মীম মিজান

  ২০ নভেম্বর, ২০১৭

স্মরণ

বেগম সুফিয়া কামাল

বাংলা, বাঙালি, বাংলা সংস্কৃতি ও পিছিয়ে থাকা নারী জাতি যার মাধ্যমে পেয়েছে এগিয়ে যাওয়ার এক অফুরান গতি; তিনি হলেন মহীয়সী নারী ও প্রতিভাবান কবি বেগম সুফিয়া কামাল। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি যেমন করেছেন ঋদ্ধ; তেমনি সমাজ সংস্কারমূলক কাজেও তার অবদান নারী হিসেবে শীর্ষস্থান লাভের দাবিদার। তার জীবন বহুমুখী। তার সৃজনকর্মও বহুমুখী।

এ দেশের নারীমুক্তি আন্দোলনের যে ধারাটির সূত্রপাত ঘটিয়েছিলেন তারই অগ্রজ মহীয়সী রমণী বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, তারই সুযোগ্য উত্তরসূরি ছিলেন একালের কবি বেগম সুফিয়া কামাল। বেগম রোকেয়াকে সংগ্রাম করতে হয়েছিল তৎকালীন সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মান্ধতা, পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, হীনতা এবং সংকীর্ণতাপীড়িত সমাজের বিরুদ্ধে। আর তারই পথ ধরে বেগম সুফিয়া কামালকে পরবর্তীকালে সাহিত্য রচনার পাশাপাশি নিজেকে যুক্ত করতে হয়েছিল মানবমুক্তির বৃহত্তর আন্দোলনের সঙ্গে। বাংলাদেশে নারীমুক্তি আন্দোনের পুরোধা এবং কুসংস্কারবিরোধী প্রগতিশলি নারী হিসেবে তিনি জীবিতকালেই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। সারাজীবন ১৬টি সংগঠনের সভানেত্রী হিসেবে কাজ করেছেন।

এ শক্তিমান কবি ও নারীনেত্রী ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের ২০ জুন (সোমবার, ১০ আষাঢ় ১৩১৮ বঙ্গাব্দ), বেলা ৩টায়, বরিশালের শায়েস্তাবাদস্থ রাহাত মঞ্জিলে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন সমাজের নানা কুসংস্কারের মধ্যেও তিনি স্বশিক্ষিত হয়েছেন। অনেক চড়াই-উতরাই পার করে দ্বিতীয় সংসারে এসে জীবনের পূর্ণতায় মিশেছেন।

এই প্রতিনিধিত্বকারী কবি কালজয়ী অনেকগুলো সাহিত্যকর্ম রচনা করে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে করেছেন ঋদ্ধ। তার লেখনী পেয়েছিল এক বিশেষ শ্লাঘা। খুব কম লিখেও তিনি তৎকালীন জ্ঞানী ও শিল্প সমঝদার মহলে হয়েছিলেন সমাদৃত। যদিও তিনি ছোটগল্পের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছেন, তবু ছোটগল্পের সেই শাখাটিতে তিনি তত বেশি উৎকর্ষে যেতে পারেননি। কবিতাই ছিল তার ভাব প্রকাশের অন্যতম প্রধান মাধ্যম। তার কাব্যগ্রন্থসমূহ হচ্ছেÑসাঁঝের মায়া (১৯৩৮), মায়া কাজল (১৯৫১), মন ও জীবন (১৯৫৭), প্রশস্তি ও প্রার্থনা (১৯৫৮), উদাত্ত পৃথিবী (১৯৬৪), দিওয়ান (১৯৬৬), অভিযাত্রিক (১৯৬৯), মৃত্তিকার ঘ্রাণ (১৯৭০), মোর জাদুদের সমাধি পরে (১৯৭২)।

তার একটি গল্পগ্রন্থ আছে। সেটি হচ্ছে কেয়ার কাঁটা (১৯৩৭)। তিনি তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের ওপর একটি ভ্রমণকাহিনি লিখেছিলেন সোভিয়েতে দিনগুলি (১৯৬৮) নামে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর চিত্র নিয়ে স্মৃতিকথা লিখেছেন একাত্তরের ডায়েরি (১৯৮৯)। আত্মজীবনীমূলক রচনাও তিনি লিখেছিলেন একালে আমাদের কাল (১৯৮৮) শিরোনামে।

কোমলমতি শিশুদের কোমল মনের খোরাক মিটানোর জন্য তিনি দুটি শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যেগুলো হচ্ছেÑইতল বিতল (১৯৬৫) ও নওল কিশোরের দরবারে (১৯৮১)।

তিনি অনূদিত হয়েছিলেন জীবিতাবস্থায়। তার আলোড়ন সৃষ্টিকারী কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়া বলশেভনী সুমের্কী কর্তৃক রুশ ভাষায় ১৯৮৪ সালে অনূদিত হয়েছিল। তার সাহিত্যকর্মগুলোর মান ও প্রভাব ছিল বিশ্বমানের। সেজন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তার কবিতা অনূদিত হয়েছে। যেমনÑজার্মান, রাশিয়া, চীন, ইতালি, চেক, ভিয়েতনাম, হিন্দি, গুজরাট ও উর্দুতে।

জনকল্যাণকর কাজ ও সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য সুফিয়া কামাল অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ১৯৬১ সালে তিনি পাকিস্তান সরকার কর্তৃক তঘমা-ই-ইমতিয়াজ নামক জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন; কিন্তু ১৯৬৯ সালে বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি তা বর্জন করেন। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পুরস্কারÑবাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬২), একুশে পদক (১৯৭৬), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৭৭), মুক্তধারা পুরস্কার (১৯৮২), জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (১৯৯৫), ডড়সবহ’ং ঋবফবৎধঃরড়হ ভড়ৎ ডড়ৎষফ চবধপব ঈৎবংঃ (১৯৯৬), বেগম রোকেয়া পদক (১৯৯৬), দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বর্ণপদক (১৯৯৬), স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার (১৯৯৭) ইত্যাদি। তিনি সোভিয়েত ইউনিয়নের খবহরহ ঈবহঃবহধৎু ঔঁনরষবব গবফধষ (১৯৭০) এবং ঈুবপযড়ংষড়াধশরধ গবফধষ (১৯৮৬)-সহ বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরস্কারও লাভ করেন।

তৎকালীন বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করেছিলেন। সেই মহৎ ব্যক্তিবর্গের পরামর্শ ও বিশেষ স্নেহ এবং ভালোবাসা তাকে বন্ধুর পথে সুদূর অতিক্রম করতে এক বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, পল্লীকবি জসীমউদ্দীনসহ এ রকম প্রজ্জ্বল ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে তিনি প্রায়শ দেখা করতেন।

অনন্য নারী, মহীয়সী ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনের অগ্র সেনানী বেগম সুফিয়া কামাল সমগ্র জীবন সমাজ সংস্কার ও মননবৃত্তির কাজে ব্যয় করে ১৯৯৯ সালে ২০ নভেম্বর শনিবার সকালে বার্ধক্যজনিত কারণ মৃত্যুবরণ করেন। সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ২৮ নভেম্বর তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে আজিমপুর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

আজ ২০ নভেম্বর ২০১৭ কবি ও মহীয়সী নারী বেগম সুফিয়া কামালের ১৭তম মৃত্যুবার্ষিকী। আজকের এই দিনে তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি!

লেখক : এম ফিল গবেষক

ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist