মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর

  ১৮ নভেম্বর, ২০১৭

দর্শন

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং...

মহাবিশ্বের স্রষ্টা ও মালিক এক। তার ধর্মও এক এবং অভিন্ন। তার সব সৃষ্টির মাঝে মানুষ সর্বোৎকৃষ্ট। ফলে শ্রেষ্ঠ জীবের মর্যাদা ও অধিকার সৃষ্টির অন্যান্য জীব হতে সর্বাধিক এবং স্রষ্টার সঙ্গে প্রেমময় সম্পর্ক সর্বোত্তম। তাই তিনি তার সর্বাধিক ভালোবাসার জীবের মাঝে মানবীয় গুণাবলির উৎকর্ষ বিকাশে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগদান ও জীবন চলার পথ সুগম করার জন্য যুগে যুগে বিভিন্ন জাতিতে নবী, রাসুল বা অন্যান্য ধর্ম অথবা সংস্কৃতিতে অবতার প্রেরণ করেছেন। পৃথিবীর মানবগোষ্ঠীর মধ্যে যখন এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির এবং এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের কোনো যোগাযোগ ছিল না, তখনই বিভিন্ন জাতিতে এবং বিভিন্ন দেশে নবী বা অবতারের আবির্ভাব হয়। ফলে আবির্ভূত সব অবতারই একেশ্বরবাদের শিক্ষা দিয়েছেন। তারা সমাজে ধর্মহারা মানুষের মাঝে প্রেমপ্রীতি-ভালোবাসা দিয়ে স্রষ্টার আনুগত্য এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশে প্রার্থনা করার দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। মানুষের মধ্যে সাম্য, একতা, মানবতা এবং সহমর্মিতা প্রকাশের মাধ্যমে সহাবস্থানে বসবাসের শিক্ষা দিয়েছেন।

তাদের শিক্ষা প্রচারের সব স্তরে এক ধর্মাবলম্বী অন্য ধর্মাবলম্বীকে সম্মান করার আদেশ বিদ্যমান। বল প্রয়োগে ধর্মান্তরিত করার শিক্ষা কোনো ধর্মীয় বিধানে নেই। কোনো ধর্মই সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বা জঙ্গিবাদের শিক্ষা দেয়নি। প্রত্যেক ব্যক্তির ধর্মীয় স্বাধীনতা আছে। ধর্মপালন কিংবা বর্জন ব্যক্তির নিজস্ব অধিকার। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি বল, তোমার প্রতিপালক প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য প্রেরিত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক, আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক।’ (সুরা কাহাফ : ২৯)। অথচ আজ সারা বিশ্বে চলছে ধর্মের নামে অধর্মের কাজ। মানুষের মধ্যে হিংসাবিদ্বেষ, মারামারি, হানাহানি এবং যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে। এক ধর্মাবলম্বী অপর ধর্মাবলম্বীকে হত্যার প্রয়াস চালায়। এক জাতিগোষ্ঠী অপর জাতির ওপর আক্রমণ করে। সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্ম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে সৃষ্টি হয়েছে আই এস, আল-কায়েদা, তালেবান, জামাতে মুজাহিদিন, হরকাতুল জিহাদ, লস্করে তৈয়েবা প্রভৃতি জঙ্গি সংগঠন। ভারতে উগ্র হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মাঝেও অনুরূপ সংগঠন বিদ্যমান।

সম্প্রতি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত দেশ মিয়ানমারে জাতিগত এবং ধর্মীয় উন্মাদনায় চলছে রোহিঙ্গা নিধন। তাদের ওপর গণহত্যা চলছে। সে দেশের সেনাবাহিনী এ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। প্রাণ ভয়ে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জন্মভূমি ছেড়ে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছে। বাংলাদেশ সরকার তাদের আশ্রয় দিয়েছে এবং সেবা করছে। মানবতাবিরোধী এই কার্যকলাপ বিশ্ব বিবেককেও নাড়া দিচ্ছে। অনেক দেশ এর প্রতিবাদ করেছে ও নিন্দা জানিয়েছে। অথচ বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বৌদ্ধের শিক্ষা- ‘অহিংসা পরম ধর্ম। জীব হত্যা মহাপাপ।’ ফলে আজ সেই বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা তাদের অবতারের শিক্ষা থেকে বিচ্যুত। তাদের কার্যকলাপে সেই বাণী কলঙ্কিত হচ্ছে। ‘বৌদ্ধং স্মরণং গচ্ছামি’ তাদের অঙ্গীকার বিফলে যাচ্ছে।

মহানবী (সা.) মানুষকে ভালোবাসা দিয়ে ইসলাম প্রচার করেছেন। অথচ বিরোধী মক্কাবাসীরা মহানবী (সা.) এবং তাঁর অনুসারীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। এর প্রতিবাদে তিনি (সা.) যুদ্ধে জড়িত হননি। অত্যাচারের সীমা যখন ছাড়িয়ে যায় তখন তিনি (সা.) মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যান। তারপরও মক্কার সেই বিরোধীরা মদিনায় গিয়ে আক্রমণ করে। তখন তিনি (সা.) আল্লাহতায়ালার নিকট থেকে নির্দেশিত হন- ‘যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা হচ্ছে তাদেরকে (আত্মরক্ষার্থে যুদ্ধ করার) অনুমতি দেওয়া হলো। কারণ তাদের ওপর জুলুম করা হচ্ছে।’ (সুরা আল হাজ্জ : ৩৯)।

‘আল্লাহর পথে তোমরা ওই সকল লোকের সঙ্গে যুদ্ধ কর, যারা তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে, কিন্তু তোমরা সীমা লঙ্ঘন করিও না। নিশ্চয় আল্লাহ সীমা লঙ্ঘনকারীকে ভালোবাসেন না।’ (সুরা বাকারা : ১৯০)। ফলে আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং তারা নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যুদ্ধ করেন। এছাড়া অন্য কারো বিপক্ষে তারা যুদ্ধে জড়িত নয় কিংবা বৃদ্ধ, নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়নি। এমনকি মক্কা বিজয়ের পর সকলকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়। হিন্দু ধর্মেও আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধের বিধান প্রযোজ্য। যথা-‘সর্বথা যতমানা নাম যুদ্ধমভিকাঙ্খতাম। সাত্বে প্রতিহতে যুদ্ধং প্রসিদ্ধনাং পরাক্রামঃ।’ অর্থাৎ যুদ্ধের আকাক্সক্ষা না করে শান্তির জন্য সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চালিয়েও যারা ব্যর্থ হয় তাদের জন্য যুদ্ধ করা অবশ্য কর্তব্য (মহাভা, ৫/৭২/৮৯)। পবিত্র কোরআন এবং মহানবী (সা.) সকল ধর্মের অনুসারীদের নিজ নিজ রীতি অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম পালনের শিক্ষা দিয়েছেন। মহানবী (সা.) বলেন- জেনে রাখ, যে ব্যক্তি কোনো অঙ্গীকারাবদ্ধ অমুসলমানের ওপর জুলুম করবে, তার অধিকার খর্ব করবে, তার ওপর সাধ্যাতীত কোনো কিছু চাপিয়ে দেবে বা তার অনুমতি ব্যতীত তার কোনো বস্তু নিয়ে নেবে আমি পরকালে বিচার দিবসে তার বিপক্ষে অবস্থান করব।’ (আবু দাউদ)।

অমুসলমানদের উপাসনালয়ে হামলা ইসলাম কঠোরভাবে নিষেধ করেছে। শুধু তা-ই নয়, অমুসলমানরা যে সবের উপাসনা করে সেগুলোকে গালমন্দ করতেও বারণ করা হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদেরকে গালি দিও না, যাদেরকে তারা আল্লাহকে ছেড়ে উপাস্য রূপে ডাকে, নতুবা তারা অজ্ঞতার কারণে শত্রুতাবশত আল্লাহ্কে গালি দেবে।’ (সুরা আনআম : ১০৮)। ফলে ইসলাম সকল ধর্মাবলম্বীদের মাঝে এক সামাজিক সম্প্রীতি সৃষ্টির ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। কাজেই ধর্মীয় উন্মাদনায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপে মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা অন্য কোনো স্থাপনা ভাঙা ও জ্বালিয়ে দেওয়া এবং নিরীহ মানুষকে হত্যা করা কোনো ধর্মীয় কাজ নয়। বল প্রয়োগে কোনো ধর্মমত চাপিয়ে দেওয়া কোনো ধর্মই স্বীকৃতি দেয় না। অনেকে যুক্তি আরোপ করেন, ইসলামে কিসাস অর্থাৎ সমশাস্তি প্রদানের বিধান আছে। তবে এর তাৎপর্য হলো- বিরুদ্ধবাদী যে ব্যক্তি আক্রমণ করে তার ওপর আক্রমণ করা। অন্য কোনো ব্যক্তির ওপর নহে। কিন্তু সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদীরা নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালায়। অনেকে নিরপরাধ মুসলমানকে হত্যা করে। এটা ইসলাম সমর্থন করে না।

অনেক ধর্মান্ধ জঙ্গিবাদী জেহাদ ঘোষণা করে হত্যাযজ্ঞ চালায়। কিন্তু ইসলামে জেহাদের বড় তাৎপর্য হলো নিজের আত্মশুদ্ধিকল্পে প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। নিজের মাঝে মনুষ্যত্বের গুণাবলির উৎকর্ষ বিকশিত করা। আদর্শ ও ভালোবাসা সৃষ্টি এবং যুক্তির মাধ্যমে অপরকে দীক্ষিত করার প্রচেষ্টা করা। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শিক্ষা নেই। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তুমি মন্দকে সর্বোৎকৃষ্ট আচরণ দ্বারা প্রতিহত কর। তাহলে দেখবে যার সঙ্গে আজ তোমার শত্রুতা রয়েছে সে তোমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়ে যাবে।’ (সুরা হা-মিম আস সাজদা : ৩৪)।

অনেক উগ্রবাদী জঙ্গি হত্যাযজ্ঞ চালানোর উদ্দেশ্যে নিজে আত্মাহুতি বা আত্মত্যাগ করে। তাদের ধারণা, এতে পরকালে স্বর্গলাভ হবে। কিন্তু এটা ইসলামী শিক্ষার পরিপন্থি। ইসলামে আত্মত্যাগ বা আত্মহত্যা নিষেধ। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা আত্মহত্যা করবে না। নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি অতিশয় দয়ালু।’ (সুরা নেসা : ২৯)।

আমাদের দেশে প্রাচীনকাল থেকে মুসলমান, হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং বৌদ্ধসহ বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা সহাবস্থানে বসবাস করে আসছে। কাজেই সব ধর্মাবলম্বীর মাঝে অসাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীকে নিয়ে আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন করা প্রয়োজন। এদেশের সুশীল সমাজের উদ্যোগে বেশি বেশি আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি সম্মেলন করা আবশ্যক। সব ধর্মের একত্ববাদের মূল শিক্ষা সমাজে বিকশিত করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মুক্ত একটি অসাম্প্রদায়িক ও সম্প্রীতির দেশ গড়ে তোলা অনেকাংশেই সম্ভব।

মহানবী (সা.) বিদায় হজের ভাষণে সবাইকে সতর্ক করে বলেন, ‘হে মানবমন্ডলী! সাবধান, তোমরা ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি কর না। কেননা তোমাদের পূর্বের জাতিগুলো ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কারণেই ধ্বংস হয়ে গেছে।’ (ইবনে মাজা, কিতাবুল মানাসিক)। আমাদের দেশ ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং সামাজিক সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অচিরেই সন্ত্রাস, দুর্নীতি এবং জঙ্গিবাদমুক্ত হোক-এ প্রত্যাশা করি।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও সরকারি কর্মকর্তা, বাংলাদেশ রেলওয়ে

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist