হাসানুজ্জামান তুহিন
খোলা চিঠি
প্রধানমন্ত্রী সমীপে
ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানগত দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব দেশই দারিদ্র্য, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনাপ্রবণ অঞ্চল হিসেবে বিবেচিত। অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা এই দেশগুলোকে দুর্যোগ ও দুর্ঘটনায় দাতা দেশ ও উন্নত রাষ্ট্রগুলোর প্রতি নির্ভর করতে হয় প্রায়ই। সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা তৈরি হওয়ায় মানবিক সাহায্য ও দরিদ্রতা দূরীকরণে দাতা দেশগুলোর যে উদ্যোগ ছিল তাতে এখন অনেকখানি ভাটা পড়েছে মুক্তবাজার অর্থনীতির এই যুগে। দাতা দেশগুলো বিভিন্ন সময়ে সাহায্য ও বিনিয়োগে নানা শর্ত জুড়ে দেয়। যে কারণে পিছিয়ে রয়েছে ইমাজিন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো।
এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, তথা দক্ষিণ এশিয়াসহ প্রাকৃতিক ও দুর্ঘটনার ঝুঁকিতে থাকা এসব দেশের এককভাবে যেকোনো দুর্যোগপূর্ণ অবস্থা মোকাবিলা করা বেশ কঠিন। ৮০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ার এসব দেশ নিয়ে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তৈরি হয়েছিল তা রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও শাসনতান্ত্রিক জটিলতায় প্রায়মৃত। মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সার্কের স্বপ্ন। আঞ্চলিক আধিপত্যবাদের যাঁতাকলে পিষ্ট সার্ক, যা এখন শুধুই অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর উচ্চপদস্থ নেতৃবৃন্দ ও আমলাদের পিকনিকে পরিণত হয়েছে। এসব জটিলতা প্রকৃতি একেবারেই বুঝতে নারাজ। বিবর্তনের ধারা ও মানবসৃষ্ট দূষণ প্রকৃতিকে করে তুলছে হিংস্র থেকে আরো হিং¯্রতম। ম্যালথাসের তত্ত্ব অনুসারে প্রকৃতিই তার প্রতিশোধ নিতে হানা দিচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন সময়। কখনো ভূমিধস, কখনো ভূকম্পন, টর্নেডো-ঘূর্ণিঝড়, সুনামি, বন্যা, অগ্নিকান্ড, বহুতল ভবনধস ও মিল-কলকারখানাসহ রেল ও বিমান দুর্ঘটনা ঘটছে এ অঞ্চলে। জি-এইট, জি-টুয়েন্টি, ধরিত্রী সম্মেলন, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন নামে বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণতা কমানোর জন্য সম্মেলন করা হলেও আজো শিল্পোন্নত ও ধনী দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং ইতিবাচক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেনি। পরিবেশকে আরো বিরূপ করে তুলছে তাদের নানা কার্যক্রম। পৃথিবীজুড়ে প্রতিরোধহীন পুঁজিবাদ, দখলদারিত্ব ও আধিপত্য বিস্তারে এক পুঁজিবাদী দেশ আরেক পুঁজিবাদী দেশের শত্রুতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদই আজ পুঁজিবাদের শত্রু। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আফ্রিকান মহাদেশের দেশে দেশে ও মিয়ানমারে চলছে যুদ্ধ। উত্তর, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বিভিন্ন মহাসাগরে যুদ্ধাস্ত্রের মহড়া, দূরপাল্লা, মাঝারিপাল্লাসহ বিভিন্ন ধরনের মিসাইল হাইড্রোজেন ও পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা আজ পৃথিবীর প্রাকৃতিক অবস্থাকে করে তুলেছে বিপদাপন্ন। শক্তিশালী অস্ত্র ব্যবসায়ী দেশগুলো তাদের অস্ত্র প্রদর্শনের জন্য কৃত্রিম যুদ্ধ বাধিয়ে গাড়ি ও শিল্প কলকারখানার চেয়েও ভয়ানক বিপদ বয়ে আনছে প্রাকৃতিক পরিবেশে। তাই এই অবস্থায় দক্ষিণ এশিয়ার দরিদ্র দেশগুলোর নতুন করে চিন্তা করার সময় এসেছে। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে সাইবেরিয়াতে বরফে ফাটল, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্প, টাইফুন, টর্নেডো, সুনামি, দাবানল, অগ্নিকান্ড অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে বিভিন্ন দুর্ঘটনা উন্নত বা অনুন্নত যেকোনো দেশের পক্ষেই এখন আর এককভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। সেই বিবেচনায় দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোতে ভৌগোলিক অবস্থার কারণেই নানান দুর্যোগ সবসময় লেগেই আছে। তাই এই দেশগুলোর সম্মিলিতভাবে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে ক্ষেত্রে আমি প্রস্তাব করছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সুদক্ষ নেতৃত্বে দক্ষিণ এশিয়ার দারিদ্র্যপূর্ণ এই অঞ্চলের দরিদ্র মানুষদের নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা মোকাবিলায় সম্মিলিত একটি উদ্ধার ও পুনর্বাসনের জন্য দক্ষিণ এশিয়া দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিল গঠন করুন-যা এ অঞ্চলের দুর্যোগ মোকাবিলায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে। গঠিত এই তহবিলের আওতাধীন দেশগুলো থেকে উদ্ধার কর্মী নিয়ে যৌথ একটি উদ্ধারকারী বাহিনী ও ভারী যন্ত্রপাতি-যা কোনো দেশে এককভাবে ক্রয় করা কঠিন, সে ধরনের যন্ত্রপাতি তহবিল থেকে ক্রয় করতে হবে। আপৎকালীন সময় তা ব্যবহার করে দ্রুত এবং সঠিক সময়ে উদ্ধার পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়। এসব কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কর্ম পরিষদ গঠন করা দরকার তা আমাদের সার্কের বিভিন্ন কমিটি গঠন ও পরিচালনা পরিষদকে অনুসরণীয়। এই অঞ্চলে দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা যদি আমরা আঞ্চলিক সম্মিলনের মাধ্যমে মোকাবিলা করতে পারি, তাহলে আমাদের বিশ্বাস আমরা পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে নিজেদের নাম যুক্ত করতে পারব। একেকটি দুর্যোগ ও দুর্ঘটনা আমাদের পিছিয়ে দেয় বিভিন্ন সময়। এককভাবে দুর্ঘটনা মোকাবিলা করতে গিয়ে তাই আমরা অর্থনৈতিক মন্দা এবং পুঁজিবাদী দেশগুলোর আধিপত্যের জালে জড়িয়ে পড়তে হয়। চলতে হয় তাদের ইচ্ছে মতো। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রায় ৪০ শতাংশ পরামর্শক নিয়োগের মধ্য দিয়ে নিয়ে যায় তারা নিজ দেশে। তাই অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীর জন্য ও বিপদ থেকে উত্তরণের পথ আমাদেরকেই খুঁজে বের করতে হবে। এ জন্যই প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা। আর সেক্ষেত্রে সর্বক্ষণ আমাদের এ অঞ্চলে লেগে থাকা দুর্যোগ ও দুর্ঘটনাকে নিজ উদ্যোগে উত্তরণ ঘটাতে পারলে আমাদের একটি নতুন উন্নয়নের রোডম্যাপ তৈরি হবে। যার মাধ্যমে বৈশ্বিক জলবায়ুর উষ্ণতা কমাতে বিশ্ব দরবারে সঠিকভাবে চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
"