ফয়জুন্নেসা মণি

  ২৩ নভেম্বর, ২০১৭

বই

আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ

মানুষ বই পড়ে আলোকিত হয়। এ জন্য প্রত্যেক শিশুর হাতে বই তুলে দিতে হবে। তবে একটি শিশুর হাতে বই তুলে দেওয়ার প্রকৃত বয়স কত বলতে পারেন। অনেকেই বুঝতে পারা বয়সের কথাই বলবেন। কিন্তু শিশুর হাতে তখনই বই তুলে দিতে হয়, যখন সে বই ছিঁড়তে শেখে। আপনার সন্তানের হাতে বই তুলে দিন, যেভাবে তার হাতে খেলনা তুলে দিয়ে থাকেন। শিশুর মন কাদামাটির মতো। ছোট থেকে বই পড়লে তার মনের ঘরে অন্ধকার সহজে প্রবেশ করতে পারবে না। শিশু ছোট থেকে বই পড়লে তার জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা বাড়বে, নতুন কিছু জানতে ও শিখতে চাইবে। আর বই পড়েই সে তার জ্ঞানের ক্ষুধা খুব সহজেই মেটাতে পারে। তাই আগ্রহ মেটাতে বই আর পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। শিশুর হাতে এক বছরের পর থেকেই বই তুলে দিন। একটি শিশুর সঠিক বিকাশে পরিবারের পর বই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই সময়ে শিশু অল্প অল্প করে সব কিছু জানতে ও বুঝতে শেখে। ফুল, পাখি, প্রাণীর বই এই বয়সের জন্য প্রযোজ্য। এই বয়স থেকে বই নাড়াচাড়া করতে করতে সে চারপাশের জগৎ সম্পর্কে ধারণা পাবে। যেসব শিশু ছোট থেকেই বই পড়ে বা বইয়ের থেকে গল্প পড়ে শোনানো হয়, তাদের কল্পনাশক্তি তার বয়সী অন্য শিশু থেকে বেশি হয়-যারা বই পড়ে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, যাদের কল্পনা শক্তি বেশি তারাই অন্যদের তুলনায় সৃষ্টিশীল কাজে বেশি ভালো করে। তাই সন্তানদের হাতে বই তুলে দেওয়া আরো বেশি জরুরি। কিন্তু আমরা বাবা-মায়েরা সন্তানদের সহজে বই কিনে দিতে চাই না। মনে করি, এই টাকাটাই বুঝি গচ্চা গেল। অথচ এই বাবা-মায়েরাই পরিশীলিত ও মানবীয় সুসন্তান প্রত্যাশা করি। কিন্তু আমরা আগে ভাবি না যে, সন্তানের মানবীয় বিকাশে বইয়ের গুরুত্ব ও অবদান সবচেয়ে বেশি। আমরা এই নির্দ্বিধায় চায়নিজ রেস্টুরেন্টে বা অভিজাত হোটেলে বসে এক-দুই হাজার টাকা অবলীলায় খরচ করতে কার্পণ্য করি না। অথচ বইমেলায় এসে বই কেনার জন্য দুই হাজার টাকার বাজেট থাকে না। এভাবে মানুষ দিনে দিনে বই পড়া থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে শিশুদের। অথচ বই হচ্ছে মানুষের বিনোদনের অন্যতম বড় উৎস। প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পাঠের গুরুত্ব তুলে ধরে অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখা করে আমরা মানুষ হব। আর প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বই পড়লে জ্ঞানের দ্যুতি বাড়বে এবং আমরা আলোকিত হব। সন্তানের যখন মাত্র বুলি ফুটছে তখন থেকেই তার হাতে বই দেওয়ার চেষ্টা করুন। আকর্ষণীয় ইলাস্ট্রেশনযুক্ত বই দেখিয়ে তার কল্পনার জগতের দরজা খুলে দিন এই বয়সেই। বই পড়তে পড়তে আপনার আদরের সোনামণির ওপর যেন একঘেয়েমি ভর না করে। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে ওকে আদর করুন। আপনার সন্তান স্কুলে যাওয়ার উপযুক্ত হলে ওকে বইয়ের লেখক সম্পর্কে ধারণা দিন। ওর সঙ্গে সেভাবেই বই নিয়ে কথা বলুন যেভাবে একজন প্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে বলা হয়।

জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রদূত গ্রিকরা। গ্রিসের থিবসের লাইব্রেরির দরজায় খোদাই করা আছে যে কথাটি সেটি হলো, ‘আত্মার ওষুধ’। অর্থাৎ তাদের বিশ্বাস, বই হলো আত্মার চিকিৎসার প্রধান উপকরণ। বইয়ের প্রতি ভালোবাসা থাকলে পড়াশোনায় আগ্রহ জন্মায় খুব সহজে। পড়াশোনা মানেই অনেকের মতে শুধু স্কুল-কলেজে পড়া- এ কথা সঠিক নয়। শিশু বড় হওয়ার আগেই তাকে তার সত্যিকারের বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিন। মানুষের সবচেয়ে আপন বন্ধু হচ্ছে বই। বই পড়ার সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক অপরিসীম। বই পড়লে মানুষের জ্ঞানের দ্যুতি বাড়ে। আমাদের জীবসত্তা জাগ্রত থাকলেও মানবসত্তা জাগ্রত করার সিঁড়ি হচ্ছে বই। শিশু বড় হওয়ার সময় মা-বাবা সবসময় চিন্তিত থাকেন। শিশু কার সঙ্গে মিশছে, বন্ধু থেকে খারাপ কিছু শিখছে না তো, বন্ধুটা কি আসলেই ওর জন্য ভালো?-এমন চিন্তা মা-বাবার মনে আসবেই। বর্তমান সময়ে যেসব রোগে নতুন প্রজন্ম বেশি মাত্রায় ভুগছে, তার বেশিরভাগের সঙ্গেই মানসিক চাপের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। বই পড়ার অভ্যাস এমন সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। কারণ বই পড়ার সময় মন খুব শান্ত থাকে। সেই সঙ্গে হার্টের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক প্রভৃতি রোগে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ও হ্রাস পেতে থাকে। সন্তানরা একদম বই পড়তে চায় না-অধিকাংশ মায়ের অতি পরিচিত আক্ষেপ। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সেসব মা-বাবা নিজেরাই বই পড়ে না। বই কিনে না। অভিভাবকরা শুরুতে সন্তানদের মাঝে বইয়ের প্রতি ভালোবাসা তৈরির জন্য প্রচুর বই কিনে দিতে হবে। বিভিন্ন দিবস ও সফলতার পুরস্কার হিসেবে বই উপহার দিতে হবে। সন্তানের জন্য বই পড়ার অভ্যাস আগে আপনাকেই আয়ত্ত করতে হবে। গল্প পড়ে শোনানোর সময় চরিত্রের প্রয়োজনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করুন। কখনো কণ্ঠস্বর মোটা করে, কখনো চিকন করে বাচ্চার সামনে গল্পের চরিত্রগুলো চিত্রায়িত করুন। পরবর্তীকালে নিজেই লক্ষ করবেন আপনার সন্তানের কাছে বই হয়ে গেছে আনন্দের অপর নাম। অনেকে আজকাল আর কাউকে বই উপহার দেয় না। বই মানুষের মনকে সুন্দর করে। মানুষের মনকে সুন্দর করার জন্য বই হলো সবচেয়ে ভালো উপহার। এমন ছোট্ট প্রচেষ্টা অনেক দিক দিয়ে সুফল বয়ে আনবে। কেননা জ্ঞানের সূচনা বই থেকেই এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়ে পেয়ে থাকে। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে হতে পারে। মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ বই পড়ার প্রতি এত বেশি আসক্ত ছিলেন যে, লাইব্রেরি কক্ষে কর্মচারীরা তার নিবিষ্ট পাঠক মনের উপস্থিতি পর্যন্ত টের পেত না। তাই বহুবার তিনি লাইব্রেরি কক্ষে তালাবন্দি হয়েছেন।

মানুষের মন একটা ঘরের ন্যায়। সে ঘরের আলো হিসেবে কাজ করে বই। বই থেকে মানুষ অনেক কিছু জানে, বই মানুষকে ভাবতে শেখায়, অজানাকে জানার সুযোগ করে দেয় বই। তাই বই পড়লে মানুষ আলোকিত হয়, আলোকিত হয় তার মন। নেপোলিয়ান বলেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সঙ্গে না থাকলে জীবন অচল।’ বই পড়লে আমাদের মস্তিষ্ক চিন্তা করার খোরাক পায়, সৃজনশীলতা বাড়ে এবং তথ্য ধরে রাখার ক্ষমতা সৃষ্টি হয়। বই পড়লে মানুষ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক মনস্ক হয়ে ওঠে। একটি জটিল কঠিন বিষয়কে সহজ করতে পারে বই। বিজ্ঞান মতে, মন এবং মস্তিষ্কের ক্লান্তি দূর করতে টেলিভিশনের পরিবর্তে বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব করুন। কারণ বই পড়লে শরীরের উপকার হয়, টিভি দেখলে নয়। বই পড়ার সময় মস্তিষ্কের মধ্যে থাকা হাজারো নিউরন বেশি বেশি কাজ শুরু করে। ফলে সার্বিকভাবে মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে একদিকে যেমন বুদ্ধির বিকাশ ঘটে, তেমনি নানা ধরনের ব্রেন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও কমে যায়।

চীনারা বলত, বই হলো এমন একটা বাগান যা পকেটে নিয়ে ঘোরা যায়। মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষের পাঠ অভ্যাসের তথ্য পাওয়া যায়। মানুষ বই পড়ে মনের খোরাকের জন্য, অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এবং নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করার জন্য। বই পড়ে একজন মানুষ তার চিন্তার পৃথিবীকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পারে। আসুন আমরাও আমাদের চিন্তার পৃথিবীকে সমৃদ্ধ করার পথে এগিয়ে যাই।

লেখক : কবি ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist