মাসুমা রুমা

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

মতামত

সততার প্রতি আগ্রহ

এক ঘণ্টার পরীক্ষায় যেমন মেধাবীদের নির্ধারণ করা অসম্ভব, ঠিক তেমনি একটি প্রতিযোগিতার মঞ্চেও প্রকৃত মেধাবীদের যাচাই করা সম্ভব নয়। প্রকৃত মেধাবীদের শনাক্ত করতে এবং প্রতিভার বিকাশের জন্য বাস্তবমুখী অসংখ্য ক্ষেত্রের প্রয়োজন। আমাদের দেশে মেধাবীদের শনাক্তকরণের চেষ্টা অনেকটা বিরলই বলা যায়। তবু মেধা বিকাশের জন্য মাঝেমধ্যে যেসব ছোট ছোট ভালো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়, তা দেখে অনেকের মনে আাশার সঞ্চার করে।

মাতৃভূমি ও মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ অনুভব করা প্রত্যেক নাগরিকের জন্য আবশ্যক। বর্তমান তরুণ সমাজের ভাবের আদান-প্রদানে যেসব শব্দ বা বাক্যের ব্যবহার লক্ষ করা যায় তাতে আশঙ্কা করা হয় যে, অদূর ভবিষ্যতে বাংলা ভাষার করুণ অবস্থার সৃষ্টি হতে পারে। অথচ এই ভাষার জন্য আমাদের আপনজনরা রক্ত ঝরিয়েছিলেন এক দিন! এদেশের তরুণরা সেই ইতিহাস কি অন্তরাত্মা দিয়ে উপলব্ধি করতে পারে? নাকি শুধু পড়ার জন্য পড়া কিংবা পরীক্ষার খাতায় ভালো নাম্বার পাওয়ার জন্য তারা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্বন্ধে জেনেছে? আমাদের মাতৃভাষা আমাদের একটি অহংকারের নাম। বাংলা ভাষাকে শুদ্ধভাবে জানা ও সর্বস্তরে তার শুদ্ধ প্রয়োগ করা আমাদের একান্ত কর্তব্য।

এক দিন টেলিভিশনের পর্দা খুলে দেখলাম, চ্যানেল আইয়ে আয়োজন করা হচ্ছে বাংলা ভাষা নিয়ে দেশের প্রথম রিয়েলেটি শো ‘বাংলাবিদ’। দরজা জানালাবিহীন একটি অন্ধকার ঘরে এক টুকরো আলোর প্রবেশ যতটা আশাব্যঞ্জক মনে হয়, বিষয়টি আমার কাছে তেমনই লেগেছে। তবে আমি মোটেও ভাবিনি যে, এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাংলা ভাষার অন্ধকার পুরোপুরি ঘুচে যাবে। বরং ভেবেছি, অন্তত কিছু কোমলমতি ছেলেমেয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে হলেও বাংলা ভাষার ইতিহাস সম্বন্ধে জানবে, ব্যাকরণ শিখবে, শব্দের ব্যবহার জানবে, শুদ্ধভাবে বাংলা বলার চেষ্টা করবে। এসব কারণেই প্রতিযোগিতাটিকে আমি শুরু থেকেই সাধুবাদ জানিয়েছি। মনোযোগ দিয়ে দেখেছি প্রতিটি পর্ব। অনেক অজানা তথ্য জেনেছি। অসংখ্য ভুল সংশোধনের সুযোগ পেয়েছি। আমার ভেতর বাংলা ভাষাকে আপাদমস্তক জানার আগ্রহ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু ‘বাংলাবিদ’ এর ১৪তম পর্বে এসে আমি হতাশ না হয়ে পারলাম না। ১১তম পর্বে সেরা ১০ নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে নিয়ম অনুযায়ী প্রতি পর্বের কম নম্বরধারী প্রতিযোগী বাদ পড়ে যাবে। নিয়ম অনুযায়ী সুশৃঙ্খলভাবেই চলছিল প্রতিযোগিতা। ১৪তম পর্বের শেষ পর্যায়ে ঘোষণা করা হলো, নুসরাত সায়েম এলিমিনেট হয়ে যাচ্ছে। প্রতি পর্বের মতো সেদিনও সবার চোখে মুখে মন খারাপের ছাপ। অতিথি বিচারক অভিনেত্রী তিশা যখন নুসরাত সায়েমকে বিদায়ী ক্রেস্ট তুলে দেবেন, ঠিক তখন তাকে বাধা প্রদান করলেন প্রধান বিচারক অভিনেত্রী সুবর্ণা মোস্তফা। সুবর্ণা মোস্তফা জানালেন, প্রতিযোগিতার নিয়ম পরিবর্তন করা হয়েছে। কাজেই সে পর্বে নুসরাত সায়েমকে এলিমিনেট করা হলো না। তাকে আবারও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হলো। যা ছিল প্রতিযোগিতার নিয়মবিরোধী কাজ। অনেকেই হয়তো বলবেন, প্রতিযোগিতার প্রয়োজনে নিয়ম পরিবর্তন করা যেতেই পারে। এ বিষয়ে আমিও একমত। কিন্তু কোনো প্রতিযোগিতায় যদি নির্ধারিত নিয়মে পরিবর্তন আনা হয় তা হতে হয় সব বিচারকের সম্মিলিত মতামতের ভিত্তিতে এবং প্রতিযোগিতার শুরুতেই সেটা প্রতিযোগীদের জানিয়ে দেওয়া হয়। বরাবর এমনটাই হয়ে আসছে।

১৪তম পর্বটি যদি কেউ মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করেন, তবে দেখতে পাবেন-সুবর্ণা মোস্তফাকে সে পর্বে অনেক আবেগপ্রবণ লেগেছে। একটা অস্থিরতা কাজ করেছে তার ভেতর। তিনি হয়তো চাইছিলেন নুসরাত সায়েম যেন প্রতিযোগিতা থেকে চলে না যায়। কিন্তু নিয়মের মধ্যে থেকে যেহেতু এটা সম্ভব ছিল না, সে কারণেই তিনি বোধহয় ক্ষমতার অপব্যবহার করলেন। বাকি দুই বিচারক ড. সৌমিত্র শেখর ও আনিসুল হকের শরীরী ভঙ্গি আর চমকে ওঠা দেখে বিষয়টি সহজেই অনুমেয় যে, সুবর্ণা মোস্তফার এই নিয়ম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত পূর্ব নির্ধারিত নয়, তাৎক্ষণিকভাবে নেওয়া। হয়তো কর্তৃপক্ষেরও এ বিষয়ে কিছু করার ছিল না। কেননা বিষয়টির সঙ্গে বিচারকের সম্মান জড়িয়ে আছে। মঞ্চে উপস্থিত বাকি প্রতিযোগীরাও হতবাক হয়েছেন এমন তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে। অনুষ্ঠানের উপস্থাপকও বিস্মিত হয়ে বলেছেন, নির্বাহী ক্ষমতা বলেই সুবর্ণা মোস্তফা নুসরাত সায়েমকে বাঁচিয়ে দিলেন। এই ঘটনাটি পুরো প্রতিযোগিতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করল নিঃসন্দেহে। দেশজুড়ে শুরু হলো আলোচনা-সমালোচনার ঝড়। প্রতিযোগীদের মনেও হয়তো অপ্রকাশিত ক্ষোভের জন্ম হলো।

১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হলো ‘বাংলাবিদ’-এর মহোৎসব পর্ব। সবার ভেতরই কৌতূহল কাজ করছিল কে হতে যাচ্ছে দেশের প্রথম সেরা বাংলাবিদ। অগণিত দর্শক ও সম্মানিত অতিথিদের সামনে যখন সেই এলিমিনেট হওয়া নুসরাত সায়েমকেই সেরা বাংলাবিদ বলে ঘোষণা করা হলো, তখন দেশজুড়ে সমালোচনার মাত্রা আরো বহুগুণ

বেড়ে গেল। প্রতিযোগিতার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাই হয়তো স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেছেন, সফলভাবেই তারা শেষ করেছেন ‘বাংলাবিদ’-এর প্রথম আয়োজন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আসলেই কি সফলভাবে শেষ হলো প্রতিযোগিতাটি? প্রতিযোগীরা কি মঞ্চ থেকে কেবল দুহাত ভরে পুরস্কারই নিয়ে গেল? নাকি সেই সঙ্গে তারা এটাও শিখে গেল যে, কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে হয়, কীভাবে একজন তার প্রাপ্ত মর্যাদা থেকে বঞ্চিত হয়, কীভাবে সততা নামক বস্তুটি দিন দিন সস্তা হয়ে ওঠে, কীভাবে অন্যায় দেখেও সবাই চুপচাপ থাকে, কীভাবে হাসি মুখে অন্যায়কে মেনে নিতে হয়, কীভাবে প্রতিযোগিতার পবিত্র মঞ্চ কলুষিত হয়, কীভাবে ব্যক্তি ও শ্রমের প্রতি ক্ষোভ বৃদ্ধি পায়, কমে যায় শ্রদ্ধাবোধ!

লেখক : কবি ও কথাসাহিত্যিক

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist