সতীর্থ রহমান

  ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

নবান্ন

শ্রেণিহীন উৎসব

গ্রামীণ জনপদে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের মাঠ আছে। মাঠে ফসলও আছে। কিন্তু কৃষকের ঘরে নেই নবান্নের আমেজ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী নবান্ন উৎসব কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। সিকি শতাব্দী আগেও নবান্নের ধান কাটার উৎসবে মুখরিত হতো গ্রামের প্রতিটি আঙিনা। হেমন্তের আহ্বান। অথচ গ্রামীণ জনজীবনে নবান্ন উৎসব এখন শুধুই স্মৃতি।

হেমন্তকালে মাঠে মাঠে দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত সোনালি ধানের ক্ষেত। হেমন্তের বাংলা যেন হেমবরণী শাড়িতে ঢাকা। কমলা রোদে উজ্জ্বল সোনালি ধানের গুচ্ছ। পাকা ধানের সোনালি রং দেখে কৃষকের মন আনন্দে ভরে যায়। এ ঋতু মমতাময়ী জননীর মতো কৃষকের গোলা ভরে দেয় সোনালি ধানে। হৈমন্তী ধানের মিষ্টি গন্ধে আমোদিত হয় চারদিক। ঢেঁকির তালে আর ধান ভানার গানে নবান্নের উৎসবে মেতে ওঠে গ্রামবাসী। চিরাচরিত রীতি ও প্রথা অনুযায়ী আমন ধান কাটার পর অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম বৃহস্পতিবার নবান্ন উৎসব পালিত হতো এবং পুরো অগ্রহায়ণজুড়ে তা চলত। গ্রামবাসী খুব ধুমধামের সঙ্গে নবান্ন উৎসব পালন করতেন। কৃষকের ঘরে তখন খুশির আমেজ বইত-নতুন ধান্যে হবে নবান্ন। এ উপলক্ষে গাঁয়ের বধূরা গুড়, নারকেল, কলা, দুধ প্রভৃতির সঙ্গে নতুন আতপ চাল মিশিয়ে ক্ষীর রাঁধতেন।

কৃষকদের প্রধান ফসল আমন ধান ঘরে তোলার উৎসব। অতীতে নবান্ন ছিল গ্রামবাংলার কৃষক সম্প্রদায়ের অন্যতম প্রধান পার্বণ। কৃষক সাধারণের কাছে নবান্ন উৎসব ছিল অতীব আকর্ষণীয় আর ভালোবাসার। গ্রামের ঘরে ঘরে নবান্নের বিশেষ খাবার পরিবেশিত হতো। ক্ষীর, পায়েস, পিঠা, পুলি, মুড়ি, খৈ, মাছ, মাংস ও রকমারি শাকসবজি দিয়ে গ্রামবাসী রসনা তৃপ্তি করতেন। প্রতিবেশী ও স্বজনদের মধ্যে ক্ষীর আদান-প্রদান চলত। নবান্ন উপলক্ষে গ্রামে খেলাধুলা ও গানবাজনার আসর জমত। নবান্নের আগে গ্রামীণ মহিলারা বাড়ির উঠানে আল্পনা আঁকতেন, ঘরদোর লেপা দিতেন। আগে নবান্নের দিন সকালে কৃষকরা গোসল করে জমিতে ধান কাটতে যেতেন। নবান্নের ধান মাড়াই করার স্থানে লেপা দেওয়ার পর কাঠের পিঁড়ি বা তক্তা বসানো হতো। পিঁড়ির সামনে এড়ে গরুর সামান্য গোবর, কিছু সরিষা দানা ও নড়া রেখে সালাম-সিজদা করে ধান মাড়াই করতেন। এ ধানকে খুব সতর্কতার সঙ্গে মাড়াই করে ঝাড়া হতো। ধান কাটা, মাড়া, সিদ্ধ করা, শুকানো সব কাজ এক দিনেই সম্পন্ন করার নিয়ম ছিল। নবান্নের ধান এক রোদে শুকাতে হয়, বাসি করা যায় না। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি ক্ষীর খাওয়ার মজাটাই ছিল আলাদা। নবান্ন উৎসবের দিনে পল্লীবধূরা শীতের কাপড়-চোপড় (কাঁথা, কম্বল, সোয়েটার, চাদর প্রভৃতি) মাটির তৈরি কুঠি থেকে বের করতেন। নবান্নের আগে যতই শীত পড়–ক না কেন গ্রামবাসী শীতের কাপড় বের করতেন না। আবার শীত শেষে ফাল্গুন মাসে গ্রামের মহিলারা যাবতীয় শীতবস্ত্র ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে কুঠির মধ্যে সংরক্ষণ করতেন।

নবান্ন উৎসব গ্রামবাংলার ঐতিহ্য বহন করে। সোনালি পাকা আমন ধানের মৌ মৌ গন্ধে কৃষকের মন ভরে ওঠে। গ্রামের ঘরে ঘরে আনন্দের বন্যা বইত। এ এক অপূর্ব আনন্দ! শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে ধনী-গরিব সবার জন্য। অবস্থাপন্ন কৃষকরা গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের কাজের বিনিময়ে নবান্নের ধান দিতেন। এ উপলক্ষে গ্রামে ছাগল, গরু-মহিষ জবাই করা হতো। ধনী-গরিব সবাই মাংস ভাগবাটোয়ারা করে নিতেন। গ্রামবাসী মিলেমিশে নবান্নের আয়োজনে মেতে উঠতেন। কমবেশি প্রতিটি বাড়িতেই আত্মীয় সমাগম হতো। গ্রামবাসী একে অন্যের বাড়িতে নবান্নের উৎসবে যোগ দিতেন। ছোটবেলায় দেখেছি আমাদের গ্রামে খুব জাঁকজমকের সঙ্গে নবান্ন উৎসব পালিত হতো। অগ্রহায়ণ মাসের প্রথম শুক্রবার গ্রামবাসী মসজিদে ক্ষীর দিতেন। জুমার নামাজ শেষে উপস্থিত মুসল্লিদের ক্ষীর বিতরণ করতে করতে বিকেল হয়ে যেত। রাতে কবিগানের আসর বসত। একসময় কৃষকদের প্রধান খাদ্যশস্য ছিল আমন। বর্তমানে আমনের জায়গা দখল করেছে ইরি-বোরো ধান। উচ্চফলনশীল জাতের হাইব্রিড ধানের আগ্রাসনের কারণে নবান্ন উৎসব হারিয়ে যাচ্ছে। দিনাজপুর সদরের পল্লীবধূ রাবেয়া বেগমের (৫০) দেওয়া তথ্যমতে, নবান্নের দিনে নয় প্রকার খাদ্য খেতে হয় বলে এর নাম নবান্ন। আগে গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নয় পদের খাদ্য রান্না করা হতো। এগুলো হলো ক্ষীর, ছোলা-মুড়ি, মাষকলাইয়ের ডাল (ভাতের সঙ্গে), আমিলা (চালকুমড়ার সঙ্গে গুড় ও তেঁতুলের টকসহযোগে প্রস্তুত ব্যঞ্জন বিশেষ), মটরশাক, সরিষাশাক, তিন চাউলি (চালের ক্ষুদ ভিজিয়ে দুধ, কলা, চিনি দিয়ে প্রস্তুত মিষ্টান্নজাতীয় খাদ্য), মাংস, মাছ এবং মুলা, বেগুন, শিম প্রভৃতি শীতকালীন শাকসবজি। নবান্ন উপলক্ষে গ্রামের মহিলারা নতুন জামাকাপড় পরতেন এবং বিভিন্ন ধরনের অলংকার সহযোগে সাজগোজ করতেন।

নবান্ন শ্রেণিহীন এক অসাম্প্রদায়িক উৎসব। নবান্ন উৎসব বাঙালি জাতিকে ঐক্য, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ করে। নবান্নের পরশে মানুষ সংস্কৃতিবান হয়। নবান্ন উৎসব বাঙালির জনজীবনে অনাবিল আনন্দ, সুখ ও সমৃদ্ধি বয়ে আনুক-এ প্রত্যাশা সবার।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist