এস এম মুকুল

  ২৪ নভেম্বর, ২০১৭

ভালোমন্দ

সমকালের কড়চা

পাঠ্যবইয়ে অনিয়ম : সরকারের আন্তরিক উদ্যোগ থাকার পরও জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) পাঠ্যবই প্রণয়ন ও মুদ্রণ প্রক্রিয়ায় গলদ রয়ে গেছে। প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে যেমন-পান্ডুলিপি প্রণয়নে কমিটি গঠন, লেখক দলে সদস্য নিয়োগ, বিষয়ভিত্তিক বিশেষজ্ঞ নিয়োগ, বানান সংশোধনে নিয়োগ, সম্পাদনা ও লেখা পরিবর্তন-পরিমার্জনে অনিয়ম ঘটছে। টিআইবির এক গবেষণা প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। পাঠ্যবই মুদ্রণে অনিয়ম সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। বিএসটিআইয়ের সনদবিহীন কাগজ ও নিম্নমানের কালি ব্যবহার করে বই ছাপা হলেও ‘সন্তোষজনক’ উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেওয়া হচ্ছে। বিস্তর অভিযোগ আছে। পাঠ্যবই প্রণয়ন প্রক্রিয়া অস্বচ্ছ এবং রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট, লেখার মতো ‘বিশেষায়িত’ বিষয়কে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, অনেক ক্ষেত্রেই প্রকৃত বিশেষজ্ঞদের পাঠ্যবই প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীর আবদারে পাঠ্যবই পরিবর্তন-সংশোধন করেছে এনসিটিবি, এ পরিবর্তন-সংশোধনের অনেক কিছুই মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা ও মৌলিক চেতনার বিরোধী, পাঠ্যবই ছাপার দরপত্র ডাকায়ও অনিয়ম করা হয়। পছন্দের মুুদ্রণ প্রতিষ্ঠানকে আগেই দর জানিয়ে দিয়ে আর্থিক সুবিধা নেওয়া হয়। একই ব্যক্তির একাধিক প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয়।

মন্তব্য : দুঃখজনক হলেও সত্যিকার বাস্তবতা হলো সরষের ভেতরেই ভূতের বাড়ি। পাঠ্যবই মুদ্রণে যারা অনিয়ম আর দুর্নীতি করে তাদের সন্তান বা প্রজন্মরাও সেই বই পড়ে। তাতে কিইবা যায়-আসে। শিশুদের বই হওয়া উচিত সরল ও সুপাঠ্য উপাদানে ভরপুর। তথ্য, ছবি আর গল্পের বিপুল আয়োজন থাকা চাই। বই অবশ্যই রঙিন, ঝকঝকে ছাপা, উন্নত কাগজ, মননশীল অঙ্কন আর নির্ভুল হওয়া চাই। শিশু-কিশোরদের বইতে মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা, মানবিক মূল্যবোধ এবং উদ্দীপনার গল্প থাকা দরকার। এমন বই প্রণয়নের জন্য ঠিক যে ধরনের ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন এনসিটিবি তার ধারে কাছেও যায় না। ভালো ও ইতিবাচক লেখক, গবেষক, সম্পাদক, অঙ্কন শিল্পী, মুদ্রণে দক্ষ ব্যক্তিদেও মোটেও মূল্যায়ন করা হয় না। প্রতিটি ক্ষেত্রে প্যানেল গঠনে বাছাই কমিটি থাকা দরকার। কিন্তু এই এনসিটিবি কাদের পরামর্শে কী করে তা বহুল বিতর্কিত বিষয় হলেও আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে তাদের কোনো জবাবদিহিতা নেই। বড় অপরাধের পরও কোনো শাস্তি হয় না। গত বছর পাঠ্যবইতে শুধু মুদ্রণ নয়; তথ্য, মৌলিকতা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আদর্শচ্যুত উপস্থাপনার অভিযোগ প্রমাণিত হলে মন্ত্রণালয় থেকে তা সংশোধনের নির্দেশনা দিয়েই দায়মুক্ত হতে দেখেছে জাতি। কেন তাদের শাস্তি হলো না বা দায়িত্বশীলদের রদবদল করা হলো না-জাতির মননে এই প্রশ্ন দানা বাঁধছে। বুঝি না এত কিছুর পরও শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় জেনেশুনে চুপ থাকে কেন, সেটাই মাথায় ঢুকে না। পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যবই প্রণয়ন কমিটিতে যোগ্যদের নিয়োগ ব্যবস্থা অচিরেই কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি এনসিটিবির জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা বাধ্যতামূলক করবেন সরকার; তা না হলে প্রাথমিক বুনিয়াদি শিক্ষায় সরকারের কোনো উদ্যোগের সুফল মিলবে না।

নষ্ট হচ্ছে চাল : সঠিক আর্দ্রতায় ধান কেটে ভাঙানো হলে প্রতিমণ ধানে ৩০ কেজির বেশি চাল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু দেশের অধিকাংশ ধানই সঠিক আর্দ্রতায় কাটা হচ্ছে না। ফলে প্রতিমণ ধান থেকে ২৬-২৮ কেজির বেশি চাল পাওয়া যায় না। ধান থেকে চাল উৎপাদনের এ প্রক্রিয়ায় কেবল অদক্ষতার কারণেই প্রতিবছর নষ্ট হচ্ছে প্রায় ২০ লাখ টন চাল। সাধারণত বাতাসে ১৪ শতাংশ আর্দ্রতা থাকাকালে ধান কাটা হলে প্রতিমণ ধানে প্রায় ৭৫ শতাংশ বা ৩০ কেজি চাল পাওয়া সম্ভব। কিন্তু ২০ শতাংশের বেশি আর্দ্রতায় ধান কাটা হলে সেক্ষেত্রে প্রতিমণ ধানে ৬৫ শতাংশ বা ২৬ কেজি চাল পাওয়া যায়। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে ২২-২৮ শতাংশ আর্দ্রতায় ধান কাটা হচ্ছে। এর মধ্যে সিংহভাগ আমন ধান ১৮-২০ ও বোরো ধান ২০-২৮ মাত্রার আর্দ্রতায় কাটা হয়। সঠিক আর্দ্রতায় না কাটার কারণে নষ্ট হচ্ছে ৫-৬ শতাংশ চাল। দেশে বর্তমানে চালের বার্ষিক উৎপাদন সাড়ে তিন কোটি টন। সে হিসাবে ফসলোত্তর অদক্ষতায় নষ্ট হচ্ছে প্রায় ২০ লাখ টন চাল। জানা গেছে, ধান ভাঙানোর পদ্ধতিতেও রয়েছে দুর্বলতা। ধান চাতালে ভাঙানো হলে অটো ও সেমি অটো চালকলের তুলনায় প্রতিমণ ধানে ২-৫ কেজি বেশি চাল পাওয়া যায়। কিন্তু দেশের সিংহভাগ ধান এখনো অটো ও সেমি অটো চালকলে ভাঙানো হচ্ছে। দেশে চালকলগুলোর মাধ্যমে যে চাল পাওয়া যাচ্ছে, তা বৈশ্বিক গড়ের তুলনায় বেশ কম। চালকলের যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে প্রতিমণ ধানে দু-তিন কেজি চাল ভেঙে যায়। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, অটো এবং সেমি অটো রাইস মিলগুলোর ধান থেকে চাল উৎপাদন ক্ষমতা কম। চাতালকলের মাধ্যমে এক মণ ধান থেকে ৬৮ শতাংশ চাল পাওয়া গেলেও অটোরাইস মিলে ৬২ এবং সেমি অটোরাইস মিলে ৬৩ শতাংশ চাল পাওয়া যায়।

মন্তব্য : আমরা দেখতে পাচ্ছি এক দশকের মধ্যে এই প্রথম চাল নিয়ে বড় ধরনের সংকটে বাংলাদেশ। বিশ্বের চাল উৎপাদনকারী চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন বিশ্বের চাল আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছি আমরা। সঠিক সময়ে দেশের ভেতর থেকে চালের মজুদ না করার কারণে আমদানির নামে গুনতে হয় বাড়তি টাকা। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এমন ভূমিকা সরকারের উন্নয়ন প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় হুমকিস্বরূপ। এই আধুনিক সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার পথে খবরটি হতাশাজনক। এ অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতিপূরণ করে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব নয়। কৃষকের কাছে প্রযুক্তির সুবিধা ও ব্যবহার পদ্ধতি নিয়ে যেতে পারলে নিরক্ষর কৃষকরা দাঁতে কামড় দিয়ে কিংবা চোখের দৃশ্যমান অভিজ্ঞতার আলোকে ধান কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকবেন। সচেতনতা সৃষ্টিতে কৃষি মন্ত্রণালয় প্রশিক্ষণসহ মাঠ পরিদর্শন এবং পরামর্শ সভার আয়োজন করতে পারে। চালকলের যান্ত্রিক ও পদ্ধতিগত দুর্বলতা কাটাতে হবে। উন্নত বিশ্বের মতো আর্দ্রতা পরিমাপক যন্ত্রের মাধ্যমে তা মেপে পরে ধান কাটার ব্যাপারে কৃষকদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। এজন্য স্থানীয় কৃষি অফিস ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে। সমস্যা হয়েছে আমাদের কৃষি অফিসের কর্মকর্তারা মাঠে যান কম, প্রায় ক্ষেত্রে যানই না। নিরুপায় কৃষকরা বাধ্য হয়ে কৃষি অফিসে এসে পরামর্শ নেন। কৃষি কর্মকর্তাদের সাপ্তাহিক ভিত্তিতে মাঠ পরিদর্শন বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। বিভিন্ন অভিমত থেকে জানা যায়, অটোরাইস মিলের তুলনায় চাতালে বা হাসকিং মিলে ধান ভাঙালে চার-ছয় শতাংশ বেশি চাল পাওয়া সম্ভব। এসব বিষয়ে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। অর্থনীতিকে সচল রাখতে কৃষির সঠিক পরিচর্যার বিকল্প নেই। কৃষিকাজকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে প্রয়োজন সঠিক সময়ে কৃষিকাজ সম্পর্কিত সব উপকরণ সার, ডিজেল, কীটনাশক, ভালো বীজ যথাসময়ে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা। গুদামজাতের দুর্বলতায় ইঁদুর খেয়ে ফেলছে বছরে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার চাল। পরিসংখ্যান বলছে, সড়কপথে পরিবহনের কারণে পরিবহন খরচ বেশি হচ্ছে আবার চালও নষ্ট বেশি। ট্রাকের বদলে ট্রেনে চাল বিপণন বা পরিবহন ব্যবস্থায় এ ধরনের অপচয় রোধ করা সম্ভব। ধান কাটা থেকে চাল করা পর্যন্ত সব ধাপে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করলেই ধান এবং ধান থেকে চাল উৎপাদনে বিশ্বে সাফল্যের নজির রাখবে বাংলাদেশ। মনে রাখতে হবে, ধান আমাদের প্রধান অর্থকরী ফসল। সঠিক সময়ে ধান রোপণ করা আর ধান ঘরে তোলা নিশ্চিত করতে পারলেই বছরে বেঁচে যায় হাজার কোটি টাকা। তার পরও আমরা চাল আমদানির নামে কী কারণে প্রতিবছর শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছি-এ প্রশ্ন সবার।

লেখক : বিশ্লেষক, গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist