ইফতেখার আহমেদ টিপু

  ২০ অক্টোবর, ২০১৭

মতামত

মগের মুল্লুকে মানবতা!

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গাশূন্য করার মিশন থেকে সে দেশের সরকারকে কিছুতেই বিরত করা যাচ্ছে না। এদিক থেকে গণতন্ত্রের লেভেল আঁটা অং সান সু চি ও মিয়ানমার নিয়ন্ত্রক শক্তি বর্মি জেনারেলদের ভূমিকার কোনো পার্থক্য নেই।

বিশ্ববাসীর ধিক্কার ও নিন্দা সত্ত্বেও প্রতিদিনই রাখাইনে ঘটছে রোহিঙ্গা উচ্ছেদের ঘটনা। কৌশলগত কারণে গণহত্যার গতি থামলেও সমানে চলছে নির্যাতন। বাড়িঘর পুড়িয়ে, নারীদের সম্ভ্রম কেড়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে। সরাসরি বলা হচ্ছে, রাখাইন ছেড়ে না পালালে নির্যাতন-নিপীড়ন চলতেই থাকবে।

গত ১৬ অক্টোবর সোমবার শুধু উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া সীমান্ত দিয়ে অর্ধ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেছে। ওপারে অপেক্ষা করছে আরো ২০ হাজার। এটিই এ পর্যন্ত আসা সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা ঢল। অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে বরাবরের মতো এবারও রয়েছে নারী-শিশুর আধিক্য। পাঁচ থেকে সাত দিন হেঁটে মিয়ানমারের নাইছাদং ও কুয়াংছিদং, পাদংছা সীমান্তে রোববার রাতে জড়ো হয় এসব রোহিঙ্গা। ভোর হতেই নদী পার হয়ে তারা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। বিজিবি সদস্যদের বাধার মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করতে না পারলেও সকাল ১০টার দিকে তারা বানের স্রোতের মতো খাল, বিল, জলা, ধানখেত মাড়িয়ে এপারে চলে আসে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা আঞ্জুমানপাড়ার বিস্তীর্ণ এলাকা, পার্শ্ববর্তী স্কুল-মাদরাসায় অবস্থান নেয়। দুপুর ১২টার পর থেকে বিজিবির দুই শতাধিক সদস্য তাদের পুনরায় সীমান্তের ‘নো ম্যান্স ল্যান্ডে’ পাঠিয়ে দেয়। সীমান্তের জিরো পয়েন্টে দিনভর চিৎকার, কান্নাকাটি ও ক্ষুধাতুর রোহিঙ্গাদের আকুতিতে ভারী হয়ে ওঠে পরিবেশ। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থার কারণে বিজিবি রোহিঙ্গাদের নতুন কোনো দলকে বাংলাদেশে প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। তবে মানবিক কারণে শেষ পর্যন্ত যে তাদের আশ্রয় দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর থাকবে না, এটিও এক রকম নিশ্চিত। মিয়ানমারে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ থাকায় দুই প্রতিবেশী দেশ চীন ও ভারত সে দেশের ক্ষমতাদর্পী জেনারেলদের রোহিঙ্গা নিধন অভিযানে বাদ সাধতে অনীহা দেখাচ্ছে। রাশিয়া মিয়ানমারের কাছে পারমাণবিক চুল্লি ও অস্ত্র বিক্রির সুবিধা পেতে তাদের মদদদাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন দুই পরাশক্তি চীন ও রাশিয়া মিয়ানমারের পক্ষ নেওয়ায় জাতিসংঘ বর্মি দুর্বৃৃত্তদের সামাল দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। রাখাইনে বিপন্ন হয়ে পড়ছে মানবতা। মানবসভ্যতার জন্য যা কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে বিবেচিত হওয়ার দাবি রাখে।

অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার সে দেশ থেকে প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে টালবাহানার আশ্রয় নিয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনে তারা যে হাস্যকর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে, তাতে ৫০ বছরেও তাদের স্বদেশে ফেরা সম্পন্ন করা যাবে না। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে আল জাজিরা বলেছে, দৈনিক ১০০ জন রোহিঙ্গার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরিকল্পনা নিয়েছে মিয়ানমার সরকার। প্রায় ৯ লাখ রোহিঙ্গার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে এ পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪-২৫ বছর লাগার কথা। রোহিঙ্গারা জন্মহারের দিক থেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বর্ধিষ্ণু জাতিগোষ্ঠী, বাংলাদেশে যে ৯ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে, মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত না নিলে ২৪-২৫ বছরের মধ্যে তাদের সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হওয়ার কথা। দৈনিক ১০০ জনকে ফেরত নিলেও তাতে অন্তত অর্ধ শতাব্দী কেটে যাবে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন মন্ত্রীর বরাত দিয়ে আল জাজিরা বলেছে, যাদের পরিচয় মিয়ানমার সরকারের নথিতে রয়েছে শুধু তাদের ফেরত নেওয়া হবে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানকে জাতিগত নিধনযজ্ঞের প্রামাণ্য উদাহরণ বলে আখ্যায়িত করেছে। চতুর্দিকের সমালোচনার মুখে মিয়ানমার বলছে, রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে চলতি মাসের শেষ দিকে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে বৈঠকে বসবে। যাদের ফিরিয়ে আনা হবে তাদের বাড়িঘর না থাকলে আপাতত অস্থায়ী ক্যাম্পে রাখা হবে। রাখাইনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা সারা বিশ্বের নিন্দা কুড়িয়েছে। বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করতে সে দেশের সরকার একের পর এক অপকৌশলের আশ্রয় নিচ্ছে। রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের বিরোধিতা না করলেও প্রতিদিন ১০০ জনকে ফেরত নেওয়া এবং পরিচয়পত্র যাদের আছে শুধু তাদের নেওয়ার বক্তব্য ধোঁকাবাজির শামিল। প্রথমত, প্রতিদিন ১০০ করে রোহিঙ্গা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলে তাতে ৫০ বছর কেটে যাবে। দ্বিতীয়ত, গণহত্যা ও জ্বালাও-পোড়াও ধ্বংসযজ্ঞের শিকার একটি জাতিগোষ্ঠীর যে সদস্যরা প্রাণভয়ে পালিয়ে এসেছেন তারা কতজন পরিচয়পত্র নিয়ে পালিয়ে আসতে পেরেছেন, তাও একটি প্রশ্নের বিষয়। এ প্রহসন রোধে স্বল্প সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে মিয়ানমারকে রাজি করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে উদ্যোগী হতে হবে।

লেখক : চেয়ারম্যান, ইফাদ গ্রুপ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist