এস এম মুকুল

  ২০ নভেম্বর, ২০১৭

পোলট্রিশিল্প

স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ

পোলট্রি শিক্ষিত যুবক ও যুব মহিলাদের জন্য আশীর্বাদতুল্য একটি শিল্প খাত। শিল্পটি লাখো তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থানের প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। চাকরির অপেক্ষায় বসে না থেকে আমাদের যুবসমাজ ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি নিয়ে সমৃদ্ধ অর্থকরী শিল্পে পরিণত করেছে পোলট্রিশিল্পকে। নিজেদের সক্ষমতার সীমারেখায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে পোলট্রিশিল্পের মতো এমন ব্যাপকভিত্তিক সফলতা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, পুষ্টি চাহিদা পূরণের নজির আর কোনো শিল্পে লক্ষ করা যায়নি। আশার খবরÑমুরগির বাচ্চা উৎপাদন, ডিম ও মাংস উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। পোলট্রিশিল্প উদ্যোক্তাদের মতে, খামারিদের সহজশর্তে ব্যাংকঋণ, পোলট্রিশিল্পের জন্য বীমা প্রথা চালু এবং দেশীয় শিল্পবান্ধব পোলট্রি নীতিমালা বাস্তবায়ন হলে এ খাত থেকে ডিম ও মাংস রফতানি করে বছরে ১২ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব।

মাইলফলক সাফল্য

বর্তমানে বাংলাদেশের মোট মাংসের চাহিদার ৪০-৪৫ শতাংশই আসছে পোলট্রিশিল্প থেকে। বাজারে যে পরিমাণ ডিম, মুরগি, বাচ্চা এবং ফিডের প্রয়োজন তার শতভাগ এখন দেশীয়ভাবেই উৎপাদিত হয়। বর্তমান সরকার ২০২১ সাল নাগাদ জনপ্রতি বার্ষিক ডিম খাওয়ার গড় পরিমাণ ১০৪-এ উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণে সরকারের এ লক্ষ্য বাস্তবায়ন করতে হলে ২০২১ সাল নাগাদ দৈনিক প্রায় সাড়ে চার কোটি ডিম এবং দৈনিক প্রায় ৩ দশমিক ৫ থেকে ৪ হাজার টন মুরগির মাংস উৎপাদনের প্রয়োজন হবে। লক্ষ্য অর্জন করতে প্রয়োজন হবে প্রায় ৫০-৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ। এ শিল্পে বিনিয়োগের পরিমাণ ৩০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। ছোট-বড় পোলট্রি খামারের সংখ্যা প্রায় ৮০ হাজার। প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় দুই কোটি। মাংস উৎপাদন হচ্ছে এক হাজার ৭০০ টন। পোলট্রিশিল্পকে কেন্দ্র করে পরিচালনা, পরিচর্যা, বাজারজাতকরণ এবং খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রমের সুবাদে আরো ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারে ব্যবসা এবং ব্যাপক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ক্ষুদ্র শিল্প বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করেছে শিল্পটি। দেশে বর্তমানে প্রায় ৭০ হাজার ছোট-বড় খামারে ডিম ও মুরগির মাংস উৎপাদন বাড়াতে প্রতিনিয়ত এক দিনের মুরগির বাচ্চা উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বারপ্রান্তে বাংলাদেশ। আশার খবরÑদেশের খামারগুলোয় প্রতি সপ্তাহে এক দিনের লেয়ার, ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির বাচ্চার চাহিদা ৯৫ লাখ থেকে এক কোটি ১০ লাখ। তাছাড়া পোলট্রির মাংস বহুমাত্রিক ব্যবহার করে দেশেই উৎপাদিত হচ্ছে চিকেন নাগেট, চিকেন বল, সসেজ, ড্রামস্টিক, বার্গার, চিকেন সামুচা, মিটবলসহ বিভিন্ন ধরনের মজাদার প্যাকেটজাত খাবার। খাতসংশ্লিষ্টদের আশাবাদ বাংলাদেশের পোলট্রি প্রসেসড পণ্য ২০২০ সাল নাগাদ আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করলে বছরে অন্তত চার-পাঁচ মিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব হবে।

স্বপ্নপূরণের শিল্প

আমাদের পোলট্রিশিল্প দেশীয় পুঁজি এবং দেশীয় উদ্যোগে তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটি নতুন শিল্প ইতিহাস। এ শিল্পের কল্যাণে একই সঙ্গে আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা তৈরি এবং গ্রামীণ মানুষের জন্য ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে। এই শিল্পটি মাংস ও ডিম উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের বিপুল বর্ধিষ্ণু জনশক্তির পুষ্টি চাহিদা মিটাচ্ছে। গার্মেন্টসের পর এটি দ্বিতীয় বৃহত্তম কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাত। দেশের অন্যতম পোলট্রিশিল্প এলাকা টাঙ্গাইল জেলা। সারা দেশের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মুরগির মাংস ও ডিমের চাহিদার জোগান আসে এ জেলা থেকেই। জেলায় পোলট্রিশিল্প খাতে প্রতিদিন প্রায় ২৫ কোটি টাকা লেনদেন হচ্ছে। দেশের অন্যতম আরেকটি পোলট্রিশিল্প এলাকা গাজীপুর। দেশের এক-চতুর্থাংশ ডিম ও মাংস উৎপাদন হচ্ছে গাজীপুরে। উৎপাদন খরচ কমাতে গাজীপুরের ২২ খামারি নিজেদের খামারের প্রয়োজনীয় ফিড নিজেরাই উৎপাদন করছেন। বর্তমানে সারা দেশে ছোট-বড় খামার রয়েছে কমবেশি ৭০ হাজার। যোগ হচ্ছে নতুন নতুন উদ্যোক্তা।

নীরব বিপ্লবের পথে

দেশে একসময় কোনো জিপি ফার্ম ছিল না, পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। বর্তমানে এ খাতে আট কোম্পানির ১৫টি খামার গড়ে উঠেছে। বেড়েছে পিএস খামার বা হ্যাচারি সংখ্যা। দেশে বর্তমানে ২০৫টি হ্যাচারি রয়েছে। একসময় প্যাকেটজাত ফিড আমদানি হতো। এখন দেশেই ১৮৬ ফিডমিল রয়েছে। আগে দেশীয়ভাবে তেমন কোনো ওষুধ তৈরি হতো না। এখন প্রায় ৩০ কোম্পানি দেশীয়ভাবে বিভিন্ন ওষুধ তৈরি করছে। ফলে আমদানিনির্ভরতা কমছে। এভাবেই নীরবে দেশের পোলট্রিশিল্পে বিপ্লব ঘটছে। দেশে একই সঙ্গে বেড়েছে ডিম ও মুরগির মাংসের উৎপাদন। পোলট্রিশিল্প মানুষের স্বপ্নপূরণের জায়গা। এ খাতে শিক্ষিত বেকার যুবকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। দেশের পোলট্রিশিল্পে বর্তমানে ২০-২৫ লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান তৈরি হয়েছে। পরোক্ষভাবে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল ৬০ লাখ মানুষ। ২০৩০ সালে এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠবে প্রায় এক কোটি মানুষ। সম্ভাবনাময় এ শিল্প ২০২১ সালের মধ্যে বছরে এক হাজার ২০০ কোটি ডিম ও ১০০ কোটি ব্রয়লার উৎপাদনের স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছে। ২০২১ সালের মধ্যে লক্ষ্য পূরণ করা সম্ভব হলে দেশের চাহিদা পূরণ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পাশাপাশি এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হতে পারে।

প্রয়োজন প্রয়োজনীয় পরিবেশ

ইতোমধ্যেই পোলট্রিশিল্পে বিদেশি বিনিয়োগে সাত বিদেশি কোম্পানি এ শিল্পে বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে পাঁচটি ভারতের, একটি থাইল্যান্ডের এবং একটি চীনের। জানা গেছে, দেশের পোলট্রিশিল্পের শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ পুঁজি এরা নিয়ন্ত্রণ করছে। এদের সঙ্গে এক অসম প্রতিযোগিতায় পড়েছে দেশি খামারগুলো। বিদেশি অর্থপুষ্ট খামারগুলো ঋণ নিয়ে আসছে ৩-৪ শতাংশ সুদে। আর দেশি খামারগুলোকে ঋণ সংগ্রহ করতে হচ্ছে ১০-১২ শতাংশ সুদে। তাই বিদেশি খামারগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে স্থানীয় বড় খামারগুলোকেও অনেক হিমশিম খেতে হচ্ছে। ঝরে পড়ছেন ছোট বা প্রান্তিক খামারিরা। সমস্যার জরাজঞ্জালে প্রান্তিক খামারিদের হতাশা বাড়ছে। দেশে কোনো ডিম সংরক্ষণাগার নেই। এ কারণে ডিমের দাম খুব বেশি ওঠানামা করে। সংরক্ষণাগার থাকলে সারা বছর ডিমের দাম একই রকম থাকতে পারে। যার মাধ্যমে ভোক্তারা এবং খামারিরা উপকৃত হবেন। শিল্পের স্বার্থে সরকারি ডিম সংরক্ষণাগার স্থাপন করা খুবই জরুরি। এ ছাড়া মুরগির খাদ্য তৈরির কাঁচামাল ভুট্টার দাম কমলেও ফিডের দাম কখনো কমে না। ডিমের দাম নির্ধারণ করেন ঢাকার কারওয়ান বাজারের আড়তদাররা। প্রতিটি জেলায় একটি করে ডিম ও মাংস সংরক্ষণাগার স্থাপন করা এখন সময়ের দাবি। কৃষিক্ষেত্রের মতো পোলট্রিশিল্পের ছোট ছোট খামারির জন্য ৫ শতাংশ সুদে আলাদা ঋণ প্রদান করা, পোলট্রি বীমা চালু করা, প্রশিক্ষণের জন্য আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ অফিসগুলো কাজে লাগানো, বাজেটে ভুট্টাসহ পোলট্রি ফিডে ব্যবহৃত বিভিন্ন অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ আমদানিতে ৫ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), সয়াবিনের ওপর থেকে ১০ শতাংশ কাস্টমস ডিউটি, ওষুধের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক এবং ডিডিজিএসের ওপর থেকে ১৫ শতাংশ ভ্যাট তুলে নেওয়ার ক্ষেত্রে পোলট্রিশিল্প সংশ্লিষ্টদের দাবিগুলোর বাস্তবতা যাচাই করে বিবেচনা করা দরকার। পক্ষান্তরে নিরাপদ ও পুষ্টিমাণ সমৃদ্ধ পোলট্রির ডিম ও মাংস যত সুলভে দেশের বাজার সৃষ্টি করতে পারলে এ শিল্পের বিকাশ ততই ত্বরান্বিত হবে। সাশ্রয়ী দামে জনগণ ডিম আর মাংস পেলে সবাই তা ভোগ করতে পারবেন। আর তখনই পুষ্টির ঘাটতি কমবে। আমরা পাব স্বাস্থ্যবান প্রজন্ম। ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফালোভী হলে তার ফল ভালো হবে না। চায়নাদের মতো বিপণন নীতিমালা নিয়ে আমাদের ব্যবসায়ী মহলকে কাজ করতে হবে। বিপণন নীতিমালা হতে হবে, ‘কম লাভে বিক্রির জন্য পণ্যকে সহজলভ্য করা আর বেশি বিক্রির মাধ্যমে অধিক লাভবান হওয়া’।

লেখক : কৃষি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist