জি. কে. সাদিক

  ১৩ ডিসেম্বর, ২০১৭

মতামত

মুসলিমবিশ্ব : স্বপ্ন ও বাস্তবতা

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার পর মুসলিম দেশগুলোতে এর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ শুরু হয়। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এর নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের ১৪ সদস্য রাষ্ট্র বেশ জোরের সঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা করেছে। ওয়াশিংটনের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এর নিন্দা জানিয়েছে। লেবাননে মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও করা হয়েছে। বাংলাদেশের ইসলামী দলগুলো মার্কিন দূতাবাস ঘেরাও কর্মসূচি দিয়েছে। প্রায় সব মুসলিম দেশই এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। অতীতেও নানা কারণে অনেক প্রতিবাদ-আন্দোলন হয়েছে, নিন্দার ঝড় উঠেছে। কিন্তু ফিলিস্তিনিদের মুক্তি মেলেনি। লাগাম পড়েনি আগ্রাসী ইসরায়েলের মুখে। অসলো চুক্তির ২৩ বছর পার হচ্ছে, কিন্তু চুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি। ইসরায়েল তার অধিকৃত গাজার পশ্চিম তীর এবং জেরুজালেমে ৮ লাখ অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপন করেছে, নতুন করে আবার ১৪ হাজার বসতি স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প প্রশাসন কানে তুলো দিয়ে তাদের অবৈধ কর্মযজ্ঞ চলিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকে সমালোচনার ঝড়ে পড়েও মার্কিন দূত নিকি হ্যালি বিন্দুমাত্র টলেনি। উল্টো নিজ দেশের ঘৃণ্য কর্মের পক্ষে সাফাই গেয়ে চলেছেন।

মাত্র তিন মাসে সাত লাখ রোহিঙ্গা মুসলিম বিনা অপরাধে তাদের মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত হয়ে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পাড়ি জমিছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা হত্যার শিকার হয়েছে। অনেকের সমুদ্রে-নদীতে সলিল সমাধি হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে সন্ত্রাস দমনের নামে নানা কায়দায় রোহিঙ্গাদের গণহত্যা, ধর্ষণ, উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ, আন্দোলন ও নিন্দার ঝড় উঠেছে, কিন্তু রোহিঙ্গা নিধন থামেনি। আন্তর্জাতিকভাবে চাপের মুখে পড়েও মিয়ানমার টলেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মুসলিম দেশগুলো ও অন্যান্য দেশসহ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘ এবং ওআইসিসহ সবাই ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। কোনো স্থায়ী সমাধান হবে বলেও আলামত নেই। ফিলিস্তিন সমস্যার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকে চারবার আরব ইসরায়েল যুদ্ধ হয়েছে। এছাড়াও নানা সময় ইসরায়েলের সেনাবাহিনীর বুলেট-বোমার সামনে দাঁড়িয়ে মাতৃভূমির মুক্তির দাবিতে হাজার হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনি অকাতরে প্রাণ দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী মুসলিম-অমুসলিম সব দেশেই প্রতিবাদ-আন্দোলন ও নিন্দার ঝড় উঠেছে, কিন্তু থামেনি ফিলিস্তিনি হত্যা, মুক্ত হয়নি আরবদের মাতৃভূমি। থামেনি ইহুদিবাদী ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ। কথিত রকেট হামলার অপবাদে বারবার আরব ভূখন্ডকে রক্তে ভিজিয়েছে তারা। বোমার আঘাতে বাড়িঘর উড়িয়ে দিয়ে গৃহহীনদের মিছিল দীর্ঘ করার ঘৃণ্য প্রয়াসে কোনো ভাটা পড়েনি।

অতীতে যেমন কোনো আন্দোলনই ইসরায়েলের লাগাম টানতে পারেনি। তেমনি জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণার পর মুসলিমদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছে তাতেও কোনো কাজ দিচ্ছে না। প্রতিবাদের গরম খরব মিডিয়াতে কিছুদিন থাকবে আবার নতুন কোনো ইস্যু এলে এটা হারিয়ে যাবে। আর মুসলিম ভূমি দখলমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে যাবে। কারণ ইসরায়েল মধ্যপ্রাচ্যে অস্ত্র ও ক্ষমতা দুই দিক থেকেই অনেক এগিয়ে আছে। শক্তি প্রয়োগ করে ইসরায়েলকে থামানোর মতো ক্ষমতা নেই মুসলিম দেশগুলোর। চারবার আরব ইসরায়েল যুদ্ধের ইতিহাস তাই বলে। বিশ্বজুড়ে যে নিন্দা ও প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়েছে সেটা কানে তোলার কোনো ফুসরত ওয়াশিংটন ও তেলআবিবের নেই। এখানে মানবাধিকার বলে কোনো কথা নেই। স্বার্থসিদ্ধিই মূলকথা। এই স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুকৌশলে ব্যবহার করা হচ্ছে মুসলিম দেশগুলোকেই। ফিলিস্তিন নিয়ে ভাবার সময় নেই সৌদি আরবের। নিজের স্বার্থই শাসক গোষ্ঠীর বড় লক্ষ্য। অন্যদিকে ইয়েমেন ও লিবিয়া এখন নামমাত্র মানচিত্র সর্বস্ব রাষ্ট্র। জেসমিন বিপ্লবের নামে সুকৌশলে এই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর মাজা ভেঙে দিয়েছে কথিত গণতন্ত্রবাদীরা। অদূর ভবিষ্যতেও এই রাষ্ট্রগুলোতে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো লক্ষণ নেই। মিসরে চলছে পশ্চিমা ও আমেরিকার মদদপুষ্ট সেনাশাসন। আফগানিস্তান যুদ্ধবাজদের খেলার মাঠ। যার জন্য চিরস্থায়ী প্রতিপক্ষ তালেবান আছেই। ইরাক ও সিরিয়াতে সরকার আছে, কিন্তু নেই রাষ্ট্রিক কোনো ঐক্য ও সার্বভৌম ক্ষমতা। মন চাইলেই যখন-তখন সিরিয়ার সামরিক স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলার বৈধতার জন্য সন্ত্রাস দমনের ব্যানার লাগায়। কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার মতো শক্তি সিরিয়ার নেই। ঘর সামলাতেই জীবন সাঙ্গ প্রায়।

আধিপত্য বিস্তারের জন্য শিয়া-সুন্নির দ্বন্দ্বের নামে প্রক্সি যুদ্ধে লিপ্ত ইরান-সৌদি আরব। কে কাকে ধ্বংস করবে সেই হিসাব মেলাতেই সময় পাচ্ছে না। ফিলিস্তিন নিয়ে ভাবার সময় কই? সন্ত্রাসবাদের মদদে কাতারে এক অচলাবস্থার জন্ম দিয়েছে সৌদিআরব ও তার মিত্র চার মুসলিম দেশ। রাজতন্ত্রের আসন সুসংহত রাখতে সৌদি আরব ও তার মিত্র মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো ব্যস্ত। কে আসবে ফিলিস্তিন সমস্যার সমাধানে? যারা ওয়াশিংটনের ফটকাবাজি শান্তি প্রতিষ্ঠার আশ্বাসের প্রতি এখনো বিশ্বাস নিয়ে দিনাতিপাত করছে। আরব লিগ জাতিসংঘে জেরুজালেমকে রাজধানী স্বীকৃতির বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রস্তাব তুলবে বলে সিদ্ধান্ত নয়েছে। কিন্তু কথা হলো জাতিসংঘ কি পারবে মার্কিন সিদ্ধান্তের বাইরে এসে কোনো ফয়সালা দিতে? একটি বড় প্রশ্ন ওঠে, শান্তিপ্রতিষ্ঠার নামে সৃষ্ট এই প্রতিষ্ঠানটির অতীত ও বর্তমান সফলতা নিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে জাতিসংঘের জন্ম হয়। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর স্নায়ুযুদ্ধকালীন বিশ্বের দুটি বৃহৎ ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের (সাবেক সোভিয়েত ও আমেরিকা) মধ্যে যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা চলছিল জাতিসংঘ কি পেরেছিল দুই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে? ইরাকযুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠার কোনো সফলতা আছে এই আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের? তেমনি সম্প্রতি পিয়ংইয়ং-ওয়াশিংটন উত্তেজনাও তারা প্রশমিত করতে পারেনি। পারেনি সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে যুদ্ধের দামামা থেকে ফিরিয়ে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করতে। জাতিসংঘ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি। তেমনি পারেনি ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেন নিয়ে কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করতে। ভেটো দানের অধিকারী আমেরিকা ও মিত্রদের পাশে নিয়ে ইসরায়েল বরাবরই জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে। তাহলে আরব লিগ জাতিসংঘে ট্রাম্প সিদ্ধান্তের বিপক্ষে প্রস্তাব তুলে কোনো সুখবর বয়ে আনতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। তবে বোধের দরজা খুলে যাওয়ার প্রশ্নে মুসলিম বিশ্ব কয়েক ধাপ এগিয়েছে বলেই অনেকে মনে করছেন।

অন্যদিকে মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ভূসীমার দূরত্ব না থাকলেও আছে মতাদর্শগত, রাজনীতিগত ও মাযহাবগত বিশাল দূরত্ব। যেটা গুছিয়ে ঐক্যের সম্ভাবনা এ মুহূর্তে খুবই ক্ষীণ হলেও সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। এদিকে সরাসরি না পারলেও সৌদি আরব আকার ইঙ্গিতে মিত্র ওয়াশিংটন ও ইসরায়েলের পক্ষেই আছে। বিশ্বব্যাপী প্রতিবাদ ও নিন্দার ঝড় উঠলেও সৌদি আরবে কোনো সাড়া পড়েনি। যদি রোহিঙ্গা সমস্যার দিকে দৃষ্টি দেই তাহলে মুসলিম দেশগুলোর ঐক্যের সম্ভাবনা কতটা ক্ষীণ তা আরো স্পষ্ট হয়ে যায়। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে মুসলিম দেশগুলো কোনো ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। পারেনি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোনো সমাধান দিতে। স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন এসে যায়, ফিলিস্তিন ইস্যুতে তারা কতটা পারবে? মুসলিম দেশের সাধারণ মানুষ আন্দোলন করলেও একই ইস্যুতে রাষ্ট্রের মাঝে ঐক্যের চিহ্নটুকুও নেই। কারণ তাদের মধ্যে আছে কাঁটাতারের অনতিক্রম্য এক সীমানা। যদিও তারা বিশ্বাসের দিক থেকে এক, অস্তিত্বের প্রশ্নে নয়। মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি নামের সোনার হরিণ এবং দখলমুক্ত মুসলিম ভূমি তথা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বপ্ন সেদিন পূরণ হবে যেদিন মুসলিম দেশগুলো তাদের সীমানার দূরত্ব ঠিক রেখে সব মতভেদ ভুলে এক সারিতে এসে দাঁড়াতে পারবে। আমাদের আকাক্সক্ষাও এর বাইরে নয়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist