ইয়াসমীন রীমা

  ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

নিবন্ধ

শিশুদের স্বাস্থ্য এবং সচেতনতা

সকাল থেকে নিজের ঘরে খাটের ওপর উপুড় হয়ে শুয়ে আছে আলিফ। সকালে ঘুম ভাঙার পরও পড়ার টেবিল বা নাস্তার টেবিল কোনোটায় আজ বসা হয়নি তার। মা ফাহিমা বেগম অনেকবার ডেকে গেছেন তাকে। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলছে না। আলিফের কী হয়েছে-ব্যাপারটা যদিও ফাহিমা বেগমের জানা আছে, তবুও তার করার কিছুই নেই। তবে বিষয়টি মোটেই স্পর্শকাতর নয়। শুধু বোঝার ও সমঝোতার ব্যাপার। কিন্তু অবুঝ শিশুদের কি অত বুদ্ধি-জ্ঞান হয়েছে যে, তারা ক্ষণিকের মধ্যে বুঝে যাবে। যদিও আলিফের বন্ধুদের তার মা বলেছে, কিন্তু সবাই না শুনলেও কেউ কেউ হয়তো শুনেছে। আলিফের বাবা বেঁচে নেই। একমাত্র ছেলে সে। মা ফাহিমা বেগম সরকারি প্রাইমারি স্কুলের হেড মিসট্রেস। তাদের আবাসস্থল কুমিল্লা শহরের শাসনগাছা উকিলপাড়ায়। পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে আলিফের বেশ সখ্য থাকলেও একটা ব্যাপারে সে তাদের ওপর ভীষণরকম ক্ষুব্ধ। শারীরিকভাবে সে স্থুল বলে বন্ধুরা সবাই তাকে ক্ষেপায়। কখনো মোটকু, কখনো ড্রামবেল আবার কখনো গুলগোল্লা বলে। এতেই আলিফ রাগ করে খেলা ছেড়ে চলে আসে প্রায়। আবার কখনো কখনো একসঙ্গে স্কুলে পর্যন্ত যায় না। পাড়ার বন্ধুরা ছাড়াও স্কুলেও তাকে সবাই মোটা বলে ক্ষেপায়। গতকাল বিকেলে পাড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে কোনো এক বন্ধু তাকে মোটকু বলাতে সে ক্ষেপে গিয়ে বিবাদে জড়িয়ে পড়ে। সেই থেকে বাসায় এসে অভিমান করে আছে। আলিফের কষ্টটা ফাহিমা বেগম শেয়ার করেছে ঠিক এবং ডাক্তারও দেখিয়েছে। ডাক্তার বলে দিয়েছেন স্থুলতা একটা সাধারণ রোগ এর ব্যাপক চিকিৎসার কোনো প্রয়োজন নেই। খাওয়া-দাওয়ায় একটু সাবধানতা অবলম্বন করলেই হবে।

কেবল আলিফ কেন বর্তমানে পরিলক্ষিত হচ্ছে, বিশেষ করে শহরের শিশুরা মুটিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। তারা স্বাভাবিক ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে তাদের প্রাত্যহিক চলাফেরা করতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তাদের শরীরে বিপজ্জনক রোগের প্রকোপ। ২০১৫ সালে স্বাস্থ্য ও জনমিতি জরিপে এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে বেঁটে হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা ৪১ শতাংশ থেকে কমে ৩৬ শতাংশে নেমে এসেছে। রুগ্ন শিশুর সংখ্যাও ১৬ থেকে ১৩ শতাংশে হ্রাস পেয়েছে। তবে জাতীয় পুষ্টিসেবা কর্মসূচি আইপিএইএন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক গবেষণায় বলা হয়, মহানগরগুলোতে এখন প্রতি ১০০ শিশুর ১৪টির ওজন বেশি। তাছাড়া ‘ওবেসিটি প্রিভালেন্স অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্টস ইন আরবান এরিয়াস ইন বাংলাদেশ’ বাংলাদেশের সাতটি সিটি করপোরেশনের ৫ থেকে ১৮ বছর বয়সী ৪ হাজার ১০০ শিশুর ওপর জরিপে চালিয়ে প্রাথমিক ফল দেখিয়েছে শতকরা ৪ জন স্থূল।

গত বছরের মে ও জুন মাসে ইন্টারন্যাশনাল ওবেসিটি টাস্কফোর্সের দিকনির্দেশনা অনুসরণ করা কানেক্টিকাট সেন্টার ফর চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট (সিসিসিডি) এক গবেষণায় শিশুদের বয়স এবং ছেলে ও মেয়েভেদে শিশুর স্বাভাবিক ওজন, কম ওজন, অতিরিক্তি ওজন এবং স্থূলতার মাপকাঠি করা হয়। এক গবেষণায় শিশুদের বডি ম্যাস ইনডেক্স নির্ণয় করে দেখা গেছে, শিশুদের মধ্যে ৫৬ শতাংশের ওজন বয়স ও লিঙ্গভেদে স্বাভাবিক, ৩০ শতাংশের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে কম এবং ১৪ শতাংশের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি অর্থাৎ অতিরিক্ত ওজনবিশিষ্ট যার মধ্যে ৪ শতাংশ অনেক স্থূলকায়। ন্যাশনাল নিউট্রেশন সার্ভিসের (এনএনএস) জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ড. জাকির হোসেন বলেন, ‘শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি সুরক্ষায় অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। তথ্য-উপাত্তে দেখা যায়, অপেক্ষাকৃত সচ্ছল পরিবারের নারীদের মধ্যে নিয়মিত হাঁটাচলা এবং শারীরিক পরিশ্রমের মাত্রা দিন দিন কমছে। বাড়ছে ক্ষতিকর খাদ্যাভাস। এ নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপরও। ফলে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল বা ধনিক শ্রেণির এমনকি অনেক নি¤œ আয়ের পরিবারের সন্তানদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার হার বাড়ছে।’ কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইকবাল আনোয়ার বলেন, ‘অগ্ন্যাশয় থেকে বেটা সেল নামের হরমোন বেরিয়ে গ্লুকোজকে ভাঙে। যখন অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার খাওয়া হয় তখন বেটা সেলগুলো গ্লুকোজের ভাঙার ক্ষমতা হারায়। ফলে রক্তে শর্করা বেড়ে যায়। মুটিয়ে যাওয়া ছাড়াও এ থেকে শিশুদের ডায়াবেটিস হয়। তাছাড়া শিশুরা কালো হয়ে যাওয়া বা মেয়েশিশুদের দাড়ি-গোঁফ থাকা কিংবা নিয়মিত মাসিক না হওয়া উপসর্গ ইত্যাদি সমস্যা একমাত্র মুটিয়ে যাওয়া কারণে। অনেক অভিভাবক বুঝতে পারেন না। অনেক শিশু ঘুমের মধ্যে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়াকে ‘বোবা ধরা’ বলে আখ্যায়িত করে। অথচ এর পেছনে একমাত্র কারণ স্থূলতা।’

বিজ্ঞানী ও গবেষকরা শিশুদের মুটিয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে ক্যালরিসমৃদ্ধ খাবার বেশি খাওয়া এবং দৈনিক কমপক্ষে এক ঘণ্টা ঘাম ঝরিয়ে খেলাধুলা না করাকে দায়ী করেছেন। তারা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশন দেখা, কম্পিউটার ও মুঠোফোনে ভিডিও গেমস খেলার নেশা শিশুদের জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য-চার দেয়ালের বন্দিশালায় শিশুরাও হয়তো একেকটি পাখি, তাদেরও ইচ্ছে করে দেয়াল ভেঙে আকাশে ওড়ার। এক টুকরো আকাশ ছোঁয়ার। সুপ্ত এ-সাধ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বর্তমানের শিশুরা। বঞ্চিত হচ্ছে সুস্থ বিনোদন থেকেও। তাছাড়া বাংলাদেশে শতকরা ৮ ভাগ শিশু একাকিত্ব নিয়ে বেড়ে উঠেছে। শিশুদের মধ্যে ৭৪ ভাগ সময় মতো খাবার খায় না আর খেলেও অতিরিক্ত খেয়ে ফেলে। পড়ার টেবিল, বইপত্র গুছিয়ে রাখে না ২২ ভাগ শিশু। ৫৯ ভাগ শিশু শরীরচর্চা বা ব্যায়াম করে না। ১৮ ভাগ শিশু মা-বাবার কাজে সহযোগিতা করে না। তাছাড়া শহর এলাকার স্কুলগামী শিশুদের মধ্যে দু’ধরনের সমস্যা বিরাজমান-অপুষ্টি এবং অতিপুষ্টি। সেই সঙ্গে শিশুদের অতিরিক্ত ওজন ও স্থূলতার ব্যাপকতার বৃদ্ধিও পরিলক্ষিত হয়েছে। এ ব্যাপারে ‘শিশু ও পুষ্টি’ কার্যক্রমের চেয়ারম্যান আবু নাসের বলেন, ‘পরিবেশ বিপর্যয় ও অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচারের কারণে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে রোগব্যাধি। যার বড় শিকার হচ্ছে জাতির ভবিষ্যৎ কোমলমতি শিশু-কিশোররা। পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গে অনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করছে। আমাদের দেশে ৭-১৫ বছরের শিশু-কিশোরদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ ভাগ। এসব শিশু-কিশোরই পরবর্তীতে দেশ পরিচালনাসহ জাতীয় অর্থনীতির মেরুদন্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে। তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশে সামাজিক ও পারিবারিকভাবে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ অত্যন্ত জরুরি।’

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশ যখন ক্রমশ অর্থনৈতিক উন্নতির পথে যাত্রা করে তখন দেশটিতে বেঁটে হয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা কমে আর মুটিয়ে যাওয়া শিশুর সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ একই সঙ্গে দুই ধরনের সমস্যার মুখে পড়েছে। একদিকে আছে অপুষ্টিতে ভোগা শিশু, অন্যদিকে মুটিয়ে যাওয়া শিশু। বাংলাদেশে স্থূলতার সমস্যা প্রকট হওয়ার আগেই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। সচেতন হতে অভিভাবক ও সংশ্লিষ্টদের শিশুর বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সঠিক বৃদ্ধি ও বিকাশে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist