মো. আলতাফ হোসেন

  ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৭

মতামত

মুক্তিযুদ্ধ ও ‘বীরাঙ্গনা’ প্রসঙ্গ

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ জীবন অধ্যয়নের একটি বড় দিক। এই যুদ্ধে নারীর ভূমিকা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, নারী তার সর্বাত্মক শক্তি নিয়োগ করেছিল স্বাধীনতার মতো একটি বড় অর্জনে। পুরুষের পাশাপাশি নারীর অংশগ্রহণ ছিল তার জীবনবাজি রাখার ঘটনা। অথচ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীকে মূলধারায় স্থাপন না করার ফলে নারীর প্রকৃত ইতিহাস যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা হয়নি। নারী মুক্তিযুদ্ধে যে গৌরবগাথা রচনা করেছিল তা ধর্ষিত এবং নির্যাতিত নারীর ভূমিকায় অদৃশ্য হয়ে আছে। প্রকৃত অবদান খুঁজে নারীকে মূলধারায় না আনার আরও একটি কারণ, নিম্নবর্গের নারীরাই ব্যাপকভাবে এই যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। নারীর ইতিহাস ক্ষমতাশীল সুশীল সমাজের কাছে ইতিহাসের উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে শুরু করে স্বাধীনতার তিন দশক পর।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অংশগ্রহণ বিষয়ে গবেষণা পর্যায়ে খানিকটা কাজ হয়েছে। কিন্তু সাধারণ শিক্ষিতজন এবং নিরক্ষর অধিকাংশ মানুষের প্রচলিত ধারণায় মুক্তিযুদ্ধে নারীর অংশগ্রহণ ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেনি। নারীযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গুটিকয় নারী। যুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে নারীদের ধর্ষণের ঘটনা প্রচার লাভ করেছে অনেক বেশি। যে কারণে নেতানেত্রী থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং শিক্ষিতজনরা অবলীলায় বলে যান, ৩০ লাখ শহীদ এবং ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা...। ধর্ষণ, নারী নিপীড়নের ঘটনা, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দুর্ঘটনা। যুদ্ধের সময়ে নারী-ধর্ষণ শত্রুপক্ষের যুদ্ধ কৌশল। এর দ্বারা লড়াকু প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে, নৈতিকভাবে দুর্বল করে ফেলার চেষ্টা করা হয়। এখানে ইজ্জতের প্রশ্ন ওঠে না। যুদ্ধে নারীর মর্যাদা সমান ভাবতে হবে। ধর্ষিত নারী বলে তাকে অভিহিত করলে আজীবনের জন্য একটি চিহ্ন তাকে বয়ে বেড়াতে হয়। ধর্ষণকে একটি দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করলে সেটি একটি সাময়িক বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। নারীর মর্যাদাহানিতে লেজুড়ের মতো আটকে থাকে না। এভাবে ভাষা ব্যবহারে পুরুষের আধিপত্য নারীকে বন্দি করে রাখে। কয়েকজনের কথা বললে বোঝা যাবে নারীরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কত বড় সহায়ক শক্তি ছিল। সাধারণ মানুষ জানতে পারবে যুদ্ধ নারীকে কত আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল। বীরপ্রতীক খেতাব পাওয়ার মতো যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তারা সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাননি। অদৃশ্য হয়ে গেছে এসব নারী। এগিয়ে আছে পুরুষরা। কারণ ক্ষমতা, রাজনীতি এবং পুরুষতন্ত্রের সুবাদে পুরুষরা সুযোগ গ্রহণের মুখ্য ভূমিকায় থাকে।

নারীর এই সক্রিয়তা কখনো সরাসরি যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনো বা যুদ্ধক্ষেত্রের আড়ালে থেকে। যেভাবেই হোক এ মহান মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। তাদের বিশ্বাস ছিল অবিচল, সাহস ছিল কঠিন। তারামন বিবির মতো বহু মুক্তিযোদ্ধা আছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস জুগিয়েছেন, প্রেরণা জুগিয়েছেন এমন নারীর সংখ্যাও অসংখ্য। অজানা-অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা শুশ্রƒষা করেছেন বহু নারী নিজের শ্রম দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে। অনাহারি, অর্ধাহারি ক্ষুধার্ত মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন কখনো মমতাময়ী মায়ের মতো, কখনো বা বোনের মতো। নিজেরা খেয়ে না খেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিয়েছেন। চরম দুঃসময়ে পাকিস্তানি হানাদারের হাত থেকে রক্ষা করতে নিজেদের ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন মুক্তিযোদ্ধাদের। সেখানেও ছিল নারীর মমতাময়ী আঁচল। পুরুষের পাশাপাশি সেদিনের নারীর বুদ্ধি-বিচক্ষণতা, আন্তরিকতা এবং সাহসের ফল এই স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধে অস্ত্র হাতে রণাঙ্গনে শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন অনেক নারী। যেমনÑকাঁকন বিবি, তারামন বিবি, শিরিন বানু মিতিল, আশালতা, রওশন আরা। তাদের মতো অনেক নারী সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন, পাকিস্তানি সৈন্যদের খতম করেছেন। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও গোবরা ক্যাম্পে সশস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়েছেন অনেক নারী। কলকাতার পার্ক সার্কাস ও পদ্মপুকুরের মাঝামাঝি গোবরা নামক স্থানে শুধু মহিলা যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য একটি ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছিল। সেটি ‘গোবরা ক্যাম্প’ নামেই পরিচিত। ওই ক্যাম্পটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন আওয়ামী লীগ নেত্রী সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী।

জানা যায়, নারী যোদ্ধাদের জন্য অনুরূপ আরো তিনটি ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে। ‘গোবরা ক্যাম্পে’ মেয়েদের দেওয়া হতো তিন রকম ট্রেনিং। ১. সিভিল ডিফেন্স, ২. নার্সিং, ৩. অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ। সিভিল ডিফেন্সের প্রশিক্ষক ছিলেন শিপ্রা সরকার ও সেবা চৌধুরী। নার্সিং শেখাতেন ডা. মীরালাল ও ডা. দেবী ঘোষ। অস্ত্র চালনা ও গেরিলা আক্রমণ কৌশল শেখাতেন ক্যাপ্টেন এসএম তারেক ও মেজর জয়দীপ সিং। ভারতে শরণার্থী শিবিরে ডাক্তার, নার্স এবং স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে অসংখ্য নারী যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শরণার্থীদের সেবা করেছেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী হিসেবে অংশ নিয়েছেন অনেক নারী শিল্পী। কবি, লেখক, সাংবাদিক এবং শিল্পী এরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। তাদের লেখায় এবং শিল্পীদের গানেও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা। শুধু তাই নয়, পথে-প্রান্তরে অলিগলিতে গান গেয়ে তারা অর্থ সংগ্রহ করেছেন এবং সেই অর্থ মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহায়তার জন্য ব্যয় করেছেন। এরা ছিলেন যুদ্ধের প্রেরণা। আবার দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনীর রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এদেশের গ্রামে-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে অসংখ্য নারী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছেন। জুগিয়েছেন খাদ্য, অস্ত্র বহন করেছেন, লুকিয়ে রেখেছেন, গোপন সংবাদ আনা-নেওয়া করেছেন। যেমনÑকবি সুফিয়া কামাল, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বেবী মওদুদ। এছাড়াও হাজার হাজার নাম না জানা নারী আছেন যারা নিজের সব স্বার্থ ত্যাগ করে, সংসারের বন্ধন ছিন্ন করে দেশমাতার জন্য নিজের সন্তান, কখনোবা স্বামীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সারিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের আশি শতাংশ নারী হয়তো এই শ্রেণিতে পড়েন। অথচ এই নারীরা তাদের অবদানের স্বীকৃতির পরিপূর্ণতা দেখার সুযোগ পেল না আজও। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এদেশের প্রায় তিন লাখ নারী। তারা ধর্ষিত হয়েছেন, নৃশংস নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে শহীদ হয়েছেন, অনেকে মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা সহ্য করেও প্রাণে বেঁচে গেছেন। এরা নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়েও নৈতিকভাবে পরাজিত হননি। এরা আপস করেননি পাকিস্তানিদের সঙ্গে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও এরা স্বামী, পুত্র, ভাইকে ধরিয়ে দেননি শত্রুর হাতে।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সমাজকর্মী

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist