অলোক আচার্য্য

  ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সমাজ

শিশুশ্রম নিরসন ও বাস্তবতা

বাংলাদেশ, ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের জীবনযাত্রা উন্নত দেশের শিশুদের মতো নয়। একই পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে ভয়াবহ বৈষম্যপূর্ণ পরিবেশে বড় হয় এসব শিশু। কোথাও শিশুর জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ আবার কোথাও শিশুর জন্য অপেক্ষা করে যুদ্ধ। এসব শিশু জানেও না তারা কোন পাপের শিকার। দারিদ্র্য এবং অভাবের কারণে এই পার্থক্য গড়ে ওঠে। এসব দেশের শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ এবং মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে। শিশুদের প্রতি রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব থাকে। এসব শিশু যাতে ভারী এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করে সে বিষয়ে আইনও থাকে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। অভাব তো আইন বা উপদেশ দিয়ে আটকানো যায় না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেটের জ্বালা মেটানোর জন্যই তারা কাজে নামে। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে শিশুরা গাড়ি ঠেলা, পাথর ভাঙা থেকে শুরু করে মাল টানা, ওয়েল্ডিং কারখানার মতো ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করে। এসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজের অনুমোদন না থাকলেও বাস্তবে কিছুই করার নেই। সচেতনতাও এক্ষেত্রে তেমন কিছু করতে পারে না, যদি অভাব দূর না হয়। আগে পেট, তারপর অন্যান্য সুযোগের প্রশ্ন আসে। জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আমাদের দেশের শিশু শ্রমিকদের এক-চতুর্থাংশ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। শিশু শ্রমিকদের দেওয়া হয় এমন সব কাজ, যা কেবল প্রাপ্ত বয়স্কদের উপযোগী। ফলে সেসব ভারী কাজে নিয়োজিত শিশু শ্রমিকরা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ শিশুশ্রম বিষয়ক একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। সাতটি বিভাগের ১৪টি জেলার সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা হতে মোট ৫০৮ শ্রমজীবী শিশুর সরাসরি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। সেখান থেকে আরো জানা যায়, একটি শিশু দৈনিক গড়ে আট ঘণ্টা শ্রমের বিনিময়ে মাত্র একশ’ টাকা উপার্জন করে। তারা মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৫শ’ টাকা এবং সর্বনি¤œ ২৬০ টাকা উপার্জন করে। বেশিরভাগ শিশুই তাদের এই রোজগারের বড় অংশ পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করে। দারিদ্র্য, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রাকৃতিক বিপর্যয়-যাই হোক না কেন শিশুরা তার সবচেয়ে খারাপ প্রভাবের শিকার হয়। সম্প্রতি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ইস্যুতে যে লাখ লাখ মানুষ শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে তার ষাট ভাগই শিশু বলে গণমাধ্যম প্রতিবেদনে জানা গেছে। আমাদের দেশে আঠারো বছরের নিচে যাদের বয়স তাদের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ধরা হয়। যেখানে অনেক মেয়েরই আঠারোর অনেক আগেই বিয়ে হয়ে যায়। তারা বাচ্চা ধারণ করে এবং রীতিমতো মা হয়ে সংসারও করে। একজন শিশু কেন কাজ করে, কেন বই খাতা ছেড়ে রিকশার হাতল ধরে বা কোনো চায়ের দোকানে কাজ করে, তার মূল কারণ এবং অন্যতম কারণ দরিদ্রতা হলেও এর সঙ্গে অপরাপর আরো কিছু কারণ জড়িয়ে আছে। জানা যায়, বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিয়ে ২০১৫ সালে প্রকাশ করা হয় জাতীয় শিশুশ্রম সমীক্ষা। সে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল বাংলাদেশে শিশুর সংখ্যা ৩ কোটি ৯৬ লাখ। এর মধ্যে ১৭ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে শ্রমে নিযুক্ত। এর মধ্যে আবার ১২ লাখ ১০ হাজার শিশু ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত রয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ কাজগুলোর ভেতর রয়েছে ওয়েল্ডিং ও মোটর ওয়ার্কশপ, বিভিন্ন প্রকার যানবাহন, প্লাস্টিক ও রাসায়নিক কারখানা, নির্মাণকাজ, ইটভাটা, পাথর ভাঙা, অটোমোবাইল স্টেশন, ব্যাটারি রিচার্জিং স্টেশন, বর্জ্য অপসারণ, চামড়ার কারখানা, দিয়াশলাই কারখানা, বিস্কুট কারখানা, হোটেল রেস্টুরেন্ট ইত্যাদি স্থানে কাজ করা। যে বয়সে একটা শিশুর বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, লেখাপড়ায় মনোযোগী থাকার কথা সেখানে সে অতি অল্প বেতনে এমনকি প্রায় বিনা বেতনে (কেবল কাজ শেখার শর্তে) ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে চলেছে।

কোনো দেশ তার দেশের শিশুদের দিয়ে কাজ করাতে চায় না। কারণ শিশুরা হলো সম্পদ। দেশকে এগিয়ে নিতে এসব শিশুই সক্ষম। কিন্তু কোন দেশ কতটা উন্নত সেটা বুঝতে হলে সে দেশের শিশুদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করাই যথেষ্ট। কারণ কোনো শিশুই উপার্জন করার মতো কাজ করতে চায় না, কিন্তু পরিস্থিতি সেটা করতে বাধ্য করে। শিশুদের স্বার্থরক্ষায় সব দেশের সরকারই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। কারণ প্রতিটি সিনিয়র জনগণ তাদের দেশের শিশুদের অবস্থা ভালো দেখতে চায়। আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। শিশুদের স্কুলমুখী করার জন্য, স্কুলে উপস্থিতির হার বাড়ানোর জন্য এবং শ্রমমূলক কাজের প্রতি শিশুর পরিবারকে নিরুৎসাহিত করতে বাংলাদেশ সরকার বহু পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ ইতিবাচক ফল রাখতে সম্ভব হয়েছে। তবে পুরো যে সফল হয়নি তা আমরা এই প্রতিবেদনেই বুঝতে পারি। শিশুদের কর্ম থেকে বিরত রাখতে অগ্রগণ্য একটি পদক্ষেপ হলো সবার জন্য প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলেও অনেক শিশুই স্কুলে যায় না আবার অনেকে প্রাথমিক শেষে বা শেষ না করেই অর্থ উপার্জনের কাজে লেগে যায়। এতে তার পরিবারেরও সমর্থন থাকে অনেক সময়। আমাদের সফল কর্মযজ্ঞের একটি হলো বছরের শুরুতেই নতুন বই বিনামূল্যে বিতরণ করা। এই বই দেওয়ার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল যাতে বছরের শুরুতেই বই কেনার টাকা জোগাড় করতে গিয়ে কোনো অভিভাবককে দুশ্চিন্তা করতে না হয় এবং শিশুও যেন হাসিমুখে বই খাতা কলম নিয়ে স্কুলে যেতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সবাই স্কুলে যায় না। যদিও অনেক সময়েই শিশুর এই অবস্থাকে অনেক কম করে দেখানো হয়। কিন্তু মূল চিত্র চোখে পড়ে বাইরে বের হলে। শ্রমজীবীদের একটি বিরাট অংশই শিশু। আপনি যে রিকশায় উঠবেন, দেখা যাবে সেটা কোনো শিশু চালাচ্ছে। যে গাড়িতে উঠবেন সেটার চালকও কোনো শিশু। এমনকি ট্রাক চালাতেও দেখা যায় শিশুকে। আমরা শিশুর জন্য যে নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ গড়তে চাচ্ছি, তা থেকে অনেক দূরে আমাদের অবস্থান।

প্রতিবেদনটিতে আরো উল্লেখ করা হয় যে, দরিদ্রতা শিশুশ্রম নিরসনে বাধা। তা ছাড়া শিশুদের স্বল্প বেতন ও সহজ শর্তে কাজে নিয়োগদান, ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের সচেতনতা ও দায়বদ্ধতার অভাব, শিশুবান্ধব কাজের অভাব ইত্যাদি বিষয় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে প্রতিবন্ধক। প্রতিবেদনে দেখা যায়, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে শিশুশ্রম নিরোধ ও নিরসনে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শ্রমজীবী শিশুদের শিক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ, বিনোদন, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে শ্রমজীবী শিশুদের ঝুঁকি হ্রাস পেয়েছে। সমাজ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম নিরসনে সর্বস্তরের জনগণকে মূল্যবোধের পরিবর্তন করতে হবে বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে।

একটি দেশের উন্নয়ন অনেকাংশে নির্ভর করে সে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কিভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, তার ওপর। আজকের শিশু আগামী দিনের কোনো সফল রাষ্ট্রনায়ক বা নেতা বা কিংবদন্তি কেউ। প্রতিটি শিশুই নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশেষ গুণ নিয়ে জন্ম নেয়। কিন্তু তা পরিপূর্ণ প্রকাশের অভাবে সেই মেধা কোনো দিন কাজেই আসে না। আমাদের দেশে অনেক ধরনের গানের, নাচের প্রতিযোগিতা হয়। সেসব প্রতিযোগিতায় এমন অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে, যারা চরম দৈন্য অবস্থা থেকে বড় হয়েছে। তারা সুযোগ পেয়ে নিজের মেধার প্রকাশ ঘটিয়েছে। প্রতিভা বিকাশের সুযোগ দিতে হয়, নতুবা তা ভেতরেই মারা যায়।

একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশ হিসেবে এমডিজি অর্জন এবং এসডিজি অর্জনের পথে আমরা। আমাদের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, জীবনযাত্রার মান বেড়েছে। এভাবে ধীরে ধীরে উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি আমরা। দরিদ্রতা কমার সঙ্গে সঙ্গে এবং জীবনযাপনের মান বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিশুশ্রম স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পাবে। কারণ প্রয়োজন ছাড়া কোনো শিশু কাজে যায় না। সেই সঙ্গে জনগণ যদি সচেতন হয়, তাহলেও বর্তমানে সামান্য ভালো থাকার আশায় নিজ সন্তানকে কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে ঠেলে দেবে না। এভাবেই এক দিন এদেশ শিশুশ্রম মুক্ত হবে। তখন আর কাজের আশায় ওয়েলডিং কারখানায় লোহা ঝালাই করার আলোতে চোখ নষ্ট হবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

Email- [email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist