দিলীপ কুমার আগরওয়ালা

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

বায়ু ও পানিদূষণে আমরা

বায়ু ও পানিদূষণ শুধু জনস্বাস্থ্যের জন্যই নয়, দেশের অর্থনীতির জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় বলা হয়েছে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে শহরাঞ্চলের বায়ু ও পানি দূষিত হচ্ছে। বায়ুদূষণের কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশ এক শতাংশ জিডিপি হারাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতির পরিমাণ ২৫০ কোটি মার্কিন ডলার। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। গত রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ফর বাংলাদেশ’ শীর্ষক কর্মশালায় উপস্থাপিত বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়, অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে সৃষ্ট দূষণ পরিস্থিতি বড় এবং ছোট শহরের বাসিন্দাদের ঝুঁকির মুখে ফেলছে।

উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে ঢাকার আশপাশের ছয় লাখ বাসিন্দা, বিশেষ করে শিশুরা তীব্র দূষণের শিকার; যা তাদের দৃষ্টিশক্তি ও স্নায়ুবিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ভারি বৃষ্টিপাতের কারণে শহরগুলো জলাবদ্ধতার সমস্যায় ভুগছে। পানি নিষ্কাশনের ক্ষেত্রে জলাভূমিগুলোর অকার্যকারিতা এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে বেশিরভাগ শহর বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা হয়েছে পাবনার কথা। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা শিল্প ও দুর্বল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শহরগুলোর বাতাস শুধু নয়, ভূ-উপরিস্থ এবং ভূগর্ভস্থ পানি দূষিত করছে।

ডায়িং ও ফিনিশিং ফ্যাক্টরিগুলোর বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলা হচ্ছে। এসব ফ্যাক্টরি পোশাক তৈরিতে ব্যবহৃত প্রতি টন ফেব্রিকের জন্য ২০০ টন বিষাক্ত পানীয় বর্জ্য উৎপন্ন করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। অনুষ্ঠানে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী উল্লেখ করেছেন, পরিবেশদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জিডিপির চার শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বায়ুদূষণ ও পানিদূষণ যেহেতু জনস্বাস্থ্য এবং জাতীয় অর্থনীতির জন্য বিসংবাদ ডেকে আনছে সেহেতু এ বিপদ ঠেকাতে এখন থেকেই সচেতন হতে হবে। অপরিকল্পিত শিল্পায়নের ঝুঁকি এড়াতে পরিবেশবান্ধব শিল্পায়নের পথে এগোতে হবে। যেসব কারণে বায়ু ও পানিদূষণের শিকার হতে হয়, তা রোধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষার টেকসই নীতি গ্রহণে নিতে হবে উদ্যোগ।

মাটির ওপরের ও নিচের পানির যে অবস্থা দাঁড়িয়েছে, বলাই বাহুল্য, তাতে এমন এক সময় আসতে পারে যখন পানযোগ্য ও ব্যবহারযোগ্য পানি পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে, মাটির নিচের পানিও আর এখন যথেষ্ট নিরাপদ নয়। ব্যাপকভাবে পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তর ইতোমধ্যে অনেক নিচে নেমে গেছে। ভূগর্ভে পানি সঙ্কটের প্রতিক্রিয়া হিসেবে বিভিন্ন এলাকার ভূগর্ভস্থ পানিতে অপরিমেয় আর্সেনিক মিশ্রণ ঘটেছে। আর্সেনিক মিশ্রিত পানি পানযোগ্য নয় এবং ফসলাদি আবাদের জন্যও উপযুক্ত নয়। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানি মানুষের জন্য যেমন অপরিহার্য তেমন জীবজন্তু, বৃক্ষলতা, ফসলের জন্যও অপরিহার্য। দূষিত পানি রোগ-ব্যাধির প্রধান কারণ। এটা মানুষের ক্ষেত্রে যেমন সত্য, তেমনি জীবজন্তু, বৃক্ষলতা ও ফসলের ক্ষেত্রেও সত্য। কৃষি উৎপাদন হোক বা শিল্পোৎপাদন হোক, বিশুদ্ধ পানির বিকল্প নেই। পানি নিরাপত্তার অভাবে যেকোনো দেশের তা যত বড় অর্থনীতিই হোক, ভেঙে পড়তে বাধ্য। বিশুদ্ধ পানি ছাড়া সবকিছুই অচল।

এমতাবস্থায়, প্রয়োজনীয় বিশুদ্ধ পানির সংস্থান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দাবি করে। বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির সংস্থান ও জোগান নিশ্চিত করতে হলে অবশ্যই ওপরের ও নিচের পানি দূষণমুক্ত করতে হবে। নদী ও জলাশয়ের পানি দূষণমুক্ত করা বা দূষণ থেকে নিরাপদ করা গেলে ভূগর্ভের পানির ওপর নির্ভরশীলতাও কমাতে পারে। কাজেই সর্বাগ্রে নদী-জলাশয় দূষণমুক্ত করতে হবে, দূষণের প্রক্রিয়া রহিত করতে হবে। এ ব্যাপারে সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জাতীয় স্বার্থেই এই পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন জরুরি। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, পানির পাশাপাশি বায়ুদূষণও বাংলাদেশে ভয়াবহ রূপ লাভ করেছে। রাজধানীসহ বড় শহরগুলোতে মানুষ নিঃশ্বাসের সঙ্গে গ্রহণ করছে নানা প্রকার বিষ ও স্বাস্থ্যহানিকর উপাদান। এ কারণে বিভিন্ন দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ ক্রমবর্ধমান। নির্বিচারে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের ফলে মাটিও দূষণের কবলমুক্ত নয়।

বলা যায়, পরিবেশের সব মৌলিক উপাদানই কোনো না কোনোভাবে দূষণের শিকার। এই সঙ্গে ফল, ফসলও দূষণযুক্ত। তাতে বিভিন্ন প্রকার বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের মাত্রা সহনশীল পর্যায়ে রাখার জন্য উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অপরিহার্য হলেও কোনো ক্ষেত্রেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। কোনো কোনো বর্জ্যরে ক্ষেত্রে কোনোরূপ পরিকাঠামোই নেই। এ প্রসঙ্গে ই-বর্জ্যরে কথা উল্লেখ করা যায়। এটি পরিবেশের ওপর নতুন উপসর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। প্রতিদিন কয়েকশ টন ই-বর্জ্য তৈরি হলেও তা ধ্বংস, রক্ষণাবেক্ষণ বা ব্যবস্থাপনার কোনো পরিকাঠামো নেই। এটা নতুন স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিরাপদ খাদ্য, পানি, বায়ু, মাটি ইত্যাদি মানুষের জন্যই নয়, জীব ও প্রাণিকুলের জন্যও অপরিহার্য। পরিবেশের এসব উপাদান দূষণমুক্ত রাখা সকল প্রাণীর অস্তিত্বের জন্য, সভ্যতার জন্য, উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য একান্তভাবেই আবশ্যক। এদিকে নজর দেওয়াটাই এখন সময়ের বড় দাবি।

লেখক : পরিচালক, ডায়মন্ড ওয়ার্ল্ড লিমিটেড

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist