আবদুর রহমান

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

বন্যা

এমন তো কথা ছিল না

নদীমাতৃক বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় সাত শ নদীর রয়েছে বৃহৎ অববাহিকা। দেখতে অনেকটা ‘ব’ অক্ষরের ন্যায় বলে একে ব-দ্বীপ বলেও চিহ্নিত করা হয়েছে। এটি পৃথিবীর মধ্যে বৃহত্তম ব-দ্বীপ। ভাটির দেশ হলেও উত্তরাঞ্চলের তিনটি জেলা ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও দিনাজপুর বঙ্গোপসাগরের উপকূল হতে প্রায় ৫৫ ফুট উচ্চতায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এ জেলাগুলো এবার ভয়াবহ বন্যার শিকার হয়েছে। আমার নিজ জেলার টাঙ্গন নদীর তান্ডবে ভেসে যেতে দেখেছি কয়েক হাজার পরিবারের বসতভিটাসহ সর্বস্ব। বন্যা সেখানে কেড়ে নিয়েছে পাঁচটি তরতাজা প্রাণ। অথচ এই নদীটি বছরের ১১ মাসই মরা নদী বলে খ্যাত। ভাটি অঞ্চলে অবস্থান ও উজানের দেশ ভারতের বিমাতাসুলভ আচরণের কারণে সৃষ্টি হয় সাম্প্রতিক বন্যা। মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ুজনিত পরিবর্তন ও উন্নত দেশগুলোর অবিরত কার্বন নিঃসরণে বৈশি^ক উষ্ণায়নের বিরূপ প্রভাবও দুর্যোগের অন্যতম কারণ। প্রশ্ন হলো, তাহলে কি ভাটিতে অবস্থানের কারণে আমরা দিনের পর দিন প্রাকৃতিক দুর্যোগের যন্ত্রণা ভোগ করতেই থাকব, নাকি স্থায়ী পরিত্রাণের পথে এগিয়ে যাব? অথবা বড় মাছ ছোট মাছকে গিলে খাওয়ার নীতিতেই অটল থাকব?

চলতি বছরেই ঘটে গেল হাওরের অকাল বন্যা, পাহাড়ধস ও সাম্প্রতিককালের ভয়াবহ বন্যা। যাতে বিপন্ন মানবতার পাশাপাশি হুমকিতে ফেলেছে দেশের খাদ্য নিরাপত্তা। হাওরসহ সম্প্রতি বন্যার দায়টা কার? আমাদের নাকি পাশর্^বর্তী বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র ভারতের? আমাদের যেমন দায়, তেমনি বড় দায় বর্তায় ভারতের ওপরও। কেননা হাওরে পাহাড়ি ঢলের পানি এসেছিল ভারত থেকে। উজানে নদী শাসন করা ভারত তার দেশের গেটগুলো খুলে দেওয়ার কারণেই সৃষ্ট হয় ভয়াবহ বন্যা। আমাদের দায়ও কম কিছু নয়। যেমন-হাওর রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থতা, বরাদ্দের অপর্যাপ্ততাসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে দুর্নীতি-অনিয়ম। তাছাড়া নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ নিশ্চিত করে পানি বণ্টন চুক্তির ব্যর্থতা তো রয়েছেই। তাই বানভাসিদের পর্যাপ্ত ত্রাণ-ভর্তুকি দিয়ে যেমন পুনর্বাসন জরুরি, তেমনি জরুরি কিভাবে স্থায়ী পরিত্রাণ পাওয়া যায় তাতে মনোযোগী হওয়া।

এমন হওয়ার কথা তো ছিল না। বানভাসি মানুষের চোখে-মুখে স্বপ্ন ছিল সোনালি ফসলে ভরে উঠবে বাড়ির আঙ্গিনা, মিলবে বার্ষিক মোটা ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা, হাসি-খুশিতে ভরে উঠবে কৃষকের পরিবার। কিন্তু বিধিবাম, অপ্রত্যাশিত বন্যা তাদের চোখে এনে দিল নির্দয় কান্না। স্বপ্নিল চোখে নেমে এলো অমানিসার অন্ধকার। প্রশ্ন হলো তাদের দুর্গতি কার দোষে? শুধু কি প্রকৃতিই দায়ী, নাকি আমাদেরও দায় রয়েছে? যাই হোক গত ২৯ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢল ও অসময়ের বৃষ্টিতে তলিয়ে গিয়েছিল দেশের ৬ জেলার (সুনামগঞ্জ, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ ও সিলেট) দুই লক্ষাধিক হেক্টর জমির ৩০ লাখ টন বোরো ধান। হাওরবাসীর প্রধান উপজীবিকা হলো ধান উৎপাদন ও হাওরের মাছ সংগ্রহ। ধান তো গেছে, বিকল্প আয়ের উৎস হিসেবে হাওরের মাছেও লেগেছিল মড়ক। এতে কৃষক যেমন দিশেহারা তেমনি সাধারণ জেলেরা পার করেছে এবং করছে মানবেতর জীবন। এহেন পরিস্থিতিতে সর্বস্ব হারানো কৃষকদের মুখে জুটছে না অন্ন, অন্যদিকে মহাজনদের ঋণ পরিশোধের তাগাদায় দিশেহারা করে তুলেছে মানুষগুলোকে। মঙ্গাপীড়িত মানুষগুলো কৃষির খরচ মেটাতে চড়া সুদে সুদী মহাজনদের কাছে আগাম অর্থ নেয়। বোরো ফসল ঘরে তোলার পর আসল-সুদ পরিশোধ করে, বাকিটা বছরভিত্তিক কিস্তির ওপরই পরিশোধের ব্যবস্থা। কিন্তু এবার অকাল বন্যায় ফসল নষ্ট হওয়ায় তারা পড়েছে চরম বিপাকে। অনেকে মহাজনের ভয়ে হয়েছে বাড়িছাড়া।

সাম্প্রতিক বন্যায় ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, এ বন্যার পানিতে ভেসে ঝরে গেছে ৯৩টি তরতাজা প্রাণ। চার লক্ষাধিক হেক্টর ফসলি জমির ধান পানিতে ডুবে হয়েছে বিনষ্ট। সেই সঙ্গে ¯্রােতের তোড়ে ভেঙে গেছে প্রায় এক কোটি মানুষের আবাসস্থল। প্রশ্ন হলো, এ বন্যার জন্য দায়ী কি অতিবৃষ্টি নাকি ভারত কর্তৃক নদী শাসন করা বাঁধের গেট খুলে দেওয়া? ফারাক্কাসহ তিস্তার গেটগুলো খুলে দেওয়ার জন্যই দেশের এই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি। বন্ধু রাষ্ট্র ভারত শুকনো মৌসুমে জল আটকিয়ে নিজেদের কাজে ব্যবহার করে যেমন শুকিয়ে মারছে আবার বন্যার হাত থেকে বাঁচতে ডুবিয়েও মারছে আমাদের। বাংলাদেশে যে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদী রয়েছে তার সব কটিই দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চল দিয়ে প্রবেশ করেছে আমাদের ভূ-খন্ডে। মাস চারেক আগে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে হাওরের অকাল বন্যার ধকল আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। পারিনি সর্বস্বহারা মানুষদের পুনর্বাসন করতে। দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে অথচ দুর্গত এলাকার মানুষদের দায়িত্ব আমাদের রাষ্ট্র নিতে পারছে না। যা অমানবিক ও দুর্ভাগ্যজনক। উত্তরাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মধ্যাঞ্চলসহ মোহনায় অবস্থিত জেলাগুলোতে এখনো বিরাজ করছে ভয়াবহ বন্যা। নতুন করে যমুনার পানি বৃদ্ধির কারণে ডুবে যাচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। নদী ভাঙনের কারণে নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে হাজার হাজর একর ফসলি জমিসহ মানুষের বসতবাড়ি। ভেঙে পড়েছে শিক্ষা ব্যবস্থাসহ চিকিৎসা সেবা। সরকারের উচিত বন্যা-পরবর্তী অবস্থা মোকাবিলায় সক্রিয় ভূমিকা এবং ত্রাণ তৎপরতা বাড়িয়ে তা বিতরণে অনিয়ম দূর করা।

সক্রিয় ভূমিকা ও অনিয়ম দূর করতে সরকারকে দেশের ১৩৭টি হাওরকে রক্ষায় টেকসই বাঁধ নির্মাণে বিশেষ বরাদ্দ দিতে হবে ও জলাধারগুলোর পানি ধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হাওরের তলদেশের সঞ্চিত পলি অপসারণ করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক সম্পদের আধার হাওরসমূহকে লিজ প্রথা বাতিলের মাধ্যমে হাওরবাসীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে উন্মুক্ত করা ও কৃষকদের প্রণোদনা দিয়ে ক্ষতি পোষাতে সরকারি সহায়তা বৃদ্ধি করা। তাছাড়া দেশের মানুষকে বন্যার করাল গ্রাস থেকে মুক্তি দিতে ৫৪টি আন্তর্জাতিক নদীর (যেগুলো ভারত হয়ে আমাদের দেশে ঢুকেছে) স্বাভাবিক পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া। প্রয়োজনে ভারতকে চাপ প্রয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হতে হবে। কেননা শুষ্ক মৌসুমে ভারত নদীগুলোতে বাঁধের গেট আটকিয়ে পানি সংরক্ষণ করার কারণেও আমাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যেমন-পানি প্রত্যাহারের কারণে তাদের ভূখন্ডের নদীগুলোতে বিশাল জলরাশি থেকে যায়, আবার বর্ষা মৌসুমে সে পানির সঙ্গে অতিরিক্ত পানি যুক্ত হয়ে তাদের দেশে বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তারা বাধ্য হয়ে নিজের দেশকে বাঁচাতে সঞ্চিত পানির সঙ্গে যুক্ত হওয়া অতিরিক্ত পানি বাঁধের গেট খুলে দিয়ে ভাটির দেশ বাংলাদেশে প্রেরণ করে। তখন আমাদের দেশ অপ্রত্যাশিত বন্যাকবলিত হয়ে মানবিক বিপর্যয়ে পড়ে, যেটা বন্ধুপ্রতিম দেশের নির্মম উপহাস। শুষ্ক মৌসুমে তারা আমাদের শুকিয়ে মারে আর বর্ষা মৌসুমে ডুবিয়ে দেয়। অথচ অমানবিক ও অন্যায়ভাবে তারা যদি বাঁধ নির্মাণ না করত, তবে নদীগুলোতে থাকত স্বাভাবিক পানি প্রবাহ। তাছাড়া বর্ষা মৌসুমে স্বাভাবিক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হলেও ভয়াবহ আকার ধারণ করত না। বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে পরিবাহিত পলি এসে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে নদীর পানি ধারণ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। সেজন্য পরিকল্পিতভাবে পলি অপসারণে নদী ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করে তলদেশের গভীরতা বাড়িয়ে পানি ধারণ ক্ষমতা

বাড়াতে হবে। যদিও দেশে নদী সংরক্ষণ কমিশন ও আইন রয়েছে, কিন্তু তাদের কার্যক্রমে গতিশীলতা নেই। সেজন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে নদী বিশেষজ্ঞ নিয়োগের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়ানো সময়ের দাবি। পাহাড়ধস ঠেকাতে পাহাড়খেকোদের আইনের আওতায় এনে ভৌগোলিক ভারসাম্য রক্ষাও জরুরি এবং দেশবাসীর প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist