মাহমুদ আহমদ

  ২০ অক্টোবর, ২০১৭

ধর্ম

মাজহাবের কারণে রক্তপাত

বিশ্বের যেদিকে তাকাই শুধু অশান্তি আর অশান্তি। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বিশ্বের কোথাও না কোথাও রক্তপাতের ঘটনার সংবাদ পাওয়াই যায়। তাই হাজার মানুষের হত্যার সংবাদও এখন আর আমাদের ব্যথিত করে না। ভোর হলেই মনের মাঝে অজানা এক আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে, না জানি আজকে কোন দেশে কত মায়ের বুক খালি হয়। সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর যে জুলুম অত্যাচার চালানো হয়েছে এবং হচ্ছে, তা কি মেনে নেওয়া যায়? আজ পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ আছে কী, যারা এ দাবি করতে পারে যে, আমরা সম্পূর্ণভাবে সন্ত্রাসী হামলা থেকে নিরাপদ? মোটেও না। সমগ্র পৃথিবীতেই যেন এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। অথচ সব মানব একই আদম-হাওয়ার বংশধর এবং এক আল্লাহপাকের সৃষ্টি। অর্থাৎ আমাদের সবার সৃষ্টি একই উৎস থেকে। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘হে মানুষ! তোমাদের প্রভু-প্রতিপালকের তাকওয়া অবলম্বন করো, যিনি একই সত্তা থেকে তোমাদের সৃষ্টি করেছেন এবং তা থেকে তার সঙ্গী সৃষ্টি করেছেন আর তাদের উভয় থেকে বহু নর ও নারী ছড়িয়ে দিয়েছেন।’ (সুরা আন নিসা, আয়াত : ১)। মানুষ হিসেবে আমরা সবাই একই উম্মাহর অন্তর্ভুক্ত এবং একই বংশধর হওয়া সত্ত্বেও আজ আমরা একে অপরের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব পোষণ করছি।

আল্লাহপাক সব আদম সন্তানকে প্রভূত সম্মান ঠিকই দান করেছেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে আমরা সেই সম্মান ধরে রাখতে পারিনি। সব আদম সন্তানকে আল্লাহতায়ালা সমভাবে সম্মানিত করেছেন এবং কোনো বিশেষ জাতি বা গোত্রের প্রতি পক্ষপাতমূলক ব্যবহার করেননি। একজন মানুষ সে যে ধর্মেরই হোক না কেন, তার মূল পরিচয় হলো সে আদম সন্তান আর আদম সন্তান হিসেবে সব ধর্মের মানুষ একই উম্মত। আল্লাহপাকের কাছে সবাই সমান মর্যাদার অধিকারী। মানুষ হিসেবে তিনি কাউকে পৃথক করেননি। তার দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং একই উম্মাহ কিন্তু পরবর্তীতে মানুষ বিভিন্ন দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে যায়। যেমন কোরআনে উল্লেখ আছে, ‘আর মানবজাতি একই সম্প্রদায়ভুক্ত ছিল। পরবর্তীতে

তারা মতভেদ করল’ (সুরা ইউনুস, আয়াত : ১৯)। ‘কিন্তু তারা তাদের মাঝে নিজেদের বিষয়কে বহু খন্ডে খন্ডিত করে ফেলেছে। প্রতিটি দল তাদের কাছে যা আছে তা নিয়ে

অহংকার করছে’ (সুরা মোমেনুন, আয়াত : ৫৩)। আসলে সমসাময়িক নবীর মৃত্যুর পরে নবীর অনুসারীরা সাধারণত নিজেদের মধ্যে মতভেদ শুরু করে এবং দলে-উপদলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি দলই মনে করে তারাই নবীর সত্য অনুসারী এবং অন্যরা ভ্রান্ত কিন্তু সব নবী অনুসারীরাই আদম-হাওয়ারই বংশধর।

আল্লাহপাক এই পৃথিবীতে অসংখ্য নবী-রাসুল পাঠিয়েছেন মানবের সংশোধন আর দলে-উপদলে বিভক্ত না হয়ে সবাই যেন একই সৃষ্টিকর্তার ইবাদত করে। এক নেতৃত্বের অধীনে থেকে জীবন পরিচালিত করাই খোদাতায়ালার ইচ্ছা আর এ লক্ষ্যেই তিনি নবী-রাসুলদের প্রেরণ করেছেন। আজ মুসলিম জাহানের অবস্থার দিকে লক্ষ করলে সহজেই বোঝা যায়, তাদের অবস্থা কোন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে। সমগ্র মুসলিম জাহান আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শ্রেষ্ঠ নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অনুসারী মুসলমানরা আজ নিজেরাই নিজেদেরকে হত্যা করছে। এর কারণ কী? এর মূল কারণ হচ্ছে, মুসলমান আজ পবিত্র কোরআনের আদেশ ও শ্রেষ্ঠ নবীর শিক্ষার ওপর আমল করা ছেড়ে দিয়ে মাজহাব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। পবিত্র কোরআন কী বলে তার অনুসরণ না করে মাজহাবের অনুসরণ করছে। অথচ মহানবী (সা.) নির্দিষ্ট কোনো মাজহাবের কথা বলেননি, তিনি তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের পক্ষ থেকে নাজিলকৃত পবিত্র কোরআনের প্রচার করেছেন। আল্লাহপাকের কি কোনো মাজহাব আছে?

এক জাতি হিসেবেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সবাইকে সৃষ্টি করেছেন। যেভাবে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় তোমাদের এই উম্মত একই উম্মত এবং আমিই তোমাদের প্রভু-প্রতিপালক। অতএব তোমরা আমার ইবাদত করো’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৯২)। ‘আর জেনে রাখ তোমাদের এ সম্প্রদায় একটিই সম্প্রদায়। আর আমি তোমাদের প্রভু-প্রতিপালক।’ (সুরা মোমেনুন, আয়াত : ৫২)। সবার সৃষ্টি যেহেতু একই ঐশী উৎস থেকে তাই সকলের মূল কাজ হলো সবার মাঝে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করা। আজ একেক মাজহাবের অনুসারীরা যার যার সুবিধা অনুযায়ী হাদিস তৈরি করে নিয়েছে আর তা দিয়ে অপরকে আঘাত করছে।

সমগ্র বিশ্বে আজ মাজহাবের কারণে মরছে নিরীহ মানুষ। আজ পৃথিবীতে যেমন সুন্নিরা আক্রান্ত হচ্ছেন শিয়াদের দ্বারা, শিয়ারা আক্রান্ত হচ্ছেন সুন্নিদের দ্বারা। আবার আহমদিয়া মুসলিম জামাতের সদস্যরাও সেখানে আক্রান্ত হচ্ছেন প্রতিনিয়ত। পাকিস্তানে আজ এমন কোনো দিন অতিবাহিত হয় না যেখানে মাজহাবের ফেরে ডজনখানেক লোককে প্রাণ হারাতে হয়। এ ছাড়া ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ বিশ্বের বহু দেশে কেবলমাত্র এই মাজহাবের কারণে প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাতে হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের। চালানো হচ্ছে নিরীহ-নিরপরাধ অবোধ শিশুদের ওপর একের পর এক বর্বরোচিত হামলা। সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যে নির্যাতন এর মূলেও কিন্তু মাজহাব। মিয়ানমার থেকে কোনো মতে জীবন নিয়ে আমাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া লাখো রোহিঙ্গা মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে হাজারো শিশু, যাদের বয়স শূন্য থেকে ১০ বছরের মধ্যে। এসব শিশুর একটিই প্রশ্ন ‘কেন তারা বিশ্বের অন্য শিশুদের মতো বাঁচতে পারবে না, আমাদেরকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে দাও’। শিশুদের তো কোনো মাজহাব বা ধর্ম নেই। সব শিশুই জন্মগ্রহণ করে এক আল্লাহপাকের উম্মত হিসেবে, কিন্তু পরবর্তীতে পরিবেশ পরিস্থিতির কারণে একেকজন ভিন্ন ভিন্ন মত-পথ অনুসরণ করে।

বেশ অনেক বছর ধরেই মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনে সৌদি আরবের নেতৃত্বে চলছে মাজহাবি যুদ্ধ। ওয়াহাবি আর সুন্নিরা আক্রমণ চালাচ্ছে শিয়াদের ওপর। ইয়েমেনের রাজধানী সানায় যুদ্ধবিমান থেকে একের পর এক বোমাবর্ষণও তখন প্রায় করা হতো আর এতে প্রাণ হারাত শত শত ইয়েমেনি মুসলমান। যেহেতু সৌদি আরবের অর্থের কোনো সমস্যা নেই তাই সৌদি আরবের সঙ্গে মিসর, জর্ডান, মরক্কো, সুদান, পাকিস্তানসহ বেশ কয়েকটি মুসলিম দেশ একাত্মতা ঘোষণাও করেছে। অন্যদিকে ইয়েমেনে হামলায় সৌদি আরবকে অস্ত্রপাতি সরবরাহ ও গোয়েন্দা সহায়তা দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। বিষয়টি আমাদেরকে অনেক ভাবিয়েছে।

হে আদম সন্তান! হে মানুষ! হে মুসলমান! আসুন, আমরা মাজহাবের নামে রক্তের হোলি খেলা বন্ধ করি। আর দয়াল আল্লাহপাকের কাছে এই মোনাজাত করি, হে আল্লাহ! তুমি তোমার এই শান্তিময় ভূমিতে এমন এক ঐশী ইমামকে পাঠাও যিনি মাজহাবের খাঁচা থেকে আমাদের মুক্তি দিয়ে পৃথিবীকে করবে একই উম্মাহভুক্ত, যেখানে থাকবে না কোনো ভেদাভেদ, কোনো রক্তারক্তি আর মারামারি।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist