সাঈদ চৌধুরী
বোধ
এ দায় সভ্যতার
সবকিছু শান্ত হয়ে গেছে। একেবারে নিস্তব্ধ! শুধু সামান্য ব্যথা আর কষ্টগুলো জড়ো হয়ে কষ্টের সমুদ্রে গিয়ে আছড়ে পড়ছে। পেটের নিচের অংশে ১০ মাস ধরে বয়ে নিয়ে চলা প্রাণের অস্তিত্ব ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর এখন শিশুটির মায়ের কোলে থাকার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। সেই সন্তান তার মায়ের পাশে নেই। থাকতে পারেনি। মা তার শিশুকেও বেঁধে রাখতে পারেননি। এ সময়ে নারীর পাশে তার স্বামীরই থাকার কথা। না, তারপাশে কেউ ছিল না। না-স্বামী না-স্বজন।
গর্ভবতী হওয়ার পর যে নারীকে স্বামী অস্বীকার করে সে নারী তখন ঠিকানাহীন। হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে একটি প্রাণকে বাঁচানোর আকুতি কোনো জায়গায় প্রতিধ্বনিত হলো না। প্রতিধ্বনিত হওয়ার আগেই তা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল, কেউ একবার ফিরেও তাকাল না। বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এটাই সভ্যতা! প্রসবের পর পুরো পৃথিবীই এখন তার ঠিকানা।
অভিযোগ উঠেছে, তিনটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে। মাত্র ১৫০০ টাকা ঘুষ না দিতে পারায় ভর্তি হতে পারেনি পারভিন নামে স্বামী পরিত্যক্তা এক নারী! হাসপাতাল থেকে তাকে বের করে দেওয়া হয়। তারপর তার সন্তান হলো রাস্তায় জনসমক্ষে! এবং কিছুক্ষণ পর সেই নবজাতকের মৃত্যু হয়েছিল। পৃথিবীটা যেন লজ্জায় কুঁকড়ে উঠেছিল। কিন্তু মানুষ! লজ্জাহীনের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছে। প্রশ্নটা কারো বিরুদ্ধে নয়। এটা সভ্যতার কাছে মানবতার জিজ্ঞাসা। যে সময় নারীটি প্রকাশ্য দিবালোকে ব্যথায় কাতরাচ্ছে সে সময় কি রাস্তায় একজন মানুষও ছিল না যে, ওই নারীকে হাসপাতালে দায়িত্বরত ডাক্তারের কাছে পৌঁছে দিয়ে বলবে, ‘চিকিৎসা করুন, ব্যবস্থা হবে।’ সবকিছু বাদ দিয়েও বলা যায়, একজন ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের কেউ কি সেই পথ দিয়ে যাতায়াত করেননি! আমাদের দৃষ্টি কতটা অন্ধ! নিজেদের নিয়ে আমরা কতটা ব্যস্ত।
এত বড় একটি বেদনাদায়ক সত্য সহসাই ঢাকা পড়ে যাবে। কেন জানেন? ঘটনার মূল চরিত্র, যাকে নিয়ে আজকের আলোচনা তিনি ভাগ্য বিড়ম্বিত হতদরিদ্র এক নারী। যার পাশে দাঁড়াবার মতো কেউ নেই। না কোনো স্বজন, না সমাজ। পৃথিবীতে পথের সংখ্যা যত, সম্ভবত এদের ঠিকানার সংখ্যাও তত। হাসপাতালের দায়িত্ব যদি সত্যিকারের ডাক্তারের হাতে ন্যস্ত থাকত, তাহলে হয়ত পারভীনের সন্তানকে সেদিন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে হতো না। বস্তুত এই সভ্যসমাজ শিশুটিকে প্রকাশ্য দিবালোকে অভিনব কায়দায় সবার সামনে খুন করল। আর আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা অবলোকন করলাম। হায়রে সভ্যতা!
গত বছর ঠিক এই সময়ে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে নৈরাজ্য হয়েছিল। অ্যাম্বুলেন্সের ধাক্কায় মারা গিয়েছিল দু’জন এবং আহত হয়েছিল আরো তিনজন। অনেক অনিয়ম বেরিয়ে আসে অ্যাম্বুলেন্সকে ঘিরে। কিন্তু সমাধান! কোনো সমাধান হয়নি। হয়ত আবার কোনো দিন আমরা দেখব অ্যাম্বুলেন্সের কারণে কেউ তার স্ত্রী, মা অথবা বাবাকে বাঁচাতে পারেনি! আসলে এভাবেই চলছে।
ভালো মানুষ খুঁজবেন? কিন্তু তার পকেটে তো টাকা নেই। সোহেল নামের যে ছেলেটি এত কষ্ট করে পারভীনকে নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে দৌড়াল, কী প্রাপ্তি তার। লোকারণ্যে মানব শিশুর জন্ম হলো, দু’মিনিটের মাথায় সে মারা গেল। আসলে সে মারা যায়নি। সবাই মিলে আমরা হত্যা করলাম তাকে। একটি মানুষের দাম আসলে কত? প্রসব বেদনা উঠলে কেমন লাগে একজন নারীর তা কনসালট্যান্ট ডা. নিলুফা অনুভব করা থেকে নিজেকে বিরত রাখলেন। মাত্র ১৫০০ টাকা যখন মানুষ ও পশুর মাঝে পার্থক্য চিহ্নিত করে বলে দেয়, তখন মানবতা শব্দটি আসলে খুব হাস্যকর। সবাই যদি শুধু ডিউটির জন্যই ডিউটি করে, তবে শিক্ষার সঙ্গে মানবিকতার স¤পর্কের দরকার নেই। পারভিন নামের অভাগা মায়ের সন্তানকে বাঁচাতে পারেনি কোনো হাসপাতাল। এ দায় আসলে কি শুধু হাসপাতালের নাকি সভ্যতার!!
শিক্ষক ক্লাসে ঘুমাচ্ছে ছবিটি দু’দিন যাবৎ ভাইরাল হয়েছে গণমাধ্যমগুলোতে। ডা. নিলুফা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে খুব হালাকাভাবে নিয়ে পারভিনকে বের করে দিলেন হাসপাতাল থেকে। কিছুদিন আগে প্রধান নৌপ্রকৌশলী দুর্নীতির কারণে ঘুষসহ হাতেনাতে গ্রেফতার হলেন দুদকের পুলিশ টিমের কাছে ! কত টাকার মালিক এরা! কত শত পরিচয় এদের! লবিং, পরিচয় আর কালো টাকার মিশ্রণে যারা আজ সমাজপতি তাদের মুখে মৃত শিশুটির লাথি কি অনুভব করেছেন কেউ? মানবতা যদি এভাবেই দুমড়েমুচড়ে যায় আর একটি করে তদন্ত কমিটি গঠিত হওয়াই সমাধান, তাহলে মানুষ পরিচয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমরা?
লেখক : কলামিস্ট
"