মোঃ কায়ছার আলী

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

নিবন্ধ

নারী যোদ্ধার স্বীকৃতি

যে কোনো যুদ্ধে সবচেয়ে প্রথম এবং বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী (বর্তমানে রোহিঙ্গা মহিলারা)। যাদের বয়স ১৫-২৫। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের অবদানে চিরস্মরণীয়, চিরভাস্বর, অম্লান একটি নাম বীরাঙ্গনা। বীরাঙ্গনা নামটির প্রতিফলনে ভেসে উঠে চোখের সামনে বেদনাবিধুর কাহিনি। তাদের কান্না, আর্তনাদ বা আকুতি-মিনতি শয়তানদের মন গলাতে পারেনি। ফলে তাদের ওপর চালানো হয় পাশবিক, অমানবিক ও নৃশংস নির্যাতন। এইসব নির্যাতিত নারীর সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন আকাশ পেলাম। অথচ সমাজে, সংসারে, বাবা এবং মায়ের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি তাদের। বিয়ে হলেও সংসার হয়নি। আর সংসার হলেও তা রক্ষা হয়নি। অনেকে পেটের বাচ্চা নষ্ট করেছিল। কারো সন্তান প্রসব হলে লোকলজ্জার ভয়ে গোপনে তা ফেলে দিয়েছিল। আর অনেকে অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আত্মহত্যা করেছিল। নারী হয়ে জন্ম নেওয়া এবং বীরাঙ্গনা হওয়াই তাদের একমাত্র অপরাধ ছিল। আর সেই অপরাধকে সামনে রেখে আমাদের সমাজ ব্যবস্থা তাদেরকে মহীয়ান না করে ঘৃণাভরে দূরে ঠেলে দিয়েছে। একইসঙ্গে তৈরি করেছে বিতর্ক। ধর্ষিত বা নির্যাতিত নারীর সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের যেন শেষ নেই। সে সময় বিদেশি প্রতিবেদনে এ সংখ্যা ১০ লাখের মতো বলা হয়েছে। ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন তার ‘বীরাঙ্গনা-১৯৭১’ শীর্ষক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, এ সংখ্যা আনুমানিক ছয় লাখের কাছাকাছি। দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় ১৯৭২ সালে প্রকাশিত অস্ট্রেলিয়ান ডা. জিওফ্রে ডেভিসের প্রতিবেদন হতে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা যায়। তিনি নির্যাতিত নারীদের সেবাদানের জন্যই বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার মতে, মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা চার লাখের কম নয়। এই হিসাবের তিনি একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ দিয়েছেন, ধর্ষিতাদের চিকিৎসার জন্য ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় একটি হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। সরকারি কর্মচারীদের হিসাব মতে, ধর্ষিতা মহিলাদের আনুমানিক সংখ্যা দুই লাখ। ডা. ডেভিস বলেন, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই দুই লাখ। অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের সাহায্য সংক্রান্ত কর্মসূচি শুরু হওয়ার আগেই দেড় লাখ থেকে এক লাখ ৭০ হাজার মহিলা গর্ভপাত করেছেন। অবশিষ্ট ৩০ হাজারের মধ্যে কেউ কেউ আত্মহত্যা করেছেন, কেউ কেউ তার শিশুদের নিজের কাছে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু হানাদার বাহিনী গ্রামে গ্রামে হানা দেওয়ার সময় যেসব তরুণীকে ধর্ষণ করেছে তার হিসাবরক্ষণে সরকারি রেকর্ড ব্যর্থ হয়েছে। পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করার জন্য হানাদার বাহিনী অনেক তরুণীকে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব রক্ষিত তরুণীদের অন্তঃসত্ত্বার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে, হয় তাদের পরিত্যাগ করা হয়েছে নয় হত্যা করেছে। স্বাধীনতার মহানায়ক দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ‘বীরাঙ্গনাদের যে তালিকা তৈরি করা হয়েছে তা বিনষ্ট করে ফেলুন, কারণ সমাজ এদের গ্রহণ করবে না।’ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ হলেও সমাজের মূল কাঠামোর কোনো পরিবর্তন হয়নি। তবে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনের জন্য তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বীরাঙ্গনাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘সন্তানদের বাবার নামের জায়গায় তার নাম এবং ঠিকানা ৩২ নম্বর ধানমন্ডি লিখে দিও।’

এখনো সোহাগপুর জেগে আছে সংসারবিহীন এক বিধবা পল্লী হিসেবে। সেই পল্লীর চোখ আছে, অশ্রু নেই। শুকনো পাতার মতো শরীর আছে, শক্তি নেই। কিশমিশের মতো শুকিয়ে যাওয়া অবয়ব আছে, সৌন্দর্য নেই। ঠোঁট আছে, ভাষা নেই। নেই সামাজিক মর্যাদা। অনেক দেরিতে হলেও প্রধনমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২৯ জানুয়ারি ২০১৫ মহান জাতীয় সংসদে বীরাঙ্গনাদের মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দিয়ে প্রস্তাব পাস হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ জারিকৃত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৪১ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে পরবর্তীতে ২০১৬ সালে ১৪ মার্চ ২৬ জন, ২৫ মে ২৩ জন, ২১ জুলাই ৩৩ জন, ১০ আগস্ট ৭ জন, ১ সেপ্টেম্বর ১৬ জন, ১৭ নভেম্বর ২৪ জন, ২০১৭ সালে ৩ জুলাই ১৫ জনসহ মোট ১৮৫ জন নির্যাতিত বীরাঙ্গনাকে প্রথমবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলো। যে স্বীকৃতি দেশ ও জাতির কাছে অনেক আগেই তাদের প্রাপ্য ছিল।

লেখক : শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist