্বাধীন একটি দেশ। সকল ধর্মের সমান সমান অধিকার। অর্থনৈতিক বৈষম্য, দুঃশাসনমুক্ত, গণতান্ত্রিক একটি দেশের স্বপ্ন নিয়েই যুদ্ধটি ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে ৯ মাসে বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। আমাদের সে সময়ের কাক্সিক্ষত বিজয় অর্জিত হয়েছে; তখন যা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু যুদ্ধটি এখনো চলছে। চলছে তো চলছেই। কারণ, বিজয় অর্জিত হলেও একটি স্বাধীন দেশে সে সময়ের স্বাধীনতাবিরোধীরা রয়ে গেছে আমাদের সহাবস্থানে। আমাদের বিজয় অর্জন, আত্মত্যাগ, স্বাধীন বাংলাদেশের সবকিছুই আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীনতা বিরোধীরাও সমানভাবে উপভোগের সুযোগ পেয়েছে। আর এই

সুযোগকে তারা সর্বোচ্চ ব্যবহারের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলার পতাকাতলে ঘাপটি মেরে ডালপালা ছড়িয়েছে। অনাদর্শের আগাছায় ভরিয়ে দিয়েছে আপামর বাংলাদেশ। স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশটি সঠিক পথে হাঁটেনি প্রায় দুই যুগ। ইত্যাদি নানাবিদ

কারণে আমাদের বিজয়ের সার্থকতা আসেনি। আমরা স্বাধীন ঠিকই; বিজয় অর্জিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মূল্যবোধের বিজয় এখনো আসেনি।

এখন বিজয় অর্জনের ৪৬ বছরে দাঁড়িয়ে সেই বাংলাদেশ আর নেই। ধ্যান-ধারণা, সাফল্য-অর্জন, বাধা-বিসর্জনের জঞ্জাল পেরিয়ে অনেক দূর এগিয়েছে আজকের বাংলাদেশ। বিজয় অর্জিত হয়ে আজি হতে ৪৬ বছর আগে। বিজয় অর্জনের জন্য এই প্রজন্মের নাগরিকেদের তো কিছুই করতে হয়নি। তাই লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই বিজয়ের সার্থকতা খুঁজে বের করার দায়িত্ব এখন আমাদের। এই বিজয় আমাদের গৌরব হতে পারবে তখনই, যখন আমরা বিজয়ের সার্থকতা অর্জন করতে পারব। বিজয়ের ৪৬ বছরে যে বাংলাদেশকে দেখছে বিশ্বÑএই বাংলাদেশ এগিয়ে যাওয়ার বাংলাদেশ। মেধায়, মননে, শৌর্য-সাধনায়, কর্মে-গুণে, তারুণ্যের উদ্ভাসে, প্রযুক্তি দক্ষতায়, বিশ্ব যোগাযোগের সব ক্ষেত্রে দাপুটে বাংলাদেশ সম্ভাবনার লালসবুজ পতাকাকে ভালোবেসে কাজ করে যাচ্ছে। সবার চোখে এগিয়ে চলার স্বপ্ন। হৃদয়ে বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা। তাই জয় অনিবার্য। বাংলা মায়ের সন্তানরা সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিচ্ছে, আমরাই পারি। তাই বিলম্বে হলেও বিজয়ের

সার্থকতা উঠে আসতে শুরু করেছে। আমাদের স্বাধীনতা ঘোষণা আর যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নির্দেশনার অনন্য এক মহাকাব্যের নামÑ ৭ মার্চের ভাষণ। এই মহাকাব্য ইউনেসকো কর্তৃক

বিশ্বসেরা ভাষণের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে। আমাদের ইলিশ, বাউল গান, মঙ্গল শোভাযাত্রা, শীতলপাটি বাংলাদেশের স্বকীয়তা বহন করে জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেটর হিসেবে ইউনেসকোর স্বীকৃতি পেয়ে বিশ্বের মাঝে বাংলাদেশকে অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে।

পাবনার প্রত্যন্ত উপজেলা চাটমোহরে বসে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পণ্যের অনলাইন মার্কেটিং করেন মো. তৌহিদুজ্জামান। ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত রিয়াও ইন্টারন্যাশনাল ইয়ুথ সামিট ২০১৬-এ ‘সেরা অ্যাকশন প্ল্যান’ অ্যাওয়ার্ড জিতেছে বাংলাদেশের আহসান রনি ও তার টিম। সামাজিক উদ্যোগ বিষয়ক একটি প্ল্যান তৈরি করে বিশ্বের ৬টি দেশের ১২ সদস্যের এই দলটি সেরা আইডিয়া বা ‘সেরা অ্যাকশন প্ল্যান’ অ্যাওয়ার্ড জিতে নেয়। যে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে একসময় বিশ্ব পাত্তাই দিত না। এখন বিশ্বের গ্যালারিতে ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অবিরাম। যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন উটাহর মার্স ডেজার্ট রিসার্চ স্টেশনে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সিটি রোভার চ্যালেঞ্জে মঙ্গল গ্রহে রোবটকে আরো ভালোভাবে কাজে লাগানোর উপায় বের করার প্রতিযোগিতায় সফল হয়েছে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের দুটি দল। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) টিম ইন্টারপ্লানেটার পঞ্চম ও ইসলামী ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির রোবটিক ক্রু অষ্টম হয়েছে। প্রতিবছরই যাতায়াত ব্যবস্থাবিষয়ক গবেষণাকর্মে বিশেষ অবদানের জন্য ইয়ং রিসার্চার অব দ্য ইয়ার বা বর্ষসেরা তরুণ বিজ্ঞানীর পুরস্কার দিয়ে থাকে ইন্টারন্যাশনাল ট্রান্সপোর্ট ফোরাম (আইটিএফ)। এই পুরস্কার পেয়েছেন কানাডার ইউনিভার্সিটি অব টরন্টোর পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট ড. মনির মনিরুজ্জামান। গবেষণা শেষে বয়স্কদের হাঁটার সুযোগ বাড়ানোর জন্য শহরাঞ্চলে সুপরিকল্পিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কিছু পরামর্শও দিয়েছেন তিনি। ২০১০ সালে পৃথিবীর ২৫ তরুণ শিল্পোদ্যোক্তার একজন নির্বাচিত হন সাবিরুল। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী ১০০ ব্রিটিশ-বাংলাদেশির তালিকায় নাম এসেছে তার। তার লেখা বই দ্য ওয়ার্ল্ড অ্যাট ইওর ফিট বিক্রি হয়েছে ৬০ হাজার কপি। ১০ লাখ তরুণের মধ্যে উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্নের বীজ বুনে দিতে ২০১১ সালের মে মাসে সাবিরুল শুরু করেন ‘ইন্সপায়ার ওয়ান মিলিয়ন’ কর্মসূচি। যাত্রা শুরু করেছিলেন মালদ্বীপ থেকে। তারপর শ্রীলঙ্কা, ভারত, নাইজেরিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানাসহ বিশ্বের ২৫টি দেশের আট লাখ ৮৫ হাজার মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন। ২৩ সেপ্টেম্বর ২৬তম দেশ হিসেবে তিনি মাতৃভূমি বাংলাদেশে আসেন। প্রায় ৫০০ তরুণের সামনে কথা বলেন সাবিরুল। সাফল্যের স্বপ্ন কীভাবে বুনতে হবে তার পথ দেখিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশকে যারা তুলে ধরেছেন তাদের মধ্যে নাফিস বিন জাফর একজন। কারণ প্রথম কোনো বাংলাদেশি হিসেবে অস্কার জয় করেন তিনি। ২০০৭ সালে হলিউডের ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারিবিয়ান : অ্যাট ওয়ার্ল্ডস এন্ড’ চলচ্চিত্রে ফ্লুইড অ্যানিমেশনের জন্য সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল বিভাগে ডিজিটাল ডোমেইন নামে ভিজ্যুয়াল ইফেক্টস ডেভেলপার কোম্পানির হয়ে দুই সহকর্মী ডাগ রোবেল ও রিয়ো সাকাগুচিসহ নাফিস অস্কার জেতেন। এছাড়া সিনেমায় ব্যবহৃত ‘ড্রপ ডেস্ট্রাকশন টুলকিট’ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য অস্কারের সায়েন্টিফিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল অ্যাওয়ার্ড-২০১৫ জেতেন এই বাংলাদেশি। এমন সাফল্য-সম্ভাবনা খবর অনেক অনেক বলাই যেতে পারে। তার মানে সারাবিশ্বে এখন দাবিয়ে বেড়াচ্ছে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা। নিজেদের মেধা, যোগ্যতার অনন্য স্বাক্ষর রাখছেন বিভিন্ন ক্ষেত্রে। আর স্বপ্ন ছড়িয়ে দিচ্ছেন বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার। প্রেরণা যোগাচ্ছেন তরুণ প্রজন্মের মাঝে বাংলাদেশকে আরো সামনে দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এসব স্বপ্নজয়ী গল্প আর প্রেরণার শক্তিই আমাদের বিজয় অর্জনের সার্থকতাকে জয় করবে। সামাজিক প্রায় সব সূচকে বাংলাদেশ যে ভারতকে ছাপিয়ে গেছে। আর পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটির সঙ্গে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনতে হয়েছে, তাদের সঙ্গে আজকের বাংলাদেশের কোনোই তুলনা হতে পারে না। পাকিস্তান এখন একটি কলুষিত অভিশপ্ত অন্ধকার রাষ্ট্রের প্রতিমূর্তি। অন্যদিকে বাংলাদেশ সাফল্য, সম্ভাবনা আর মানবিক ও শান্তিপ্রিয় সুখী রাষ্ট্রের পথে আলোর দিশারীর ভূমিকায়। সামনে আরো সুদিন অপেক্ষা করছে বাংলাদেশের জন্য। পাঁচ কোটি তরুণ প্রাণ তাদের মেধা আর শ্রম দিয়ে বিশ্বকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেÑ বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বাংলাদেশ অনন্য অসাধারণ শান্তিপ্রিয় একটি মানবিক রাষ্ট্র। এক জরিপ তথ্যে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ তরুণ মনে করেন আগামী ১৫ বছরে বাংলাদেশ আরও সমৃদ্ধি অর্জন করবে। এই তরুণরাই দেশের নেতৃত্ব দিতে আগ্রহী। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে তরুণদের মেধাকে কাজে লাগানোর মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ ও তার জনগণকে নিজের শক্তির দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। হৃদয়ে লালন করতে হবে আমাদের আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা আর বিজয়ের সার্থকতাকে জয় করার স্বপ্ন।

লেখক : কবি, সংগীতজ্ঞ ও শিক্ষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist