ড. শেখ সালাহ্উদ্দিন আহ্মেদ

  ২৩ অক্টোবর, ২০১৭

মতামত

বর্জন নয়, নির্বাচনই সমাধান

গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। এজন্য প্রধান ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের হাতে থাকলেও প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, স্থানীয় প্রশাসন, ভোটার ও সমর্থকদের আচরণের ওপরও তা অনেকাংশে নির্ভরশীল। এ জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এছাড়া নির্বাচনের ফল মেনে নেওয়ার মানসিকতাও থাকতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না, যেকোনো নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকা জরুরি। তবে একই সঙ্গে প্রয়োজন নিরপেক্ষ প্রশাসনও। ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ রক্ষা, ভোটারদের নিরাপত্তা বিধান এবং কোনো অনিয়মকে প্রশ্রয় না দিয়ে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ ও গণনা শেষে প্রকৃত ফল ঘোষণা পর্যন্ত সামগ্রিকভাবে যে প্রশাসন নির্বাচনকালীন দায়িত্ব পালন করে থাকে, তা নিরপেক্ষ না হলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

সবচেয়ে বড় কথা, আগামী নির্বাচন যদি প্রধানমন্ত্রীর অধীনে অনুষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রে ছোট পরিসরে হলেও নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভা থাকবে। তারা প্রধানমন্ত্রীর অধীনস্থ থাকায় প্রশাসন কতটা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে পারবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য, দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে বাংলাদেশের ৪৫ বছরের ইতিহাসে গ্রহণযোগ্য সুষ্ঠু নির্বাচনের দৃষ্টান্ত বিরল। এ অবস্থায় দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করা নিঃসন্দেহে একটি চ্যালেঞ্জ।

বিশ্বের অধিকাংশ দেশে দলীয় সরকারের অধীনেই নির্বাচন হয়। আমাদের দেশে সমস্যা হলো, আমরা দল ও সরকারকে আলাদা করে দেখার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। নিয়ম হচ্ছে, দল দলের জায়গায় থাকবে; সরকার সরকারের জায়গায়। দল ও সরকার যদি এক হয়ে যায়, তাহলে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে তা সামাল দেওয়া কঠিন। এজন্য সবচেয়ে বেশি দরকার আইনের শাসন। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের নির্বাচনব্যবস্থা অনেকটাই স্বচ্ছ। ভারতে যে নির্বাচনগুলো হচ্ছে, তাতে নির্বাচন কমিশন প্রশাসনকেই কাজে লাগাচ্ছে। জেলা পর্যায়ের নির্বাচনে ডেপুটি কমিশনার হচ্ছেন প্রধান। ডেপুটি কমিশনার যখন নির্বাচন ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করেন, তখন ভারতের কোনো রাজনৈতিক দল তাকে চ্যালেঞ্জ করে বলে না যে, সে নিরপেক্ষ নয়। সেখানে একজন ডেপুটি কমিশনার নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন পরিচালনা করতে পারছে, অথচ আমাদের দেশে কেন পারছে না? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।

বস্তুত আমরা দল ও সরকারের মধ্যে সীমারেখা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি বলেই একজন ডিসি, একজন নির্বাচন কমিশনার বা একজন ইউএনও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন না। এক্ষেত্রে প্রশাসনকে কিছু দায়িত্ব নিতে হবে। নাগরিকদেরও দায়িত্ব রয়েছে। আমরা সবাই যার যার মতো চলব, আর নির্বাচন কমিশন আমাদের নির্বাচন করে দেবে এবং সেই নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ- এটা ভাবা ঠিক নয়। যেখানে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, পরমত সহিষ্ণুতা, আইনের শাসন, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা অনুপস্থিত; সেখানে নির্বাচন কমিশনের চার-পাঁচজন কী করবেন? নির্বাচন কমিশনের দুর্বলতা অবশ্যই আছে। এ দুর্বলতা সামগ্রিক। মূলত প্রশাসন দলীয়করণের কারণেই এটা দেখা যায়। প্রশাসনকে দলমুক্ত ও নিরপেক্ষ করে তার ক্ষমতা সঠিকভাবে প্রয়োগের সুযোগ দিলে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা শক্তিশালী হবে, এতে দ্বিমত প্রকাশের কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীন প্রশাসনিক ব্যবস্থার পাশাপাশি যোগ্য ও ন্যায়নিষ্ঠ নির্বাচন কমিশন, রুচিশীল ও পরিচ্ছন্ন মনমানসিকতার ধারক-বাহক রাজনৈতিক দল এবং সংবেদনশীল নাগরিক সমাজ যদি যূথবদ্ধভাবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জন করে, তবে দেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা পূরণ হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘আগামীতে যে নির্বাচন হবে, তা যেন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয় আলোচনা করে তার একটা পথ বের করব। আমরা চাই, মানুষ মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকার প্রয়োগ করবে। যার যার প্রতিনিধি সে বেছে নেবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করে আমরা আশা করব, সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে যেন জনগণের মতের প্রতিফলনের সরকার দেশ পরিচালনা করতে পারে, তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সদিচ্ছা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

ভৌগোলিক অবস্থান ও জনসম্পদে সম্ভাবনাময় এবং উদীয়মান একটি দেশ হওয়ার পরও কেবল রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে আমাদের অনেক অর্জন ম্লান হতে যাচ্ছে। মুখে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ালেও বাস্তবে অনেকের ক্ষেত্রে ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’ মনোভাব থেকে বের হতে না পারার কারণে জাতিকে অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। নিজের ক্ষমতায় যাওয়া ও টিকে থাকার সংস্কৃতি পরিহার করে জনগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়ার মনোভাব যদি সব দলের নেতাকর্মী ও নীতিনির্ধারকরা গ্রহণ করে নেন, তবেই একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। আমরা যদি উদার মনোভাব নিয়ে নিজেদের সীমিত সম্পদ সত্ত্বেও লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিতে পারি, তাহলে পারস্পরিক সমঝোতায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে সম্মান দিয়ে ও আলোচনা সাপেক্ষে নির্বাচনের সুষ্ঠু পথ বের করতে পারব না- এটা অবিশ্বাস্য। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর সরকারসহ সবাই এক্ষেত্রে আন্তরিক বলেই আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist