এস এম মুকুল

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ভালোমন্দ

সমকালের কড়চা

দুর্ভোগের শহর : বিশ্বে সবচেয়ে দুর্ভোগের নগরীর তালিকায় রাজধানী ঢাকা সাত নম্বরে। এক জরিপে বিশ্বে সবচেয়ে কম ও সবচেয়ে বেশি নাগরিক দুর্ভোগের শহরের তালিকায় উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার নাম। এই জরিপ করা হয়েছে শহরের ট্রাফিক ব্যবস্থার শৃঙ্খলা, গণপরিবহনের পরিবেশ, নগরে সবুজ উদ্যানের পরিমাণ, নাগরিকদের আর্থিক অবস্থা, তাদের ঋণ নেওয়ার পরিমাণ, শারীরিক ও মানসিক অবস্থা এবং বছরে শহরটি সূর্যের আলো কতখানি পায় তার ওপর ভিত্তি করে। জরিপটি পরিচালনা করেছে ইংল্যান্ডের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা বিশ্বের ১৫০টি শহরের ৫০০ স্থানে ১৭ ক্যাটাগরিতে তথ্য সংগ্রহ করে তাদের ফল প্রকাশ করেছে। জরিপে বিশ্বে সবচেয়ে দুর্ভোগের নগরীর তালিকায় প্রথম হয়েছে ইরাকের বাগদাদ, দ্বিতীয় আফগানিস্তানের কাবুল, তৃতীয় নাইজেরিয়ার ল্যাগোস, চতুর্থ সেনেগালের ডাকার, পঞ্চম মিসরের কায়রো, ষষ্ঠ ইরানের তেহরান, সপ্তম বাংলাদেশের ঢাকা, অষ্টম পাকিস্তানের করাচি, নবম ভারতের নয়াদিল্লি আর দশম হয়েছে ফিলিপাইনের ম্যানিলা। আর নাগরিকদের ভালো জীবনমান স্বস্তিময় শহরের তালিকায় প্রথম হয়েছে জার্মানির স্টুটগার্ট। নাগরিকদের স্বস্তিময় শহরের তালিকায় জার্মানির ৪টি শহরের নাম এসেছে।

মন্তব্য : ঢাকার দুর্ভোগ সীমা ছাড়িয়েছে। বাংলাদেশের রাজধানী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শহর ঢাকা ক্রমশ বসবাসের অনুপযোগিতার পথে এগোচ্ছে- এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক এবং হতাশাজনক খবর। রাজধানী হিসেবে ঢাকা শহরের কলেবর বৃদ্ধি ও নগরায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা অনুসরণ করা হচ্ছে না। সবকটি নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের দায়িত্ব পালন ও নজরদারিতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। উন্নত বিশ্বে নগরের নিয়ম ভঙ্গে ছোট অপরাধের জন্য বড় শাস্তির বিধান কার্যকর রয়েছে। যে কারণে সেসব শহরের নাগরিকরা বড় অপরাধ করবে তো দূরের কথা- ছোট অপরাধ করারই সাহস পায় না। শাস্তি এবং জরিমানা বিধান কার্যকরণে দেশের সবকটি বড় নগরে নগর পুলিশি কার্যকর এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত চলমান রাখতে হবে। ট্রাফিক সিগন্যাল মানা, ফিটনেসবিহীন গাড়ি, যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং, ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার কমানো, আবাসিক এলাকায় অফিস ও বাণিজ্যিক কার্যক্রম বন্ধ করা, এলাকাভিত্তিক স্কুল শিক্ষা বাধ্যতাকরণ, অবৈধ ও অসামাজিক কাজ, ভেজালবিরোধী অভিযান, রাষ্ট্রের সম্পদ দখল ও দূষণ রোধ, নদী ও খালের গতি ফেরানো, শহরে বৃক্ষরোপণ এবং ছাদবাগান, পর্যাপ্ত খেলার মাঠ, বিনোদন পার্ক, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নাগরিক সেবা আধুনিকীকরণ, কর আদায়, বাসা ভাড়া-পাবলিক পরিবহন-স্বাস্থ্যসেবায় শৃঙ্খলা আনয়ন, নাগরিক নিরাপত্তা সর্বোপরি আয়রোজগার নিশ্চিতকরণে বহুমুখী পদক্ষেপ ছাড়া প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এই ঢাকা শহরের দুর্নাম ঘোচানো বা সুদিন ফেরানো সম্ভব নয়। আর নগরের ওপর থেকে জনগণের চাপ কমানোর উদ্যোগ হিসেবে জেলা শহরে আবাসন ব্যবস্থার বিস্তৃতি এবং শিল্প স্থাপনার বিকল্প নেই। তবে সবার আগে ঢাকার দূষণ ও দখল থামাতে হবে। আর সে কাজটির জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে ঢেলে সাজানো খুব জরুরি।

মানুষ মারার ফাঁদ : পোলট্রিশিল্পের বিকাশ ঘটেছে বিশ্বজুড়ে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ব্যবসায়ীরা নিজেদের পকেট ভারি করার স্বার্থে সাধারণ মানুষের জীবনে মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি টেনে আনছেন মুরগি মোটাতাজাকরণে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের মাধ্যমে। বিজ্ঞানীরা আরো বলছেন, প্রতি বছর আমাদের প্রতি ১০ জনের একজনের অসুস্থতার কারণ খাদ্যজনিত। সাধারণত ই. কোলি এবং স্যালমোনেলা ব্যাকটেরিয়া থেকে এসব অসুস্থতা সৃষ্টি হয়। পাঁচ বছরের নিচের বয়সের শিশুদের জন্য এসব ব্যাকটেরিয়া প্রাণঘাতী। আর এই ব্যাকটেরিয়ার বেশিরভাগ জন্ম নেয় পোলট্রিশিল্পে পালিত মুরগি থেকে। জর্জিয়ার প্রাণী বিজ্ঞানী ম্যারিন ম্যাককেনা এ কথা জানিয়ে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ম্যাগাজিনে ‘বিগ চিকেন’ নামে একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সাধারণের মধ্যে একটা ধারণা আছে-অ্যান্টিবায়োটিক বোধ হয় কেবল অসুস্থ মানুষের ওপর প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রসহ গোটা বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিকের বড় অংশ ব্যবহার হয় মাংস শিল্পে।

মন্তব্য : সহজ কথায় খাবার ও পানির সঙ্গে প্রতিদিন মুরগিকে যেসব অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়, সেগুলো আমরা মুরগির মাংস খাওয়ার মাধ্যমে নিজেদের শরীরে প্রবেশ করাচ্ছি। কী সাংঘাতিক বাস্তবতা-মানুষ লাভের লোভে নিজেদের কী ভয়ানক ক্ষতি করছে তা কি কেউ ভাবছি? বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়াগুলো যখন কোনো খাবারের সঙ্গে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ে, তখন ধীরে ধীরে সেই মানুষকেও অসুস্থ করে তুলতে পারে। ভয়ানক ব্যাপারটি হচ্ছে অসুস্থ মানুষটি চিকিৎসকের কাছে গেলে তিনিও হয়তো প্রেসক্রিপশনে অ্যান্টিবায়োটিক সুপারিশ করবেন। কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকে কাজ হবে না। কারণ যে ব্যাকটেরিয়ার কারণে এই অসুস্থতা সৃষ্টি হয়েছে সেই জীবাণুগুলো তো অ্যান্টিবায়োটিকের ডোজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে করতে বিশাল ‘যোদ্ধা’ হয়ে উঠেছে। এখন ওষুধ তাকে কাবু করতে পারবে না। বাহ্ কী নিদারুণ বলে মারণ ফাঁদ। জনস্বার্থে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ব্যাপারটি গুরুত্বসহকারে দেখবে-এটাই প্রত্যাশিত।

স্কুলে স্কুলে সংস্কৃতিচর্চা : মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদমুক্ত দেশ গঠনের লক্ষ্যে ৩০ জেলার তিনশ’ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ‘সংস্কৃতিচর্চা’ শুরু করেছে সরকার। এসব জেলায় এ বছর আরো কিছু বিদ্যালয়ের সংখ্যা বাড়ানো হবে। পর্যায়ক্রমে দেশের ৬৪ জেলাতেই শুরু হবে এই কার্যক্রম। সংস্কৃতি চর্চার চলমান কার্যক্রম অব্যাহত রাখা এবং কলেবর বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘সংস্কৃতি চর্চা’ শিরোনামে একটি পৃথক কোড খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে প্রতিবছর অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ খাতে বাজেট নিশ্চিত করা যায়। সপ্তাহের যেকোনো এক দিন দুই ঘণ্টা করে মাসে চার দিন নির্ধারিত স্কুলগুলোতে ‘সাংস্কৃতিক চর্চা কার্যক্রম’ অনুষ্ঠিত হবে। সারা বছর সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃত্তি, যন্ত্রসঙ্গীত, অভিনয়সহ অন্যান্য বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এতে বছরে ব্যয় হবে ১ কোটি ১৭ লাখ ৯০ হাজার টাকা, যা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বহন করবে। চলমান এই কাজের দেখভাল করছেন সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, জেলা শিক্ষা অফিসার ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, উপজেলা শিক্ষা অফিসার এবং জেলা শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তারা। কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করছেন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তারা।

মন্তব্য : জাতির চেতনা ও মননের বিকাশে কোমলমতি শিশু-কিশোরদের মানসপটে সাংস্কৃতিক জাগরণ ও দেশপ্রেমের মূল্যবোধকে উসকে দিতে পারলে আগামী দিনের নাগরিক হিসেবে তারা বিশুদ্ধ চিন্তা আর দর্শনে নিজেদের মেধার প্রতিফলন ঘটাবে। তার ফলে দেশ উন্নত জাতিসত্তার অধিকারী হিসেবে বিশ্বে মর্যাদা লাভ করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এই সাংস্কৃতিক বলয়ের সঙ্গে প্রত্যেক এলাকার সাংস্কৃতিক কর্মী ও ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করা হলে আরো ভালো ফল পাওয়া যাবে। সরকারের এই কার্যক্রমকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি- সেই সঙ্গে স্বাগত-শুভেচ্ছা এবং এমন উদ্যোগের সাফল্য কামনায় অভিবাদন।

কারাবন্দির-রাজবিলাস : দেশের শীর্ষ সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ীসহ দাগি আসামিরা চিকিৎসার নামে কারাগারের বাইরে বিভিন্ন হাসপাতালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম-আয়েশে থাকছে। হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের বিছানায় শুয়ে এসব আসামি মোবাইল ফোনে তাদের বিভিন্ন চ্যানেলের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। এমনকি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকও ব্যবহার করছে। কেউ কেউ সেখান থেকেই সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনায় অনুসারীদের নির্দেশনা দিচ্ছে। কেউ কেউ আবার ল্যাপটপও ব্যবহার করছে। কারা অধিদফতরের কিছু কর্মকর্তা এবং হাসপাতালের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগসাজশে তারা বছরের পর বছর কারাগারের বাইরে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করছে। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তাদের এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তবে এ রকম কতজন বন্দি বিভিন্ন হাসপাতালে আছে তা জানে না স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিকিৎসাধীন বন্দিদের হিসাব জানার জন্য তাদের তালিকা চেয়ে কারা অধিদফতরকে চিঠি দিয়েছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ। তবে এ ব্যাপারে কারা অধিদফতর কোনো জবাব দিয়েছে কি না তা জানা যায়নি। এবং এখনো পর্যন্ত কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ারও কোনো প্রমাণ নেই।

মন্তব্য : অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অপরাধীদের জন্য এটা কারাগার নয় প্রমোদখানা। আসামিরা কারাবন্দি হয়েও যে রাজসুখে দিন কাটায়- এত স্বস্তি আর সুখ বোধকরি মুক্ত নাগরিক জীবনেও মেলা ভার। দুঃখ আর আফসোস ছাড়া কীইবা করার আছে। অবাক হতে হয়, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার বলেছেন, কোনো বন্দি অসুস্থ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য কারাগারের বাইরের হাসপাতালে পাঠানো হয়। হাসপাতালে পাঠানোর পর সংশ্লিষ্ট বন্দির চিকিৎসা শেষ করা বা চিকিৎসা শেষে কারাগারে ফেরত আনার পুরো বিষয়টি চিকিৎসকের ওপর নির্ভর করে। যদি তাই হবে-তাহলে কারা বিভাগের আর দায়িত্ব কী থাকল। অপরাধী চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে যাবে এবং সেখান থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসবে এই পুরো প্রক্রিয়াটি কারা বিভাগের দায়িত্বের মধ্যে পড়বে, পড়া উচিত। তা না হলে আর কারাগারের দরকার কী?

লেখক : অর্থনীতি বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist