আহমদ আবদুল্লাহ

  ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সংস্কৃতি

সালাম : প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে প্রতীক

পৃথিবীর প্রতিটি সভ্য জাতির মধ্যে পরস্পর সাক্ষাতের সময় সদিচ্ছা বা সম্প্রীতি প্রকাশার্থে নিজ নিজ রুচি ও সংস্কৃতি অনুসারে স্বাগত-সম্ভাষণের রীতি প্রচলিত রয়েছে। আর তাদের সম্ভাষণের প্রকাশভঙ্গি এবং বাক্যালাপ ভিন্ন ভিন্ন। গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে সবার আলাদা সংস্কৃতিও রয়েছে। ইসলামের পূর্ব যুগে আরবদের মাঝে পরস্পর দেখা হলে ‘হাইয়্যাকাল্লাহ’ বলে সালাম করার রীতি প্রচলন ছিল, যার অর্থ ‘আল্লাহ তোমাকে জীবিত রাখুন’। ইসলামের আবির্ভাবের পর ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলার রীতি প্রচলন করা হয়। এটি কেবল একটি স্বাগত-সম্ভাষণই নয়, বরং একটা দোয়াও বটে। যার অর্থ তোমার ওপর শান্তি বর্ষিত হোক। আল্লাহ তায়ালা সর্বপ্রথম মানুষকে সালাম শিক্ষা দিয়েছেন। তিরমিজি শরীফে বর্ণিত- আমাদের প্রিয় নবী (সা.) বলেন, আল্লাহ তায়ালা প্রথমে হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করে বললেন, ‘যাও অবস্থানরত ফেরেশতার ওই দলকে সালাম কর। তারা তোমার সালামের কী উত্তর দেয় তা শ্রবণ কর। তখন তিনি বললেন, ‘আসসালামু আলাইকুম’ তার উত্তরে ফেরেশতারা বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ’। সেই থেকে মুসলমানের মাঝে সালামের রীতি প্রচলন শুরু হয়।

সালামের তাৎপর্য : ইসলামে সালামের বাক্যটি সর্বজন, ছোট-বড়, ধনী-দরিদ্র, পরিচিত-অপরিচিত সবার জন্য তা সব সময় সমানভাবে প্রযোজ্য। এটি গভীর অর্থবোধক এবং এর ব্যাপকতাও বিশাল, যা অন্য কোনো জাতির প্রচলিত সম্ভাষণে নেই। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে এক মুসলমান অপর মুসলমানের জন্য কেবল সম্প্রীতি ও সদিচ্ছা প্রকাশ করে না, আন্তরিকভাবে তা কামনাও করে। অর্থাৎ তার জন্য এ রূপ দোয়া করে, ‘আল্লাহ তোমাকে সব কষ্ট ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদ রাখুন।’ এটা প্রাচীন আরবদের রীতি অনুযায়ী কেবল জীবিত থাকার দোয়া নয়, বরং পবিত্র জীবনযাপনের জন্য, সব কষ্ট ও বিপদাপদ থেকে নিরাপদ থাকার দোয়া। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে এক মুসলমান অপর মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে এ চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যে, তুমি আমার হাত ও মুখ হতে নিরাপদ, তোমার জান-মাল-ইজ্জতের আমি একজন সংরক্ষক। এতেই নিহিত রয়েছে সালামের তাৎপর্য। কেননা রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যার হাত ও জিহ্বা থেকে অন্য মুসলমান ভাই নিরাপদ থাকবে, সে-ই প্রকৃত মুসলমান। একজন অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সহজে পরিচিত হওয়া, খোলা মনে ভাবের আদান-প্রদান করা ও আপন করে নেওয়ার জন্য সাক্ষাৎ হলে সালামই যথেষ্ট। এটি এমন একটি সম্ভাষণ যা হৃদয় ছুঁয়ে যায়, পরস্পরকে দ্রুত কাছে টেনে নেয়। আর পরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে সালাম বিনিময়ের ফলে হৃদ্যতা আরও বৃদ্ধি পায়। সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে শত্রুতা দূর হয়, বন্ধুত্ব সৃষ্টি হয় এবং সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পরিবেশ গড়ে ওঠে। সালাম হলো ইসলামের একটি প্রতীক, একটি নিদর্শন। ব্যাপকভাবে সালাম বিনিময়ের ফলে একটি ইসলামী সামাজিক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেখানে পরস্পরের মাঝে সৌহার্দ্য-সম্প্রীতি, সাহায্য-সহযোগিতার মনোভাব গড়ে ওঠে। কেননা সালাম বিনিময়ের মধ্যে নিহিত আছে পরস্পরের জন্য নিরাপদে ও শান্তিতে জীবন-যাপনের কামনা। কাজেই কোনো মুসলমান সালাম দিলে অপর মুসলমানের আবশ্যকীয় কর্তব্য (ওয়াজিব) হলো, তার চেয়ে উত্তম ভাষায় কিংবা কমপক্ষে অনুরূপ বাক্য দ্বারা সালামের জবাব দেওয়া। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমাদের কেউ যদি দোয়া করে, তাহলে তোমরাও তার জন্য দোয়া কর, তার চেয়ে উত্তম দোয়া অথবা তারই মতো ফিরিয়ে বল। (সূরা নিসা : ৮৬)। এ আয়াতের নির্দেশ রাসুল (সা.) তার কাজের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করে উম্মতদের শিক্ষা দিয়ে গেছেন। একবার এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে সালাম দিলেন এ বলে, ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ’ তিনি জবাবে একটি শব্দ বাড়িয়ে বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুললাহ।’ এর পর অন্য এক ব্যক্তি সালাম দিলেন এ বলে, ‘আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।’ তিনি জবাবে আরও একটি শব্দ যোগ করে বললেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়ারাহমাতুল্লাহ ওয়াবারাকাতুহু।’ অতঃপর এক ব্যক্তি উপরোক্ত তিনটি শব্দ সহযোগে সালাম করলেন। ‘আসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু।’ তিনি উত্তরে একটি শব্দই ওয়ালাইকা বললেন। লোকটির মনে প্রশ্ন দেখা দিল। তিনি আরজ করলেন, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার ওপর আমার মাতা-পিতা উৎসর্গ হোক। প্রথমে যারা এসেছিলেন, তাদের উত্তরে আপনি কয়েকটি দোয়ার শব্দ বলেছিলেন। আমি শব্দগুলোর সহযোগে সালাম করলে আপনি ওয়ালাইকা বললেন কেন?’ প্রিয়নবী (সা.) বললেন, ‘তুমি আমার জন্য জবাবে বাড়ানোর কোনো শব্দ রাখনি। তুমি সবগুলো শব্দ সালামে ব্যবহার করে ফেলেছ। তাই আমি কুরআনের শিক্ষা অনুযায়ী অনুরূপ শব্দ দ্বারা জবাব দিয়েছি। এ থেকে জানা গেল যে, আয়াতে সালামের জবাব আরও উত্তম ভাষায় দেওয়ার নির্দেশ রয়েছে, তা পালন করতে সালামকারী ব্যক্তি যে শব্দ দিয়ে সালাম করবে তা থেকে শব্দ বাড়িয়ে জবাব দেওয়া উচিত। তবে তিনটি শব্দ পর্যন্ত বাড়ানোই সুন্নত।

সালামের গুরুত্ব : রাসুল (সা.) মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে সালাম বিনিময় করার প্রতি খুব বেশি গুরুত্ব আরোপ করেছেন এবং এটাকে সর্বোত্তম কাজ বলে আখ্যায়িত করেছেন। হাদিস শরীফে সালাম আদান-প্রদানের ফজিলত, বরকত ও গুরুত্ব সম্পর্কে বিভিন্নভাবে উল্লেখ আছে। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, ‘সালাম আল্লাহ তায়ালার অন্যতম নাম, যা তিনি পৃথিবীতে অবতীর্ণ করেছেন। কাজেই তোমরা পরস্পরে ব্যাপকভাবে সালাম করো। কেননা মুসলমান যখন কোনো মজলিসে উপস্থিত হয়ে সালাম করে, তখন সে আল্লাহর কাছে একটি উচ্চ মর্যাদা লাভ করে। কারণ সে সবাইকে সালাম অর্থাৎ আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। মজলিসের লোকেরা যদি সালামের উত্তর না দেয় তাহলে তাদের থেকে উত্তম ব্যক্তিরা সালামের জবাব দেবে অর্থাৎ ফেরেশতারা।’ (তিবরানী শুরফ) হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেন, ‘তোমরা মুমিন না হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না এবং পরস্পর একে অন্যকে মুহাব্বাত না করে তোমরা প্রকৃত মুমিন হতে পারবে না। আমি তোমাদের একটি কাজের কথা বলে দিচ্ছি, তোমরা যদি এটি বাস্তবায়ন কর, তবে তোমাদের মাঝে মুহাব্বত সৃষ্টি হবে, তা এই যে, পরস্পরের মধ্যে সালামের রীতিকে ব্যাপকতর কর অর্থাৎ প্রত্যেক পরিচিত ও অপরিচিত মুসলমানকে সালাম কর। (মুসলিম শরিফ)। অপর এক হাদিসে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, ‘এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)কে জিজ্ঞাসা করলেন, ইসলামে কোন কাজটি সর্বোত্তম? তিনি বললেন, ‘তুমি মানুষকে আহার করাও এবং পরিচিত হোক কিংবা অপরিচিত সবাইকে সালাম কর।’ (বোখারি শরিফ)। প্রিয়নবী (সা.) এর সালাম বিনিময়ে সাহাবা কেরামের মধ্যে যে কী রূপ অভূতপূর্ব সাড়া ও উৎসাহ জাগিয়ে তুলেছিলেন একটি বর্ণনা থেকে তা প্রতীয়মান হয়। বর্ণিত আছে কেনোপ্রকার বেচাকেনার উদ্দেশ্যে নয়, বরং সালাম করে ইবাদতের সওয়াব হাসিল করার জন্যই হজরত উমর (রা.) অধিকাংশ সময় বাজারে যেতেন এবং সমবেত সবাইকে একে একে সালাম দিতেন।

সালামের নিয়ম : ইসলামী শরিয়ত অনুসারে এক মুসলমানের ওপর অপর মুসলমান ভাইয়ের হক হলো, সাক্ষাৎ হলে তাকে সালাম করা। ধনী-দরিদ্র, ছোট-বড়, পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে এক মুসলমান অপর মুসলমানকে সালাম দেওয়া যায়। এ সম্পর্কে বহু হাদিস উল্লেখ আছে। হজরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আরোহী ব্যক্তি পদব্রজে চলাচলকারী ব্যক্তিকে, পদব্রজ ব্যক্তি চলাচলকারী উপবিষ্ট ব্যক্তিকে এবং কম সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম করবে।’ (বোখারি শরিফ)। অন্য এক হাদিসে রয়েছে, মহানবী (সা.) বলেন, কম বয়সী বয়োজ্যেষ্ঠকে, পথ অতিক্রমকারী উপবিষ্টকে এবং কম সংখ্যক অধিক সংখ্যককে সালাম করবে। (বোখারি শরিফ)। একদা রাসুল (সা.) কতিপয় বালকের কাছ দিয়ে গমনকালে তাদের সালাম করলেন। এর দ্বারা বালকরা যাতে সালাম করতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এবং বায়োজ্যেষ্ঠ কম বয়সীকে সালাম দেওয়া জায়েজ তা শিক্ষা দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল এখানে। একদল লোকের মধ্য থেকে কোনো একজন সালাম করলে তা গোটা দলের পক্ষ থেকে যথেষ্ট, তেমনি উপবিষ্ট মজলিসের পক্ষ থেকে এক ব্যক্তির জবাবই গোটা মজলিসের পক্ষ থেকে যথেষ্ট বিবেচিত হবে। নিজের গৃহে হোক কিংবা অপরের গৃহ, তাতে প্রবেশ ও বাহির হওয়াকালে গৃহবাসীকে সালাম করবে। রাসুল (সা.) বলেন যখন তুমি প্রিয়জনের কাছে প্রবেশ কর, তখন তুমি সালম করবে। এতে তোমার ও তোমার গৃহবাসীদের জন্য কল্যাণ হবে। (তিরমিজি ইরিফ)। যেকোনো মুসলমান ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে যেমনি সালাম দেওয়া সুন্নত, তেমনি তার কাছ থেকে বিদায়কালে সালাম দেওয়াও সুন্নত ও সওয়াবের কাজ। সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। তবে নামাজরত ব্যক্তিকে সালাম দেওয়া নিষিদ্ধ। যদি কেউ তাকে সালাম দেয়, সে ক্ষেত্রে জবাব দেওয়া যাবে না, কেননা জবাব দিলে নামাজ নষ্ট হয়ে যাবে। তেমনি যে ব্যক্তি পানাহারে লিপ্ত, কুরআন পাঠ বা পাঠদানে ব্যস্ত, ওয়াজ-নসিহত বা জিকির-আজকারে মশগুল, তাকে সালাম দেওয়া জায়েজ নয়। যদি কেউ সালাম দেয়, তাহলে তার সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব নয়।

বন্ধুরা! আসুন, আমরা সালামের প্রচার প্রসার করে নিজেদের ভেতর গড়ে তুলি ভ্রাতৃত্বের বন্ধন, সৃষ্টি করি প্রকৃত মুহাব্বত। আর এই প্রীতি ও সৌহার্দ্যরে মাধ্যমেই মুছে যাবে হিংসা-বিদ্বেষ এবং ঝগড়া-বিবাদ। মহান রাব্বুল আলামিন আমাদের বেশি বেশি সালাম বিনিময় করার তাওফিক দান করুন। আমীন!

লেখক : ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist