নূরউদ্দিন আহসান

  ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

বিশ্লেষণ

কৃষি ও কৃষকের বাংলাদেশ

বাংলাদেশ কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশে ৭০ ভাগ মানুষ এখনো কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কৃষিকাজে ব্যস্ত সময় কাটে তাদের। ফসল ফলানোটাই যেন তাদের ধ্যানজ্ঞান। সারাদিন তারা হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে সোনার ফসলের জন্য। সব প্রতিকূলতা প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে দেশকে করে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কৃষকরা যেন কৃষিকাজে তাদের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। ফসলি জমিন যেন তাদের অহংকার, তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাকে ঘিরেই তাদের সব পরিকল্পনা। কিন্তু আজ সেই ৭০ ভাগ মানুষের অবিচ্ছেদ্য অংশ হুমকির মুখে। দিনে দিনে বিলীনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ভূমিদস্যু, দখলদারদের হাতে সব কিছু যেন জিম্মি হয়ে আছে। আর এটা ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালের তুলনায় চাষযোগ্য জমির পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ৭ শতাংশ। অন্যদিকে কৃষিবহির্ভূত জমির পরিমাণ বেড়েছে ৫ শতাংশ। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, দেশে বর্তমানে আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ৮৫,৬০৯৬৪৭৫ হেক্টর। আর আবাদযোগ্য পতিত জমির পরিমাণ ২১০০২৭৯২ হেক্টর। পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতিবছর ফসলি জমির পরিমাণ ৬৮ হাজার ৭০০ হেক্টর করে কমছে। যা মোট জমির শূন্য দশমিক ৭৩৮ শতাংশ। পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, কিভাবে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আয়ের এবং জীবিকার অন্যতম মাধ্যম। এমনিভাবে মানুষের মৌলিক চাহিদা মেটাতে গিয়েও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আবাদযোগ্য জমি। যেমন- ঘরবাড়ি নির্মাণ, রাস্তাঘাট, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিনোদন কেন্দ্র, খেলার মাঠ ও অন্যান্য অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি। এছাড়াও যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিল্পায়ন, নগরায়ণ, শিল্প-কারখানা ও ইটভাটা নির্মাণেও হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আবাদি জমি। তবে কি এসবের প্রয়োজন নেই? হ্যাঁ আছে, এ কথা অস্বীকার করছি না। শিল্প-কারখানার প্রয়োজন রয়েছে। দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে আবশ্যই এসবের প্রয়োজন আছে। তাই বলে আমাদের খাদ্য উৎপাদনের মূল হাতিয়ার নষ্ট করে নয়। এভাবে আবাদি জমি বিলীন হওয়ার দিকে ঠেলে দিলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। আর সময়ের ব্যবধানে দেশ আমদানিনির্ভর হয়ে পড়বে-যা আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিপদসংকেত এবং অচিরেই খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির চরম শিখরে পৌঁছে যাবে। বর্তমানে উন্নত বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায়, তারা তাদের কৃষি জমি ঠিক রেখে শিল্প-কারখানা ও নগরায়ণ গড়ে তুলেছে-যা আমরা আজও পাইনি। একুশ শতকে এসেও তা গড়ে ওঠেনি। শুধু একটা ভালো পরিকল্পনার অভাবে আমরা আজ পিছিয়ে। তবে পরিকল্পনাটা এখন সময়ের দাবি। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে এমন পরিকল্পনা নিতেই হবে। একটি কথা মনে রাখতে হবে, কৃষির সঙ্গে আমাদের দেশের অর্থনীতি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কৃষি ভালো থাকলে ভালো থাকবে আমাদের অর্থনীতি। আর অর্থনীতি ভালো থাকলেই দেশ উন্নত থেকে উন্নতর অবস্থানে পৌঁছে যাবে। যে স্বপ্ন নিয়ে সোনার বাংলা যাত্রা শুরু করেছিল পৌঁছে যাবে সে লক্ষ্যে। আজ অর্থনীতি অনেকটাই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই এত সহজে সব ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া আমাদের দেশের মূল চালিকা শক্তি অর্থনীতির জন্য হুমকি স্বরূপই বটে। অর্থনীতিকে সচল রাখতে কৃষির সঠিক পরিচর্যার বিকল্প নেই। কৃষিকাজে ধান হলো প্রধান অর্থকরী ফসল। যেখানে সঠিক সময়ে ধান রোপণ করতে পারলে বেঁচে যায় বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা। যা আমরা চাল আমদানির নামে প্রতিবছর ব্যয় করে থাকি। আসলে তা আমাদের ব্যর্থতারই ফসল। সঠিক সময়ে দেশের ভেতর থেকে চালের মজুদ না করার কারণে গুনতে হয় এসব বাড়তি টাকা। এ বছরও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। যেখানে চালের মজুদ থাকার কথা ছিল ৮-১০ লাখ টন, সেখানে আছে ৪ লাখ ৪ হাজার টন। ঘাটতি মেটাতে চাল আমদানি করতে পাঁচটি দেশের সঙ্গে চুক্তি করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়। আমাদের একটা সুনাম আছে, বিশ্বের চাল উৎপাদনকারী চতুর্থ অবস্থানে বাংলাদেশ। কিন্তু এখন বিশ্বের চাল আমদানিকারক দেশে পরিণত হয়েছি আমরা। আর এই কৃষিকাজকে সঠিকভাবে পরিচর্যা করতে প্রয়োজন সঠিক সময়ে কৃষিকাজ সম্পর্কিত সব উপকরণ যথাসময়ে কৃষকের কাছে সরবরাহ করা। যেমন- সার, ডিজেল, কীটনাশক, ভালো বীজ ইত্যাদি। কেননা এর ওপর আমাদের ভালো উৎপাদন নির্ভর করে। দেখা যায়, প্রতিবছর কৃষকরা অভিযোগ করে সঠিক সময়ে পায়নি সব উপকরণ। যে জন্য ব্যাহত হয় আমাদের সঠিক উৎপাদন। তবুও যারা শত কষ্ট সহ্য করে মাথার ঘাম পায়ে পেলে নিজের চেষ্টার ত্রুটি না রেখে ফসল ফলায়, শেষ মুহূর্তে তারাই চোখের পানি ফেলে। অনেকে দিশেহারা হয়ে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয়। কৃষি অলাভজনক হওয়ায় কৃষিকাজ বাদ দিয়ে অনেকে হাঁস-মুরগি পালন, মাছ, তামাক চাষ ও ফলের বাগান ইত্যাদি নানা রকম কাজের দিকে ঝুঁকে পড়ে। যা অদূর ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত। এমনকি অনেকে নিজেকে এসব থেকে মুক্ত রেখে শহরের দিকে ধাবিত হয়। যে কারণে সৃষ্টি হয় নানা রকম সমস্যা। যদিও তাদের সম্পদের সঠিক মূল্য পেয়ে হাসি মুখে সময় কাটানোর কথা ছিল। কিন্তু না, সে সুযোগটা কৃষকরা খুব কম সময়েই পেয়ে থাকে। অর্থাৎ তারা তাদের কষ্টার্জিত ফসলের সঠিক মূল্য পায় না। যা তাদের চোখের জলের কারণ হয়। বর্তমান সময়ে কৃষকরা ফসল ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে। বাংলার ঘরে ঘরে নবান্নের ধুম পড়ে গেছে। পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণে চারপাশ ম ম করছে। ঘর ভরা ধান দেখে কৃষক নিজের অজান্তেই খুশিতে চোখের জল ফেলছে। কিন্তু শত আনন্দের মাঝেও রয়েছে একটা বড় ধরনের আশঙ্কা। আর তা হলো তারা কি তাদের কষ্টার্জিত ফসলের সঠিক মূল্য পাবে? সময় এসেছে কৃষককে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করার। অর্থাৎ কষ্টার্জিত ফসলের সঠিক মূল্য দিয়ে তাদের কৃষিকাজের প্রতি উৎসাহিত করা। তারা যেন পরবর্তীতে এ কাজের ওপর নিরাশ না হয়। অলাভজনক বলে যেন হাল ছেড়ে না দেয়। সে দিকে সরকারের সুদৃষ্টি দেওয়ার এখনই সময়।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist