আহমদ আবদুল্লাহ

  ২২ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

ধর্ম

দুনিয়াতে শান্তির পয়গাম ইসলাম

বিশ্বের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারমাধ্যমসমূহের বিরূপ ও পক্ষপাতদুষ্ট নীতির অশুভ পরিণামের ফসল হিসেবে বিভিন্ন মহল কর্তৃক আজ বিশ্বের সর্বত্র ইসলামকে জুলুম, বর্বরতা, পাশবিকতা ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ওই প্রচারমাধ্যমগুলো থেকে এখন তাদের সংবাদ, প্রতিবেদন, সমীক্ষা, ছায়াছবি, সাক্ষাৎকার, প্রচারপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে মানুষের মধ্যে অহরহ এ ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে যে, ইসলাম ও শান্তি দুটি পরস্পরবিরোধী বিষয়। এ দুটি বিষয়ের একত্রে সমাবেশ কখনো সম্ভব নয়। কিন্তু আসল ব্যাপার এই যে, ইসলামী শিক্ষাকে মোটামুটিভাবে অধ্যয়ন করলেও উপরোক্ত ধারণা অমূলক ও ভিত্তিহীন বলে প্রমাণ হবে। যে কোনো বিবেকসম্পন্ন লোকের পক্ষে বিষয়টি হৃদয়ঙ্গম করা মোটেই কঠিন নয়। এক কথায় বলতে গেলে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাবের প্রধান লক্ষ্যই ছিল মানুষের মধ্যে শান্তি ও সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। এই অর্থে তিনি ছিলেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমত তথা আশীর্বাদ স্বরূপ। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মুহাম্মদ! আমি তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি।’ (সুরা আম্বিয়া : ১০৭) সত্যিকারের অর্থে ইসলাম হচ্ছে আগাগোড়া একটি আশীর্বাদ। সন্ত্রাস, জুলুম, অত্যাচার, বর্বরতা ইত্যাদি অসামাজিক অমানবিক অনাচার ও কদাচারের সঙ্গে ইসলামের দূরতম সম্পর্ক নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা উত্তম পন্থা ব্যতীত আহলে কিতাবের সঙ্গে বিতর্ক করবে না। তবে তাদের সঙ্গে করতে পার, যারা ওদের মধ্যে সীমালঙ্ঘনকারী। এবং বল, আমাদের প্রতি ও তোমাদের প্রতি যা অবতীর্ণ করা হয়েছে, তাতে আমরা বিশ্বাস করি এবং আমাদের ইলাহ ও তোমাদের ইলাহ তো এক আল্লাহ। আমরা তারই প্রতি আত্মসমর্পণকারী।’ (সুরা আনকাবুত : ৪৬)। এই আয়াতের মাধ্যমে ইসলামের অনুসারীদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, যেন তারা প্রতিপদে স্থিরতা, ধীরতা, বিজ্ঞতা, ভদ্রতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দেয়। পবিত্র কুরআনে মুসলমানদের আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের সঙ্গেও অনুরূপ আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান রাব্বুল আলামীন বলেন, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে আহ্বান কর হিকমত (বিজ্ঞতা) ও সদুপদেশ দ্বারা এবং ওদের সঙ্গে আলোচনা-পর্যালোচনা (বিতর্ক) কর সদ্ভাবে।’ (সুরা নাহল : ১২৫)।

ইসলাম এতই শান্তিপ্রিয় ধর্ম যে, মুসলমানকে যুদ্ধাবস্থায়ও জুলুম ও বাড়াবাড়িমূলক আচরণ থেকে নিরস্ত রাখে, নির্দোষ মানুষকে বিরক্ত করতে নিষেধ করে, যে কারো সঙ্গে অমানবিক ব্যবহার থেকে দূরে রাখে। এ মর্মে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘শত্রুরা যদি সন্ধির দিকে ঝুঁকে পড়ে তবে তুমিও সন্ধির দিকে ঝুঁকবে এবং আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবে। তিনিই সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।’ (সুরা আনফাল ৬১)। যারা দুশমনের পেশকৃত সন্ধির আহ্বানে সাড়া দেয়, তারা মূলত ওদের মানবিক ও চারিত্রিক স্পৃহাকে জাগ্রত ও প্রস্ফুটিত করে তুলে নিজেদের ওদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত করে। এজন্যই এ জাতীয় লোকদের আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘দীনের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি এবং তোমাদেরকে স্বদেশ থেকে বহিষ্কৃত করেনি তাদের প্রতি মহানুভবতা প্রদর্শন ও ন্যায়বিচার করতে আল্লাহ তোমাদের নিষেধ করেন না। আল্লাহ তো ন্যায় পরায়ণদের ভালোবাসেন।’ (সুরা মুমতাহানা : ৮) যেসব অমুসলিম মুসলমানদের বিরুদ্ধে কোনো রূপ ষড়যন্ত্র করে না এবং তাদের কোনো রূপ কষ্ট দেয় না, ইসলাম তাদের সঙ্গে দয়া, মায়া, হৃদ্য, সহানুভূতি, শুভাকাক্সক্ষা ও শুভেচ্ছামূলক আচরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। অবশ্য যারা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়, তাদের সঙ্গে তাদেরই কর্মদোষের কারণে ভালো ব্যবহার করা যাবে না সত্য, তবে কোনো অবস্থায়ই বাড়াবাড়িমূলক আচরণ করা যাবে না।

মক্কা বিজয়ের মুহূর্তে ইসলামের কট্টর শত্রুদের যাদের অমানুষিক জুলুম অত্যাচারের কারণে একদা রাসূল (সা.) অশ্রুসজল নয়নে আপন প্রিয় মাতৃভূমি পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তাদের বিনাশর্তে ক্ষমা করে দেন। বিশ্ব-ইতিহাসে এ ধরনের দৃষ্টান্ত শুধু তুলনাহীন নয়, অকল্পনীয়ও বটে। অবশ্য তার এই ব্যবহারের ফলে ওই সব কট্টর শত্রুদের হৃদয় বলতে গেলে নিমিষের মধ্যেই এমন পরিবর্তন আসে যে, তারা সত্য-মিথ্যার পার্থক্য নির্ণয় করতে সক্ষম হয়। এবং দলে দলে ইসলাম তথা শান্তির সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। মহানবীর (সা.) কট্টর শত্রু মক্কাবাসীরা যখন ভয়ানক দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়, তখনো দয়াল নবী (সা.) অনতিবিলম্বে তাদের কাছে প্রয়োজনীয় সাহায্য প্রেরণ করেন। যুদ্ধে যে সমস্ত কাফের বন্দি হতো, তিনি তাদের সঙ্গে আপন সহোদরের মতো ব্যবহার করতেন। তায়েফে আল্লাহর দীন প্রচার করতে গেলে হুজুর (সা.)কে প্রস্তর নিক্ষেপে রক্তাক্ত করে তোলা হয়। এতদ সত্ত্বেও তিনি তাদের হেদায়াতের জন্য আল্লাহর কাছে দোয়া করেন এবং পরবর্তী সময়ে যখন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতার অধিকারী হন তখনো তাদের ওপর কোনো প্রকার প্রতিশোধ নেননি, বরং তাদের ক্ষমা করে দেন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.) তার কথা, কাজে ও আচার-আচরণে যে ন¤্রতা, ভদ্রতা ও ধৈর্য-সহিষ্ণুতার নমুনা পেশ করেছেন তা চিরদিন মানুষের জন্য অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় হয়ে থাকবে। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃতপক্ষে ন¤্রতা যে জিনিসের মধ্যে আছে, সে জিনিস সৌন্দর্যমন্ডিত। আর ন¤্রতা যে জিনিসে মধ্যে নেই সে জিনিস দূষণীয়।’ (সহীহ মুসলিম) বিনয়, ন¤্রতা, দয়া, করুণা, সদাচার সদালাপ, সদ্ব্যবহার প্রভৃতি গুণে গুণান্বিত হওয়ার জন্য ইসলাম তার অনুসারীদের বারবার তাগিদ দিয়েছে। আর নির্দেশ দিয়েছে কঠোরতা, নির্দয়তা, অনাচার, অবিচার ও বদমেজাজী থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার। তাই তো হুজুর (সা.) বলেছেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা পরম করুণাময় এবং তিনি প্রতিটি ব্যাপারেই বিনয় ও করুণাকে পছন্দ করেন।’ (বুখারি শরিফ)। রহমতের নবী (সা.) বলেন, ‘মহান রাব্বুল আলামীন ন¤্রতার ওপর ততটুকু দান করেন, যতটুকু কঠোরতার ওপর করেন না এবং ন¤্রতা ছাড়া অন্য কিছুর ওপরও অনুরূপদান করেন না।’ (মুসলিম শরিফ)। বিনয় ন¤্রতাকে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার পছন্দ করাটা এ কথারই ইঙ্গিতবহ যে, এর মধ্যে মানুষের দুনিয়া-আখেরাতের যাবতীয় উপকার ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে। অতএব মানুষের উচিত, তারা যেন নিজেদের মধ্যে ন¤্রতা, স্নেহমমতা ও দয়াবান রূপে গুণাবলির প্রসার ঘটায়, যাতে তাদের সামাজিক, সামষ্টিক ও সামগ্রিক জীবন সুখ-শান্তিতে ভরে ওঠে এবং তারা সব রকম নির্দয়তা, স্বার্থপরতা, অনাচার, কাদাচার, মারামারি, হানাহানি, সন্ত্রাস ও বিশ্বাসঘাতকতা থেকে দূরে থাকতে সক্ষম হয়।

অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয় যে, আজকাল ইসলামের এই মানবিক গুণাবলি ও অতুলনীয় আচার-আচরণের প্রতি আদৌ দৃকপাত না করে ইসলামকে জুলুম, অত্যাচার ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে আখ্যায়িত কারার লক্ষ্যে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসুলের শত্রু ইসলাম-বিদ্বেষী জ্ঞানপাপীরা যেভাবে তৎপর হয়ে উঠেছে এবং তাদের মিডিয়াগুলো যেভাবে সত্যকে মিথ্যায় এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার অপতৎপরতা চালাচ্ছে সেটাকে চরম প্রহসন ছাড়া আর কীই বা বলা যেতে পারে? তবে এ কথা সব মহলের জেনে রাখা উচিত যে, ইসলামের দৃষ্টিতে জালিমের জুলুমের প্রতিবাদ এবং প্রয়োজনে তা প্রতিরোধ করাও ফরজ। এটা কঠোরতা বা সন্ত্রাস নয় বরং বিশ্বে ন্যায়, সভ্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠার একটি সংগ্রাম, যার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করা মানুষ মাত্রেই কর্তব্য। ইসলাম মানে শান্তি ও সম্প্রীতি। তবে এর অর্থ এই নয় যে, জালিমের অন্যায় জুলুম প্রতিরোধ করা হবে না। বরং ইসলামের আকিদা হচ্ছে জালিমের জুলুম প্রতিরোধ কর এবং মাজলুমের পক্ষ অবলম্বন কর। শান্তিপ্রিয়তার অর্থ এই নয় যে, জালিমের জুলুম মুখবুজে সহ্য করা হবে, তাকে চিরদিন সিংহরূপেই টিকিয়ে রাখা হবে, এমনকি প্রয়োজন দেখা দিলে তার কাছে নিজের কাপুরুষতা প্রকাশ করে করজোড়ে তারই সাহায্য প্রার্থনা করতে হবে। অনুরূপ মানসিকতা কুরআন-হাদিসের সত্যিকার অনুসারী কোনো মুসলমান হতে পারে না। বরং এই অবস্থায় তারা হবে সেই মানসিকতারই অধিকারী, যা আল্লামা ইকবাল রচিত নিম্নের দুটি পঙক্তিতে ফুটে উঠেছে। ‘হো হালকা-ই-ইয়ারা, তো বারীশম কী হা মুমিন, বাযমে হাক্বও বাতিল হো তো ফোলাদ হায় মুমিন।’ অর্থ-‘মুমিন যখন তার বন্ধুদের মজলিসে থাকে তখন সে আপন আচরণে রেশমের চাইতেও নরম। আর যখন ন্যায়-অন্যায়ের যুদ্ধ বাধে তখন সে ইস্পাতের চাইতেও কঠিন।’

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist