ইয়াসমীন রীমা

  ১৫ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

যক্ষ্মা থেকে রক্ষা

একটি শিশুর শারীরিক সবরকম অসুবিধা সম্পর্কে তার পিতা-মাতা কিংবা অভিভাবক কমবেশি যতœশীল। সামান্য অসুস্থতা অভিভাবকদের যেমন বিচলিত করে তোলে, তেমনি সচেতনতা এনে দেয়। শিশুর যক্ষ্মা রোগ বাংলাদেশে মহামারী আকারে বিস্তার না করলেও এর ব্যাপকতা আছে। দেশে অনেক শিশুই যক্ষ্মা রোগে ভোগে। যক্ষ্মা একটি বায়ুবাহিত সংক্রামক রোগ। মাইক্রোব্যাকটেরিয়াম টিউবারকুলোসিস নামক জীবাণুর দ্বারা সংক্রমিত হয়। মানবদেহে দুই ধরনের যক্ষ্মা হয়ে থাকেÑফুসফুসের যক্ষ্মা, ফুসফুস বহির্ভূত যক্ষ্মা। ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে যক্ষ্মা জীবাণু অন্যের দেহে প্রবেশ করে। এক নাগাড়ে তিন সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কাশি যক্ষ্মার প্রধান লক্ষণ। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ যক্ষ্মার জীবাণু বহন করে। প্রতিবছর প্রায় ৮০ লাখ লোক যক্ষ্মার জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং ২০ লাখ লোক যক্ষ্মায় মারা যায়। ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা, অপুষ্টি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ যক্ষ্মার জীবাণু সংক্রমণের জন্য সহায়ক। এ-কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার যক্ষ্মা আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি, যা বিশ্বের মোট যক্ষ্মা রোগীর শতকরা ৩৬ ভাগ।

বিশ্বে ২২টি যক্ষ্মা ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ পঞ্চম। যক্ষ্মা বাংলাদেশে মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যাগুলো অন্যতম। প্রতিবছর এদেশে প্রায় তিন লাখ লোক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয় এবং ৭০ হাজার মারা যায়। দেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৫০ ভাগ লোক যক্ষ্মার জীবাণু বহন করে এবং ৩১ ভাগ শিশু যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত হয়। মূলত এক থেকে চার বছরের শিশুরাই যক্ষ্মায় বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে, যদিও সকল বয়সের শিশুরাই তাতে আক্রান্ত হয়। আর্থ-সামাজিক অবস্থা খারাপ এমন জনগোষ্ঠী এর প্রধান শিকার। মারাত্মক অপুষ্টি সবচেয়ে বেশি কারণ। আরো যে উপাদানগুলো শিশুর যক্ষ্মা সৃষ্টিতে সহয়তা করেÑহাম, হুপিং কাশি, দীর্ঘ মেয়াদি ডায়ারিয়া কারণ এগুলো শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কমিয়ে দেয়। সাধারণত পরিবার কিংবা প্রতিবেশী বড়দের কেউ যক্ষ্মায় ভুগলে তার সঙ্গে যে শিশুর মেলামেশা হয় সে শিশুর যক্ষ্মা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। যক্ষ্মায় আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশির মাধ্যমে শিশুর দেহে জীবাণু ঢুকে পড়ে শিশু আক্রান্ত হয়ে পড়ে। আমাদের দেশে যক্ষ্মায় আক্রান্ত শিশুর শতকরা প্রায় ৮০ ভাগই ফুসফুসের যক্ষ্মা হিসেবে দেখা যায়। দ্বিতীয়ত, সর্বোচ্চ হচ্ছে শরীরের বিভিন্ন গ্রন্থি বা গ্ল্যান্ডের যক্ষ্মা; তৃতীয়ত, শরীরের বিভিন্ন হাড় যক্ষ্মার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যাকে বলা হয় স্কেলিটাল টিউবারকুলোসিস। এর মধ্যে সমধিক হচ্ছে মেরুদন্ডের যক্ষ্মা বা কেরিস স্পাইন, হিপ ও হাঁটুর যক্ষ্মা। শিশুর ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের যক্ষ্মা হওয়া মারাত্মক ব্যাপার। সাধারণত যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার ছয় মাসের মধ্যে মস্তিষ্কের যক্ষ্মা দেখা দেয়। এছাড়া যক্ষ্মার জীবাণু কিডনি, ক্ষুদ্রান্ত, ত্বক, লিভার ইত্যাদি অংশে আক্রমণ করতে পারে। কিডনির যক্ষ্মা যক্ষ্মার জীবাণু শরীরে প্রবেশ করার প্রায় চার থেকে পাঁচ বছর পর হয়ে থাকে। অন্যদিকে হাড়ের যক্ষ্মা হতে তা সময় নেয় তিন বছরের মতো। যক্ষ্মাজনিত কারণে শিশুর মৃত্যুর মধ্যে ব্রেনের আবরণের যক্ষ্মা (টিউবারকুলাস মেনিনজাইটিস) অন্যতম। এ-রোগে শিশুর ভাবলেশহীনতা, অস্থিরতা, মাথাব্যথা, খাবারে অনিচ্ছা, বমি, জ্বর, খিঁচুনি এক বছরের নিচের বাচ্চার মাথার সামনের দিক ফুলে ওঠা ঘাড় শক্ত হয়ে যাওয়া, কিছুই খেতে না পারা ও জ্ঞান লোপ পাওয়া ইত্যাদি লক্ষণগুলো দেখা যায়। এ লক্ষণগুলোর কোনোটি দেখা দিলে শিশুকে চিকিৎসক দেখানো প্রয়োজন।

শিশুর যক্ষ্মার সাধারণ লক্ষণ অনেক দিন ধরে অল্প জ্বর, কাশি, খিদে কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ, ওজন হ্রাস পাওয়া বা ওজন না বাড়া ইত্যাদি। তবে বড়দের মতো শিশুদের যক্ষ্মা বেশি ছোঁয়াচে হয় না। যক্ষ্মার জীবাণু শিশুর ফুসফুসে প্রবেশ করে যে প্রাথমিক ক্ষত সৃষ্টি করে শতকরা ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে তা নিজে নিজে শুকিয়ে যায়। বড়দের ক্ষেত্রে দেখা যায় তার বিপরীত। শিশুদের যক্ষ্মায় ফুসফুসের কাছাকাছি গ্ল্যাড প্রধানত আক্রান্ত হয়ে থাকে। শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত করা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। বড়দের মতো তাদের রোগ অতো সহজেই নির্র্ণয় করে ফেলা যায় না। তার অন্যতম কারণ, যক্ষ্মা রোগ শনাক্ত করার জন্য তাদের কফ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ হচ্ছে এক দুরূহ ব্যাপার। তারা না পারে কফ বের করে দিতে, আবার তারা যে কফ গিলে ফেলে পাকস্থলী হতে তা সহজে না পারা যায় বের কর আনতে। তবে শিশুর বুকের এক্সরে ফুসফুসের যক্ষ্মা নিরূপণের বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই বলে এক্সরেতে নেগেটিভ ফল দেখে ফুসফুসে যক্ষ্মা নেই মনে করার কোনো কারণ নেই। পজিটিভ টিউবারকুলিন বা মনটো টেস্ট যক্ষ্মা রোগ শনাক্তকরণে আরেকটি সূচক। তবে এই মনটো টেস্ট মারাত্মক অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের বেলায় প্রায়ই নেগেটিভ ফল পাওয়া যায়। সার্বিক বিবেচনায় শিশুদের যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা একটি টিবি স্কোর চার্ট অনুমোদন করেছে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করে জেলা পর্যায়ে একটি থার্মেমিটার ও মনটো টেস্ট ব্যবহার করেই শিশুর যক্ষ্মা রোগ নির্ণয় করা যেতে পারে।

‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নেই’Ñএ রকম ধারণা একসময় প্রচলিত ছিল। যার কারণে ‘রাজরোগ’ নামেও অভিহিত হতো টিবি। আগেকার দিনে যক্ষ্মা রোগের নির্দিষ্ট ওষুধ প্রয়োগ করতে হতো ১৮ মাস থেকে দু’বছর মতো। বর্তমানে অনেক ওষুধ আবিষ্কারের ফলে বেশিরভাগ যক্ষ্মা ছয় মাস নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ ভালো হয়ে যায়। এমনকি চিকিৎসা শুরুর দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগীর রোগ ছড়ানোর ক্ষমতা কমে যায়। ও সমাজের জন্য নিরাপদ হয়ে ওঠে। গর্ভাবস্থায় মায়ের টিবি রোগ থাকলে নবজাতকের টিবি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তখন মায়ের টিবি চিকিৎসা করার পাশাপাশি নবজাত শিশুকেও চিকিৎসা দিতে হতে পারে।

শনাক্তকৃত শিশু যক্ষ্মা রোগীকে বয়সভেদে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ও অনুমোদিত নিয়মিতভাবে ক্রমাগত সঠিক মাত্রায় ছয় মাস ওষুধ খাওয়ালে যক্ষ্মা সেরে যাবে। ১২ বয়সের কম বয়সী শিশুকে প্রথম দু’মাস উন্নতমানের ৩টি ওষুধ সমন্বয়ে ও পরবর্তী ৪ মাস ২টি ওষুধের সমন্বয়ে তৈরি আর ১২ বছরের বেশি বয়সের শিশুকে প্রথম ২ মাস ৪টি ওষুধের সমন্বয়ে তৈরি ট্যাবলেটের দ্বারা শিশুর ওজন ও বয়স অনুযায়ী চিকিৎসা প্রদান করলে এবং শিশুর ওষুধ সেবন নিশ্চিত করলে শিশু যক্ষ্মা থেকে সেরে উঠবে। যাবতীয় ওষুধ দেশের ৪৬০টি উপজেলায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কমপ্লেক্স, বক্ষব্যাধি ক্লিনিক ও হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোয় বিনামূল্যে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। যেসব র্শিশুর বাড়ির বাসিন্দা কফে জীবাণুযুক্ত ফুসফুসের যক্ষ্মা রোগে ভুগছে তাদের যক্ষ্মা প্রতিরোধের জন্য ছয় মাস যাবৎ শিশুর প্রতিকেজি ওজনে প্রতিদিন ৫ মিলিগ্রাম করে আইসোনায়জাইড ওষুধ খাওয়ানো যেতে পারে। ওষুধ খাওয়ানো শেষে তার বিসিজি টিকা না নেওয়া থাকলে তা নিয়ে নিতে হবে।

সারা বিশ্বে যক্ষ্মার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে উঠেছে। যক্ষ্মা বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সর্বস্তরের মানুষের দোরগোড়ায়। দেওয়া হচ্ছে বিনামূল্যে যক্ষ্মা চিকিৎসা। যক্ষ্মা সম্পর্কে সামাজিক ভয় ও কুসংস্কার দূর করতে চলছে সামাজিক সচেতনমূলক কর্মকান্ড। সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ ও সাধারণ মানুষ একযোগে কাজ করছে যক্ষ্মা মোকাবিলায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মা পরিস্থিতিকে ‘বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা’ ঘোষণা করে ২০১৫ সালের মধ্যে যক্ষ্মা রোগী এবং যক্ষ্মায় মৃত্যুর হার অর্ধেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist