মাহমুদ আহমদ

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিবন্ধ

ঐক্যের বিকল্প নেই মুসলিম বিশ্বের

আজ পৃথিবী জুড়ে শুধু অশান্তি আর অশান্তি। যেদিকে তাকাই নির্মমতা-নিষ্ঠুরতার নানা দৃশ্য নজরে পড়ে। ভার হয়ে আসে মন। মুসলিমজাহান আজ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত আজ সর্বগ্রাসী অবক্ষয়ের শিকার হয়ে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর এখন নির্মম ও বর্বর হামলা চালানো হচ্ছে এবং লাখ লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচাতে মাতৃভূমি ছেড়ে বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আমাদের দেশেও কয়েক লাখ নির্যাতিত রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। এমন বর্বর ও নিষ্ঠুর হামলায় শুধু মিয়ানমারেই নয়, বরং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে। সমগ্র বিশ্বে কেন মুসলমানরা প্রতিনিয়ত নির্যাতিত হচ্ছে? এর একটাই কারণ, মুসলমানরা আজ শতধা বিভক্ত হয়ে পরস্পর ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত। মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর পরস্পরের মাঝেই নেই ঐক্য। মুসলমানদের এই অনৈক্যের কারণেই তারা বিভিন্ন জায়গায় নিষ্পেষণের শিকার হচ্ছে এবং ভ্রাতৃঘাতী দ্বন্দ্ব সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়তেও দ্বিধাবোধ করছে না। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের এই চরম বিপর্যয়ের মূলে আরেকটি বিষয় স্পষ্ট, তা হলো তাদের কোনো ঐশী খলিফা বা নেতা নেই। মুসলিমজাহান আজ নেতৃত্বশূন্যতায় দিন কাটাচ্ছে। এর জন্যই মূলত তাদের আজকের অধঃপতন। মুসলিম বিশ্বের একতাই পারে জাতিগুলোকে শক্তিশালী করতে। আজ যদি সমগ্র বিশ্বের একজন ইসলামী নেতা থাকত, মুসলিম জাতি একতাবদ্ধ থাকত-তাহলে মুসলমানদের ওপর এমন নির্মম অত্যাচার করার কারো সাহস থাকত না। পৃথিবীতে আজ ইহুদি, নাসারা আর মুশরিকরা তাদের ক্ষমতা বিস্তার করতে চায়। এ কারণে তারা সারা পৃথিবীতে তাদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আর এই সন্ত্রাসী কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করছে ইঙ্গ-মার্কিন পরাশক্তি। ইঙ্গ-মার্কিন এ পরাশক্তি কখনো প্রকাশ্যে আবার কখনোবা পরোক্ষভাবে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ইহুদি, নাসারা আর মুশরিকদের মূল টার্গেট হচ্ছে মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা জানে, যত দিন মুসলিম জাতি মাথা উঁচু করে থাকবে, ততদিন তাদের ক্ষমতা পৃথিবীর বুকে টিকে থাকবে না। তাই তারা সংঘবদ্ধ হয়ে মুসলিম নিধনে অগ্রসর হচ্ছে। এই টার্গেট নিয়ে আজ গোটা পৃথিবীতে মুসলমানদের ওপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালানো হচ্ছে। যাতে মুসলমানরা পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে।

বর্তমানে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনীর আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে ফিলিস্তিন, কাশ্মীর, আরাকান, চেচনিয়া, বসনিয়া, আফগানিস্তান, হার্জেগোভিনা, লেবানন, ইরাক প্রভৃতি মুসলিম দেশ। সামান্য অজুহাত দেখিয়ে শান্তিপ্রিয় মুসলিম দেশগুলোর ওপর টনেকে-টন বোমা ফেলে তাদের ঘাড়ে দৈত্যের মতো চেপে বসছে। এতে লাখ লাখ নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশু অকাতরে মারা যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো এই মৃত্যুর লীলা খেলা আর কতকাল চলবে? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলতে পারি, যতদিন সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক ঐশী নেতৃত্বের পদতলে না আসবে তত দিন এই মৃত্যুর লীলা খেলা চলতে থাকবে।

আমরা ইরাক, আফগানিস্তানের কথা বাদই দিলাম, আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কথাই যদি ধরি- তাহলে দেখতে পাই আধিপত্যবাদীদের হাতে দীর্ঘদিন ধরে শৃঙ্খলিত হয়ে আছে ৮০ লাখ নিরীহ কাশ্মীরবাসীর জীবন। ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এই উপত্যকায়, তবু বিশ্ববাসী কেন নীরব? ভারতের নৃশংস জিন্দানখানা থেকে কাশ্মীরবাসীকে উদ্ধার করার কোনো চেষ্টাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

এছাড়া মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিও দিন দিন খারাপ হতে চলেছে। যেহেতু প্রায় সমগ্র এলাকাটি মুসলমানদের, তাই স্বভাবতই পৃথিবীর সব মুসলমান অবশ্যই এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। বিশেষ করে, মুসলিম দুনিয়ার সবচেয়ে প্রিয় স্থানদ্বয় পবিত্র মক্কা এবং মদিনাও আজ বিপদ ও ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন। বর্তমানকালের রাজনীতি নোংরা, ন্যায়বিচারশূন্য ও তাকওয়াহীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেসব মুসলিম রাষ্ট্র আজ ইসলামের নামে বড়াই করছে, প্রকৃতপক্ষে তাদের কর্মকান্ড ইসলামী শিক্ষা বা ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। বরং তারা নিজ স্বার্থ উদ্ধারে সচেষ্ট। এ জন্যই ইসলামী বিশ্বের বিভিন্ন কার্যক্রম ও পদক্ষেপে স্ববিরোধিতা লক্ষ করা যায়। আজ যদি সবাই কোরআনের শিক্ষা অনুযায়ী একক নেতৃত্বের অধীনে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব চলত তাহলে অবশ্যই মুসলমানরা সর্বত্র মার খেত না।

ইসলাম আল্লাহর মনোনীত ধর্ম। তাই ইসলাম মানুষের মনে অসাধারণ গুণের ও মহত্ত্বের উন্মেষ ঘটাবে- এটাই স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে ঘটেছেও তাই। স্বনিষ্ঠ ইসলাম অনুসারীদের মাঝে হতে দেখা গেছে বহু অসাধারণ গুণের ও মহত্ত্বের সমাবেশ। একনিষ্ঠ ইসলামের অনুসারীরা হয়েছে সব অসাধারণ মানবিক, নৈতিক ও মহৎ গুণের অধিকারী। এ জন্যই ইসলাম অনুসারী মুসলমানরা সর্বক্ষেত্রে অতি আশ্চর্যজনক সাফল্য লাভ ও সুমহান কীর্তি স্থাপন করে সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে এক অতি গৌরবোজ্জ্বল ঐতিহ্য। তাদের সে সাফল্য প্রকৃতই অতীব বিস্ময়কর। মুসলমানরা হয়েছিল বিশ্বের অর্ধেকের মালিক। তারা প্রবল প্রতাপ ও শান-শওকতের সঙ্গে শাসন করেছে অর্ধজাহান। শৌর্যবীর্য, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি প্রকৃতি সব ক্ষেত্রেই তাদের সাফল্য ছিল অতীব চমকপ্রদ। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো জাতিই ছিল না তাদের সমকক্ষ। মুসলমানরা বিশ্বে সব ক্ষেত্রেই ছিল শীর্ষস্থানীয়, নেতৃস্থানীয়। যুদ্ধ থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জনে সক্ষম হওয়ায় তাদের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বব্যাপী। সে যুগে মুসলমানরাই দিয়েছিল বিশ্বনেতৃত্ব। অসাধারণ জাতি রূপে, শ্রেষ্ঠতম জাতি রূপে মুসলমানরাই লাভ করেছিল প্রতিষ্ঠা। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সাফল্য ও খ্যাতি এতই অসাধারণ ছিল যে, তারা আখ্যায়িত হয়েছেন বহু আলঙ্কারিক বিশ্লেষণে, প্রশংসিত হয়েছেন পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যের বড় বড় মনীষী কর্তৃক। বহু অসাধারণ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় মুসলমানরা উন্নতির শীর্ষে পৌঁছেছিল সত্য, তবে এ কথা বলাই বাহুল্য যে, পরবর্তীকালে সময়ের সঙ্গে তাল রেখে আরো এগিয়ে যেতে, নিজেদের সে প্রতাপ, প্রতিপত্তি, প্রাধান্য ও বিশ্ব নেতৃত্ব বজায় রাখতে তারা হয়েছিল ব্যর্থ। এর কারণ কী? শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে এবং অর্ধজাহান শাসনের বিশ্বনেতৃত্ব যাদের গৌরবময় ঐতিহ্য, তারা আজ কোথায়? আজ এত এত মুসলমান দেশ থাকা সত্ত্বেও কেন পারছে না মিয়ানমারে গণহত্যা বন্ধ করতে? কেন পারছে না মুসলমান বিশ্বনেতৃত্ব দান করতে? এর একমাত্র কারণ হলো-মুসলিম বিশ্বের কোনো একক নেতা নেই। নেতাশূন্য বলেই মুসলমানরা সমগ্র বিশ্বে অপদস্থ হচ্ছে। আজ এ অনৈক্যের কারণেই দেশে দেশে যুদ্ধবিগ্রহ লেগেই আছে, এ শেষ হওয়ার নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না মুসলিম বিশ্ব এক ইমামের নেতৃত্বে চলবে। যে জাতির কোনো আধ্যাত্মিক নেতা নেই, সেই জাতিকে কী জীবিত বলা যায়? সে জাতি তো মৃত।

আজ সমগ্র বিশ্বে কোটি কোটি মুসলমান রয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাদের নেই কোনো নেতা, যিনি সবার জন্য দোয়া করবেন। আল্লাহর নিকট চাইবেন, জাতির দুঃখে পাশে এসে দাঁড়াবেন। কেউ কি আজ বলতে পারে যে, তাদের এই ধরনের আধ্যাত্মিক নেতা রয়েছে? কোনো মুসলিম সম্প্রদায় আজ এমন নেই, যারা বলতে পারবে যে তাদের এমন এক নেতা রয়েছেন, যিনি আমাদের জন্য দোয়া করেন, আমাদের আলো দেখানোর ব্যবস্থা করবেন। বর্তমানে বিশ্বে একজন ইসলামী নেতার খুবই প্রয়োজন। একক নেতৃত্ব ছাড়া বিশ্বের মুসলমান মাথা উঠিয়ে দাঁড়ানো কোনো মতেই সম্ভব নয়। সমগ্র মুসলিম বিশ্বের আবার মাথা তুলে দাঁড়ানো খুবই প্রয়োজন।

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist