ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ
মতামত
মাদককে না বলুন
ইয়াবার আগ্রাসন ঠেকাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধের কথা ভাবছে সরকার। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অচিরেই প্রস্তাব পেশ করা হবে। প্রধানমন্ত্রীর সম্মতি পাওয়া গেলে তা কার্যকর করা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামে র্যাব সেভেনের উদ্ধারকৃত মাদকদ্রব্য ধ্বংস কর্মসূচিতে প্রধান অতিথি হিসেবে দেওয়া বক্তব্যে নাফ নদীতে মাছ ধরা বন্ধের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা নানা কারণে তাৎপর্যের দাবিদার। বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে ইয়াবাসহ যেসব মাদকদ্রব্য আসে তার সিংহভাগ আসে নাফ নদী ডিঙিয়ে। রোহিঙ্গা এবং জেলেরা মাদক পাচারে জড়িত। নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ হলে নদীপথে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা অনেকাংশে বন্ধ হবে। পাশাপাশি মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের অবৈধ অনুপ্রবেশে বাদ সাধা সম্ভব হবে।
স্থলপথে মাদক চোরাচালান অনেকাংশে ঠেকানো গেলেও জলপথের অনুপ্রবেশ ঠেকানো কঠিন হয়ে পড়ছে। অনুমান করা হয়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে মাদক চোরাচালানে রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো জড়িত। তারা মাদকের পাশাপাশি অস্ত্র চোরাচালানেও জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার জন্য যা হুমকি সৃষ্টি করছে। প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে অসুস্থ সম্পর্ক সৃষ্টিতে উৎসাহিত করছে। নাফ নদীতে জেলেদের মাছ ধরা বন্ধ হলে তা আর্থিক দিক থেকে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। কারণ নাফ নদীতে যারা মাছ ধরেন তারা সমুদ্র এলাকায়ও মাছ ধরায় জড়িত। মাছ ধরার পাশাপাশি মাদক পাচারের মাধ্যমে বাড়তি অর্থ আয়ের লোভে অনেকে এ নদীতে মাছ ধরার ব্যাপারে উৎসাহী। এ ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ হলে ইয়াবা চোরাচালান অন্তত ৫০ শতাংশ কমিয়ে আনা সম্ভব। একই সঙ্গে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশও হ্রাস পাবে। রোহিঙ্গা জঙ্গিদের অপতৎপরতাও অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব হবে। আমরা আশা করব, মাদক আগ্রাসন শূন্যপর্যায়ে নিয়ে আসতে শুধু নাফ নদীতে মাছ ধরা নিষিদ্ধ নয়, ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে সীমান্ত এলাকার যেসব রথী-মহারথী জড়িত, তাদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।
নিষিদ্ধ জগতে অস্ত্রের পর মাদকই সবচেয়ে লাভবান ব্যবসা। বিশেষ করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সহজলভ্য ও বহনযোগ্য বলে এর বিস্তার দেশজুড়ে। সত্যি বলতে কী, দেশের এমন কোনো এলাকা খুঁজে পাওয়া যাবে না যেখানে মাদকের থাবা নেই। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষজন মাদক ব্যবসায় জড়িত। তারা বিভিন্ন কলাকৌশলের ব্যবসা পরিচালনা করেন। সত্যি বলতে কী, দেশজুড়ে এক বিশাল জাল বিস্তার করে আছে এ মরণ নেশার ভয়াবহ সিন্ডিকেট। আন্তর্জাতিক অপরাধ চক্র মাফিয়াদের সঙ্গে রয়েছে এদের শক্ত ও গভীর যোগাযোগ। মাদকের রয়েছে বিভিন্ন রুট। বিমানবন্দর থেকে শুরু করে স্থলবন্দর, সমুদ্রবন্দর, সীমান্ত এলাকায় মাদকের ছড়াছড়ি। এর কিছু ধরা পড়ে। বাকিটা চলে যায় মাদকসেবী ও ব্যবসায়ীদের কাছে। রাজধানীতেও মাদক ব্যবসা রমরমা।
মাদকের জগতে একসময় ‘হেরোইন’ ব্যাপক বিস্তার লাভ করে। এ পদার্থটি মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমান্বয়ে নিঃশেষ করে অবধারিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এটি খুব দামি বলে পরবর্তী সময়ে এর স্থান দখল করে নেয় ফেনসিডিল ও ইয়াবা। বর্তমান নেশাসক্ত তরুণ-তরুণীদের মধ্যে এ দুটি নেশা বেশি জনপ্রিয়। একে ঘিরে দেশব্যাপী গড়ে উঠেছে বিশাল নেটওয়ার্ক। ফেনসিডিলের চেয়ে ইয়াবাই বেশি জনপ্রিয় ।
তরুণ সমাজের পাশাপাশি ক্রমেই কিশোরদেরও একটি বড় অংশ আজ মাদকাসক্ত। মাদকাসক্তরা যেমন নিজেদের ধ্বংস করছে, তেমনি পরিবারকেও ঠেলে দিচ্ছে ধ্বংসের পথে। অন্যদিকে মাদকের অবশ্যম্ভাবী অনুসর্গ হিসেবে তারা নানা রকম অপরাধকর্মে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সামাজিক স্থিতি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়ে পড়ছে। অথচ মাদক নিয়ন্ত্রণে রয়েছে রাষ্ট্রের আশ্চর্য রকম শৈথিল্য। দুর্বল তদন্ত, নানা রকম প্রভাব ও সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে অনেক মামলারই ন্যায়বিচার বিঘিœত হচ্ছে। এ তো গেল মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার একটি দিক। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে জড়িতদের বিরুদ্ধেও নিয়ন্ত্রণের বদলে বিশেষ কারণে মাদক ব্যবসায়ীদের সহযোগিতা করার ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও। এই যখন মাদক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ও বিচারিক অবস্থা, তখন এ দেশে মাদক ব্যবসার অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার না ঘটার কোনো যুক্তিসংগত কারণ থাকে না। এখন নির্দ্বিধায় বলা চলে, বর্তমানে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যে চরম নাজুক অবস্থা, তার জন্য মাদকের অনিয়ন্ত্রিত বিস্তার একটি বড় কারণ। দ্রুত এর গতি রোধ না করা গেলে সামাজিক-অর্থনৈতিক সব ধরনের স্থিতিই বিঘিœত হবে। আর সেজন্য ধরা পড়া অপরাধীদের সঠিকভাবে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। প্রয়োজনে তাদের জন্য দ্রুততম সময়ে বিচার নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করতে হবে। জামিনের নামে অনৈতিক সুযোগ গ্রহণের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভবিষ্যতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এদের গ্রেফতার করার ক্ষেত্রে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে এবং তার ফল হবে আরো ভয়ংকর। আশা করি, সরকার বিষয়টির প্রতি যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করবে।
শুধু শহরেই নয়, গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে মাদক। তার বিষাক্ত ছোবল শেষ করে দিচ্ছে তারুণ্যশক্তি ও অমিত সম্ভাবনা। ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনের অবক্ষয়, প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তির অসামঞ্জস্যতা, হতাশা এবং মূল্যবোধের অভাবের সুযোগ নিয়ে মাদক তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তরুণ সমাজের প্রতি। বেকারত্বও মাদকের বিস্তারে সহায়কÑএমন কথাও বলছেন বিশ্লেষকরা। এ মরণ নেশার বিস্তারে সমাজে
একদিকে যেমন অপরাধ বাড়ছে; তেমনিভাবে নষ্ট হচ্ছে সামাজিক শৃঙ্খলা। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে একটি সমাজের অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যেতে খুব বেশি সময়ের প্রয়োজন হবে না।
মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে মাদকদ্রব্যের প্রাপ্তি সহজলভ্য যাতে না হয় সেটি নিশ্চিত করতে হবে। যেকোনো মূল্যে ঠেকাতে হবে মাদকের অনুপ্রবেশ। দেশেও যাতে মাদকদ্রব্য উৎপাদন হতে না পারে, সে ব্যাপারেও পদক্ষেপ নিতে হবে। দুঃখজনক হচ্ছেÑমাঝেমধ্যে ছোটখাটো মাদক ব্যবসায়ী ও মাদকের চালান ধরা পড়লেও তাদের মূল কুশীলবরা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। অভিযোগ রয়েছে, সমাজের প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তি এসব সিন্ডিকেটে জড়িত থাকায় তাদের স্পর্শ করতে পারে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এ অবস্থার পরিবর্তন জরুরি। মাদকের ভয়াল থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে মাদক সিন্ডিকেট যতই শক্তিশালী হোক তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ব্যাপারে সামাজিক সচেতনতারও কোনো বিকল্প নেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও নীতিনৈতিকতার উন্মেষ ঘটাতে হবে। যারা ইতোমধ্যেই মাদকাসক্ত হয়েছে, তাদেরও সহানুভূতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সুস্থধারায় ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বাড়াতে হবে মাদক নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যাও। সর্বোপরি সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করে যার যার অবস্থান থেকে মাদকের বিরুদ্ধে লড়াই করে এ যুদ্ধে জয়ী হতে হবে।
লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট
"