সাত্ত্বিকতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

দুর্গাপূজা

প্রিয়াশীষ চক্রবর্তী

বৈদিক শাস্ত্রাদিতে ভগবান এবং অংশ সম্ভূত বিভিন্ন দেব-দেবীর রূপ, লক্ষণ ও বিভিন্ন গুণাবলির সুনির্দিষ্ট বর্ণনা রয়েছে। দেবী দুর্গার বর্ণনা দিতে গিয়ে দেবীধ্যানে বলেছেন, ‘দেবী দুর্গা কেশরাশি সংযুক্তা ও ত্রিনয়না। তার বদন পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় সুন্দর, গাত্রবর্ণ অতসীপুষ্পের ন্যায় হরিদ্রাভ। তিনি ত্রিলোকের অধিষ্ঠিতা, নবযৌবন সম্পন্না, নানান আভরণে ভূষিতা। তার বামজানু, কটি ও গ্রীবা এ ত্রিস্থান আংশিক ত্রিভঙ্গভাবে সংস্থাপিত। তার ডান পাঁচ হাতে উপর হতে নিচে যথাক্রমে ত্রিশূল, খঙ্গ, চক্র, তীক্ষèবাণ ও শক্তি এবং বাম পাঁচ হাতে উপর হতে নিচে যথাক্রমে খেটক, ধনু, পাশ, অংকুশ ও ঘণ্টা বা পরশু শোভিত আছে। দেবীর পদতলে ছিন্নস্কন্ধ মহিষ এবং উক্ত মহিষের স্কন্ধদেশ হতে উদ্ভূত হয়েছে মহিষাসুর নামক এক দানব। দেবী দুর্গার নিক্ষিপ্ত ত্রিশূল ওই দানবের হৃদয় বিদীর্ণ হয়ে তার সর্বাঙ্গ রক্তাক্ত হয়েছে। দেবীর দক্ষিণ চরণ সিংহের পিঠে এবং বাম পদাঙ্গুষ্ঠ সামান্য মহিষাসুরের স্কন্ধে সংস্থাপিত।’ প্রতিমা নির্মাণে উপরোক্ত বিষয়গুলো বিবেচ্য হওয়া উচিত। অথচ বর্তমানে শাস্ত্রীয় কাঠামোর বিপরীতে আধুনিকতার নামে প্রতিমার গাত্রবর্ণ ও বেশভূষণে বিভিন্নতার ছোঁয়া লেগেছে। কেবল শাস্ত্র জ্ঞানহীন মূর্খ ব্যক্তিরা পদবিকে নায়ক-নায়িকা কিংবা নর্তকীর বেশে স্বল্প বসনা রূপে উপস্থাপন করছেন। এছাড়াও দুর্গোৎসবে উপাচার ও পূজা পদ্ধতিতেও সাত্ত্বিক ভাবাপন্নের পরিবর্তে তামসিক ও রাজসিক ভাবাপন্ন পরিবেশের পাদুর্ভাব বৃদ্ধি পেয়েছে।

পূজা মানে পূর্ণতা। পূজায় মনপ্রাণ পবিত্র হয়। পূজায় অন্তর্নিহিত সত্তার প্রতি আত্মসমর্পণ না করলে পূজার উদ্দেশ্যই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তাই পূজায় ভক্তি ও মনের বিশুদ্ধতা থাকা চাই। ভক্তিহীন পূজাকে পূজা বলা যায় না। অনেক জাঁকজমকপূর্ণভাবে পূজায় বিভিন্ন রাজকীয় দ্রব্য পরিবেশন করা হলো অথচ ভক্তিসহকারে তা দিলাম না, তাতে সে দ্রব্য সামগ্রী দেবতা কর্তৃক গৃহীত হয় না। এ প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদ গীতায় বলা হয়েছে-

পত্রং পুষ্পং ফলং তোয়ং যো মে ভক্ত্যা প্রযচ্ছতি।

তদহং ভক্ত্যুপহতমশ্নামি প্রযত্মনঃ ॥ ৯/২৬ - শ্রীগীতা

পত্র, পুষ্প, ফল, জল যদি ভক্তিসহকারে ঈশ্বরকে অর্পণ করা যায় তাহলে ঈশ্বর তা গ্রহণ করেন। আত্মনিবেদন তখনই আসে যখন হৃদয়ে ভক্তির সদ্ভাবের উদয় ঘটে। পূজার আক্ষরিক অর্থ প্রশংসা বা শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। আর সাত্ত্বিক পূজা বলতে বোঝায় ঈশ্বরের প্রতীক বা তার রূপ সম্মুখে ভক্তিসহকারে পত্র, পুষ্প, ফল, জল, ধূপ, দীপ প্রভৃতিতে উপাসনা করা। মূলত পূজার উদ্দেশ্যই হচ্ছে সর্বশক্তিমান পরম ¯্রষ্টার নিকট মাথানত করা কিংবা ¯্রষ্টার নৈকট্য বা সান্নিধ্য লাভের প্রয়াস মাত্র।

পূজার অর্থ আত্মশুদ্ধি বা আত্মজাগরণ। আমাদের অন্তর্নিহিত কুপ্রবৃত্তিগুলোকে দূর করার চেষ্টা করি না বলেই আমাদের সেই আত্মজাগরণ হচ্ছে না। ফলে আমাদের অন্তরে উদয় হয় না সাত্ত্বিকতার ভাব এবং হৃদয়ে আসেও না পবিত্রতা। সাত্ত্বিকতা আর পবিত্রতা বিহীন কি কখনো আত্মশুদ্ধি হয়? আর আত্মশুদ্ধি না হলে তো সাত্ত্বিক পূজা-পার্বণের প্রশ্নই আসে না।

বর্তমান পূজার দিকে দৃষ্টিপাত করলে প্রতীয়মান হয়, তামসিকতা হচ্ছে আজকের পূজার মূল উদ্দেশ্য। আমরা আজ রাজসিক ও তামসিকতার ঘোরচক্রে আবর্তিত। সাত্ত্বিকতাকে পাশ কাটিয়ে তামসিকতায় মত্ত হচ্ছি প্রতিনিয়ত। আর যে পূজায় নেই কোনো আত্মজাগরণের প্রচেষ্টা, নেই জীবনের স্পন্দন, সেই পূজা তো সত্যিকার অর্থে পূজা হতে পারে না। এটা হচ্ছে শুধু মিছে মিছে পূজ্য দেবতার নৈকট্য লাভের অপপ্রয়াস বা প্রাণহীন অভিনয়। সতিকার পূজায় আছে আধ্যাত্মিক চেতনা, আত্মজাগরণ ও আত্মশুদ্ধির মহামন্ত্র। আমরা সেই দিকে মনোনিবেশ না করে তার উল্টো পথেই হাঁটছি। আমরা ব্যস্ত হচ্ছি বাহ্যিক চাকচিক্য নিয়েই, মত্ত হচ্ছি কামনা-বাসনা, লোভ-মোহকে ঘিরেই। এটাই আমাদের চিত্তের দৈন্য।

আজ আমরা পূজার প্রকৃত অর্থ ভুলে গেছি। পূজায় আমাদের উচিত পঞ্চভূতের প্রতীক প্রদীপ, জলপূর্ণ শঙ্খ, বস্ত্র, পুষ্প এবং চামর দিয়ে পূজ্য দেবতার চরণে নিজেকে নিবেদনের মাধ্যমে বৃহৎ সত্তার সঙ্গে মিলিত হওয়ার। আর পূজাকে কেন্দ্র করেই চলছে কলুষময় সমাজের মিছে অপপ্রলাপ মাত্র। প্রদর্শিত হচ্ছে দেহস্থিত আসুরিক শক্তির বহির্প্রকাশ। পূজার পূতঃপবিত্র আবেদনের বিপরীতে মাতালনৃত্য ও শ্রদ্ধাহীন বহিরঙ্গের প্রদর্শনী। যা একেবারেই ভন্ডামিতুল্য। ফলে ব্যাহত হচ্ছে সাত্ত্বিক পূজা-পার্বণের মনোভাব। অপরদিকে সনাতন ধর্ম ও সনাতন ধর্মাবলম্বীরা অপমানিত হচ্ছে অন্য সম্প্রদায়ের লোকের কাছে। সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে উৎসারিত ও উজ্জীবিত মহান ঐতিহ্য ও কৃষ্টি সভ্যতার ধারক ও বাহক সনাতন সম্প্রদায়কে করা হচ্ছে কুলুষিত ও কলঙ্কিত।

মূলত পূজা হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে অশুভ শক্তি দূরীকরণের সম্মিলিত প্রচেষ্টা। হিংসাদ্বেষ এবং আড়ম্বর ও সাত্ত্বিকতা বর্জিত বর্তমান পূজা আয়োজনে কতটা মঙ্গল আমাদের জীবনে সঞ্চিত হবে অথবা পাপের ভান্ডার পরিপূর্ণ হবে তার সমীক্ষা ভবিষ্যৎ আমাদের জ্ঞাত করবে। এই দুর্গোৎসব বিধি সম্মতভাবে পালিত হলে সমাজ থেকে মানুষে মানুষে হানাহানি, ব্যক্তি রেষারেষি, রাহাজানি, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, দারিদ্র্য দূরীভূত হবে এবং প্রেম প্রীতি, সাম্য ও সৌভ্রাতৃত্বের যুগলবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গড়ে উঠবে এক আদর্শ সুশীল সমাজ। প্রচার হবে সনাতনী শক্তির মাহাত্ম্য। প্রকৃত অর্থে দুর্গাপূজার মাহাত্ম্য এখানেই নিহিত।

চারদিকে ধ্বনিত হোক ঢাকের ছন্দময় সুর, কাঁস্য ঘন্টা আর মৃদঙ্গের আনন্দধ্বনি, শঙ্খনিনাদ আর উলুধ্বনির যুগলবন্দির সঙ্গে শারদীয়া আকাশ বাতাসে মিশে যাক স্তোত্র বন্দনা। মূল কথা জগৎ জীবের কল্যাণের জন্যই এই শক্তিপূজা। সুতরাং-

ওঁ যা দেবী সর্বভুতেষু শক্তিরূপেন সংস্থিতা।

নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমো নমঃ ॥

লেখক : গীতা প্রশিক্ষক ও সাংগঠনিক সম্পাদক

বাংলাদেশ গীতা শিক্ষা কমিটি, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা সংসদ

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist