এস এম মুকুল

  ২২ নভেম্বর, ২০১৭

পরিপ্রেক্ষিত

অন্ধ শিকারি বনাম ডাক্তার

রোগীর পেছনে সবচেয়ে কম সময় ব্যয় করেন বাংলাদেশের চিকিৎসকরা-এমন খবর নাগরিক হিসেবে সবাইকে আহত করাই স্বাভাবিক। চিকিৎসা সাময়িকী ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালে (বিএমজে) প্রকাশিত এক আন্তর্জাতিক গবেষণায় জানানো হয় বাংলাদেশে একজন রোগীর পেছনে গড়ে মাত্র ৪৮ সেকেন্ড সময় দেন চিকিৎসকরা! ৬৭টি দেশের ওপর করা গবেষণার ভিত্তিতে তৈরি এই প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিতে আসা একজন রোগীর পেছনে সবচেয়ে বেশি ২২ মিনিটের বেশি সময় দেয় সুইডেনের চিকিৎসকরা। বাংলাদেশের প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের চিকিৎসকরা রোগীপ্রতি গড়ে ২.৩ মিনিট, পাকিস্তানের চিকিৎসকরা রোগীপ্রতি গড়ে ১.৩ মিনিট এবং চীনের চিকিৎসকরা রোগীপ্রতি গড়ে ২ মিনিট সময় দেন। এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় রোগীপ্রতি গড়ে সাড়ে ৯ মিনিট সময় দেন। রোগীর কাছে একজন চিকিৎসক মহান প্রতিপালকের পরেই আস্থার প্রতীক- ভরাসাস্থল। দুঃখজনক হলেও সত্য, মহৎ এই পেশার লোক হয়ে আমাদের মহান চিকিৎসকরা মানবিক সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করছেন না। ঢালাওভাবে বলা ঠিক নয়, তবে মোটা দাগে বলা যায়-এ পেশার মহান মর্যাদা ধরে রাখতে পারছেন না দেশের চিকিৎসকরা। অধিকাংশ চিকিৎসক হালের হাওয়ায় গা ভাসিয়ে অন্ধ শিকারির ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে ছুরি চালাচ্ছেন দুর্বল-অসহায় রোগীদের ওপর। চিকিৎসকদের আদর্শহীনতা ও অপেশাদারী মনোভাব জনমনে ভীতির সঞ্চার করলেও থামছে না তাদের অর্থ উপার্জনের অতৃপ্ত বাসনা। তাহলে কি চিকৎসকরা মানি আর্নিং মেশিন বা টাকা কামানোর যন্ত্র- এমন প্রশ্নও সামনে আসা আজ অবান্তর নয়।

মহান এই পেশার প্রতি সম্মান রেখেই অনুরোধ করি, প্রিয় চিকিৎসকরা আপনারা সেবায় ব্রতী হোন। আপনারা চাইলেই আর্থিক, মানসিক ও শারীরিক সুস্থতায় ধন্য করে তুলতে পারেন একটি মানব জীবন। সম্মানিত চিকিৎসকরা আমার কথায় আশা করি আহত হবেন না। একজন মানুষ হিসেবে শারীরিক সুস্থতা-অসুস্থতা আমারও হয়। আমিও আপনাদেরই কারো না কারো শরণাপন্ন হই। আল্লাহর রহমতে আপনাদেরই সেবা-পরামর্শে আরোগ্য লাভ করি। পেশা নিয়ে কৌতুক করা শোভনীয় নয়, তবুও একটি প্রচলিত কৌতুক মনে পড়ে গেল- ‘বিধাতাকে খেপাবেন না, তিনি খেপলে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেন। আর ডাক্তারকে খেপাবেন না, কারণ তিনি খেপলে সোজা বিধাতার কাছে পাঠিয়ে দেন।’ কৌতুক হলেও বাস্তবতার সঙ্গে এর মিল অতীব দুঃখজনক।

চিকিৎসা একটি মহৎ ও মানবীয় পেশা। পৃথিবীতে তিনটি পেশাকে মহৎ বলা হয়। চিকিৎসা পেশা তার মধ্যে অন্যতম একটি। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে এ পেশায় যারা আসেন সেবার মানসিকতা নিয়েই আসা উচিৎ।

রোগ নির্ণয়ে বা নিরাময়ে একজন চিকিৎসকের কী করা উচিত সে ব্যাপারে চিকিৎসাশাস্ত্রে নির্দেশনা নিশ্চয়ই আছে। রোগীদের প্রত্যাশা- রোগীর সমস্যা শোনা, প্রশ্ন করা ও কথা বলতে দেওয়া, শারীরিকভাবে দেখা বা পর্যবেক্ষণ করা এবং শেষে উপদেশপত্র দেওয়া। কিন্তু একজন অসহায় রোগী কি অন্যায্য ফি দিয়েও ন্যায্য সেবাটুকু পাচ্ছেন? এমন প্রশ্ন হয়ত প্রশ্নই থেকে যাবে। চিকিৎসক রোগীর কাছে ফেরেশতার মতো। অসুস্থ হলে বিধাতার পরই তার ওপর ভরসা। তবে কি বর্তমানে সেই ভরসার খেসারত দিচ্ছে রোগীরা?

চিকিৎসার মতো সেবাধর্মী মহৎ পেশায় নিয়োজিতদের কাছে মানবিক আচরণই সাধারণের প্রত্যাশা। কিন্তু আমরা বেদনাহত হই যখন দেখি, হাসপাতালে অসুখে রোগী কাতরাচ্ছে আর চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করছেন। চিকিৎসকরাও মানুষ, তাদের ওপর অন্যায় বা জুলুম হলে ত্বরিত যথাযথ ব্যবস্থারও দাবি জানাই। তবু এমন আন্দোলন চাই না, যাতে রোগী বা অসহায় মানুষের জীবন নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। চিকিৎসকরাও মানুষ। তাদেরও জীবন সংসার, সমাজ-সামাজিকতা, স্বপ্ন ও উচ্চাকাক্সক্ষা আছে। তাদের চাহিদা অবশ্য পূরণীয়, কিন্তু এখন জনমনে প্রশ্ন- একজন চিকিৎসকের কত টাকা চাই। টাকা কামানোর জন্য চিকিৎসকরা হন্যে হয়ে পড়েছেন। একজন চিকিৎসক দিনে কতজন রোগী দেখতে পারেন, কতজন রোগীকেই বা দেখা উচিত তার কি কোনো সীমারেখা আছে? বাস্তবতা হলো- আমাদের দেশের চিকিৎসক যত বড়, তার পেছনে রোগীদের তত বড় লাইন। যদিও বড় ডাক্তার বলে কোনো শব্দ নেই, বিষয়টি হবে ভালো ডাক্তার। তবু আমাদের সমাজের ধারণা- যে চিকিৎসকের ফিস বেশি, এফসিপিএস করা বা প্রফেসর তিনি বড় বা ভালো চিকিৎসক। বিষয়টির সঙ্গে অনেকেরই দ্বিমত আছে। একজন চিকিৎসক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ও নিষ্ঠাবান হতে পারেন। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। আজকের আলোচনা চিকিৎসা পেশা ও চিকিৎসকদের নৈতিকতা নিয়ে।

চিকিৎসকরা সমাজের সভ্য মানুষ। মানুষের জীবন-মরণের সঙ্গে তাদের পেশার সম্পর্ক। তাই চিকিৎসকের প্রতি রাষ্ট্র কিংবা জনগণ অবিচার করতে পারে না। তেমনি চিকিৎসকরা কর্মবিরতি দিয়ে রোগীদের জীবন নিয়ে তামাশা করবেন-এটা মেনে নেওয়া যায় না। এ বিষয়ে আইন থাকা উচিত। চিকিৎসা পেশায় কর্মবিরতি নয়, প্রতিবাদের আরো অনেক উপায় আছে। চিকিৎসকের কাছে সাধারণের প্রত্যাশা-তিনি মন দিয়ে রোগীর কথাগুলো শুনবেন, পরামর্শ এবং বেঁচে থাকার আশ্বাস দেবেন। এইটুকু যদি চিকিৎসকের কাছে পাওয়া যেত তাহলে কচু কাটার মতো করে দেশে সিজারের নামে অযথা পেট কেটে নারীদের জীবনক্ষয় করা হতো না। সুচিকিৎসার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা আবশ্যক বিষয়। কিন্তু কমিশনের জন্য চিকিৎসকরা প্রয়োজনের বাইরেও অযথা অতিরিক্ত পরীক্ষা করিয়ে রোগীকে আর্থিক ও মানসিকভাবে আরো অসুস্থ করে তোলেন। এই বিষয়ের জন্য কোনো প্রমাণ দিতে হবে না। ভুল চিকিৎসা তো আছেই। ওষুধ কোম্পানির নজরানা পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত ওষুধ এবং এন্টিবায়োটিক দিয়ে রোগীর বারোটা বাজাচ্ছেন কোনো কোনো চিকিৎসক। তারপর একজন চিকিৎসক নিজেই নিজের ইচ্ছে মতো ভিজিট বা সম্মানী ঠিক করেন ও তা রোগীদের কাছ থেকে নেন।

দুঃখজনক হলেও সত্য যে, চিকিৎসকদের এখন অনেকে কসাইয়ের সঙ্গে তুলনা করে। আমরা জানি, বর্তমানে ওষুধের বাণিজ্য ভয়াবহ হয়ে উঠেছে চিকিৎসকদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে। চিকিৎসকের উপদেশপত্রের মাধ্যমে নাম না জানা কোম্পানির ওষুধ গ্রহণ করছেন রোগীরা। এমন অভিযোগ মিথ্যে নয় যে, চিকিৎসকদের উৎসাহিত করা হয় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে রোগীদের বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করানোর জন্য। এসবের প্রমাণ মেলে প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে চিকিৎসকের উপদেশপত্র স্ক্যান বা ফটোকপি করে রাখা হয়। চেম্বার থেকে বের হতেই ওষুধ প্রতিনিধিরা ঘিরে ধরে উপদেশপত্রটি মোবাইল ক্যামেরায় বন্দি করে নেন। জীবন নিয়ে বাণিজ্য আর কাকে বলে। এ বিষয়ে স্বনামখ্যাত কোম্পানির একজন প্রতিনিধির কাছে জানতে চাইলে তিনি বিস্ময়কর তথ্য জানান। তার অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, বিভিন্ন সুবিধা আদায়ে চিকিৎসকদের চক্ষুলজ্জা পর্যন্ত নেই। তারা ওষুধ কোম্পানি থেকে বিভিন্ন উপঢৌকন হিসেবে সাপ্তাহিক, মাসিক অথবা বার্ষিকভাবে আর্থিক সুবিধা, ফ্ল্যাটের মাসিক কিস্তি বা গাড়ির কিস্তি, গৃহস্থালির জিনিসপত্র, বিদেশযাত্রা, দেশের অভ্যন্তরে যাতায়াতে বিমান টিকিট থেকে শুরু করে পরিবারের সদস্যদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে উপহার হিসেবে আর্থিক সুবিধাও নিয়ে থাকেন।

চিকিৎসককে দেওয়া ওষুধ কোম্পানির লোভনীয় প্রস্তাব অবশ্যই বর্জনীয় হওয়া উচিত। তারা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাভের চাপে এবং নিজের আকর্ষণীয় কমিশনের লোভে পড়ে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে একগাদা পরীক্ষার অযথাই আর্থিক ব্যয়ভার চাপিয়ে দেন নিরীহ রোগীদের ওপর। শোনা যায়, মনঃপূত আর্থিক আয় না হলে ছুরি-চাকু চালাতে অস্থির হয়ে ওঠেন একশ্রেণির চিকিৎসক। যেভাবেই হোক না কেন অর্থ উপার্জন করতেই হবে। দেশে অসাধু, অর্থলোভী চিকিৎসকের যেমন অন্ত নেই- তেমনি ভালো, অমায়িক, মানবদরদি চিকিৎসকেরাও নিভৃতে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। একটি গল্পের মাধ্যমে শেষ করব লেখাটি। একজন ডাক্তার একটি জরুরি সার্জারির জন্য তাড়াহুড়া করে আরেক ডাক্তারকে হাসপাতালে ডেকে পাঠালে তিনি দ্রুত হাসপাতালে পৌঁছে গেলেন। হাসপাতালে ঢুকেই তিনি নিজে প্রস্তুত হয়ে অপারেশন থিয়েটারের দিকে এগিয়ে গিয়ে দেখলেন রোগীর (একটি ছোট্ট ছেলে) বাবা অস্থির হয়ে পায়চারি করছেন। ডাক্তারকে দেখামাত্র লোকটি উত্তেজিত হয়ে বললেন, আপনার আসতে এত দেরি হলো? দায়িত্ববোধ বলতে কিছু নেই আপনার? আপনি জানেন আমার ছেলে কত যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে? ডাক্তার মুচকি হেসে বললেন, আমি দুঃখিত, আমি হাসপাতালে ছিলাম না, বাসা থেকে আসতে দেরি হলো। আপনি শান্ত হলে আমি অপারেশন শুরু করতে পারি। লোকটি রাগত স্বরে বললেন, শান্ত হব আমি? আপনার সন্তান যদি আজ এখানে থাকত তবে বুঝতেন। ডাক্তার আবার হাসলেন আর বললেন, ডাক্তার কাউকে দীর্ঘ জীবন দান করতে পারেন না। আপনি আপনার সন্তানের জন্য প্রার্থনা করতে থাকুন, আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব-এই বলে ডাক্তার কক্ষে প্রবেশ করলেন।

লেখক : বিশ্লেষক ও উন্নয়ন গবেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist