অধ্যাপক ড. এম এ মাননান
শিক্ষা দিবস
ফিরে দেখা ছাত্র আন্দোলন
১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৬২। ঢাকার রাজপথ শহিদের রক্তে রঞ্জিত হয়েছিল এই দিনে। সাড়ে পাঁচ দশক আগের দিনটির আত্মত্যাগের কথা অনেকেই বিস্মৃত হতে পারেন। কিন্তু আমরা এখনো দিনটিকে স্মরণ করি শ্রদ্ধাভরে। সেপ্টেম্বর মাসটি গণমুখী শিক্ষানীতির দাবির আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত হয়ে আছে। পাকিস্তানের সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খান ওই আন্দোলনকে দমন-পীড়নের মাধ্যমে স্তব্ধ করতে উদ্যত হয়। চলে পুলিশের গুলি, টিয়ারগ্যাস ও লাঠিচার্জ। ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয় শহিদ বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহর রক্তে। এর পর ছাত্রসমাজ ১৭ সেপ্টেম্বরকে ‘শিক্ষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আসে ’৬৪-এর ছাত্র আন্দোলন, ’৬৬-এর ৬ দফা/১১ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ।
স্বাধীন স্বদেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার গণমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে। ড. কুদরত-এ-খুদার শিক্ষানীতি নামে তা ব্যাপক গণসমর্থন লাভ করে। দ্রুতই শুরু হয় শিক্ষানীতি অনুযায়ী নবজাত বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা সাজিয়ে তোলার কর্মযজ্ঞ। স্বাধীনতার সাড়ে চার দশক পর আমরা ’৬২-এর আন্দোলনের ফল পাচ্ছি। কিন্তু এর পেছনের ইতিহাস বিভীষিকাময়, নানা চড়াই-উতরাই আর কণ্টকময়।
স্বৈরশাসক আইয়ুব খান সবেমাত্র পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল করেছেন। ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ক্ষমতা দখলের মাত্র ২ মাস পর, তিনি একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেনÑযা ‘শরীফ কমিশন’ নামে সমধিক পরিচিত। এই কমিশন ১৯৫৯ সালের আগস্ট মাসের মধ্যে একটি শিক্ষা রিপোর্ট প্রণয়ন করে। সাতাশ অধ্যায়ে বিভক্ত এই রিপোর্টে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চতর স্তর পর্যন্ত সাধারণ, পেশামূলক শিক্ষা, শিক্ষক প্রসঙ্গ, শিক্ষার মাধ্যম, পাঠ্যপুস্তক, হরফ সমস্যা, প্রশাসন, অর্থ বরাদ্দ, শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বিষয়ক বিস্তারিত সুপারিশ উপস্থাপন করা হয়। এতে আইয়ুব শাহীর ধর্মান্ধ, পুঁজিবাদী, রক্ষণশীল, সা¤্রাজ্যবাদী শিক্ষাসংকোচন নীতির পূর্ণ প্রতিফলন ঘটেছিল। আইয়ুব সরকার এই রিপোর্টের সুপারিশ গ্রহণ করে এবং তা ১৯৬২ সাল থেকে বাস্তবায়ন শুরু করে।
শিক্ষা সঙ্কোচন নীতিই ছিল এ কমিশনের রিপোর্টের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়। শরীফ কমিশনের এ রিপোর্টে শিক্ষাকে তিন স্তরে ভাগ করা হয়-প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর। ৫ বছরের প্রাথমিক ও ৩ বছরের উচ্চতর ডিগ্রি কোর্স এবং ২ বছরের স্নাতকোত্তর কোর্সের ব্যবস্থা থাকবে বলে প্রস্তাব করা হয়। পাস নম্বর শতকরা ৫০, দ্বিতীয় বিভাগ শতকরা ৬০ এবং প্রথম বিভাগের জন্য শতকরা ৭০ নম্বর নির্ধারণের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষা ধনিকশ্রেণির জন্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
শরীফ কমিশন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বায়ত্তশাসনের পরিবর্তে পূর্ণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, বিশ্ববিদ্যালয়-কলেজে রাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ছাত্র-শিক্ষকদের কার্যকলাপের ওপর তীক্ষè নজর রাখার প্রস্তাব করে। শিক্ষকদের কঠোর পরিশ্রম করানোর জন্য ১৫ ঘণ্টা কাজের বিধান রাখা হয়। শিক্ষকরা যাতে ছাত্রদের সঙ্গে স্বদেশ, স্বজাতি নিয়ে আলোচনা ও তর্কের সুযোগ না পায় সে অপচেষ্টাও করা হয়। শুধু ক্লাসের মাঝে এক ধ্যানে মনোনিবিষ্ট রেখে শাসকরা রোবটিক শিক্ষক তৈরির চক্রান্ত করেছিল। রিপোর্টের শেষাংশে বর্ণমালা সংস্কার করা, বাংলা ও উর্দুর স্থলে রোমান বর্ণমালা প্রয়োগ এবং প্রতিষ্ঠার জন্য কমিটি গঠনের প্রস্তাব করে এই কমিশন। আইয়ুব খান সরকারের শরীফ কমিশন রিপোর্টে শিক্ষাকে পণ্য হিসেবে বর্ণনা করা হয় : ‘শিক্ষা সম্পর্কে জনসাধারণের চিরাচরিত ধারণা অবশ্যই বদলাইতে হইবে। সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় বলিয়া তাহাদের যে ভুল ধারণা রহিয়াছে, তাহা শীঘ্রই ত্যাগ করিতে হইবে। যেমন দাম তেমন জিনিস, এই অর্থনৈতিক সত্যকে অন্যান্য ব্যাপারে যেমন শিক্ষার ব্যাপারেও তেমনি এড়ানো দুষ্কর।’ পুঁজিবাদ ও সা¤্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষাই শিক্ষার লক্ষ্য, তা রিপোর্টের এ অংশে স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল।
তৎকালীন শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯৫৯ সালে ছাত্র ইউনিয়ন বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিয়ে একুশে উদযাপনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ১৯৬০ ও ১৯৬১ সালে এ ধরনের উদ্যোগ অব্যাহত থাকে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মবার্ষিকী পালন করার মাধ্যমে ছাত্রসমাজ সরকারের সাম্প্রদায়িক ও বাঙালিবিরোধী মনোভাবকে অগ্রাহ্য করে। আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টি সম্মিলিতভাবে একটি বৈঠকে বসে ১৯৬১ সালে। আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণই ছিল মূল লক্ষ্য। এ বৈঠকের পর আন্দোলন বিষয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে সামরিক শাসনের পরিবর্তে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বিভিন্ন অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আইয়ুব শিক্ষানীতি বাতিল চায় তারা। আরো সিদ্ধান্ত হয় যে, ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হবে স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রবীণ নেতারা অন্যায়ভাবে হেনস্তা ও গ্রেফতার হলে ৩১ জানুয়ারি ৪টি ছাত্র সংগঠন মধুর ক্যান্টিনে যৌথভাবে আলোচনায় বসে। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ছাড়া বাকি দুটি সংগঠন (ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারশন (এনএসএফ) ও ছাত্র শক্তি) ছিল সরকারের সমর্থক। এদের মূল উদ্দেশ্য ছিল সরকারবিরোধী আন্দোলনকে ভুল পথে পরিচালিত করা। অবশ্য ছাত্রলীগ এ বিষয়ে সতর্ক থাকায় সরকারের লেজুড়বৃত্তি করা ছাত্র সংগঠনগুলোর অপতৎপরতা বাধাগ্রস্ত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয় ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি। ২ ফেব্রুয়ারি রাজপথে মিছিল সামরিক আইন ভঙ্গ করে। ৪-৫ ফেব্রুয়ারিও বিক্ষোভ অব্যাহত থাকে। ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার ছাত্র প্রতিবাদ সমবেশে উপস্থিত হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নের সুসজ্জিত একটি মিছিল নাজিমুদ্দিন রোড দিয়ে পুরান ঢাকায় প্রবেশ করে। এই মিছিলকে প্রতিহত করার জন্য সরকার পুলিশের সঙ্গে সেনাবাহিনী নিয়োগ করে এবং কার্জন হলের মোড়ে ফিল্ড কামান বসানো হয়। আন্দোলনকারীরা ওই দিন আইয়ুব খানের ছবি পুড়িয়ে তাদের তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে।
৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পর ছাত্ররা হল ত্যাগ করছে না দেখে পুলিশ ও সেনাবাহিনী বিশ্ববিদ্যালয় ঘেরাও করে ছাত্রদের জোর করে বের করে দেয়। প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে পুলিশ বেষ্টনীর মাঝে আটকা পড়েছিল আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। এদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা আগেই জারি হয়েছিল। যা বহুদিন বহাল ছিল। এভাবে সারা দেশে আইয়ুববিরোধী, শিক্ষানীতিবিরোধী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৬২ সালের ২৫ জুন দেশের ৯ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে আইয়ুব ঘোষিত শাসনব্যবস্থা প্রত্যাখ্যান করে নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়নের দাবি জানান।
প্রতিক্রিয়াশীল শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ঢাকা কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল স্কুল, ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্ব-স্ব দাবির ভিত্তিতে জুলাই-আগস্ট মাস জুড়ে আন্দোলন চলতে থাকে। আন্দোলনের দাবিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় হয়েছিল শিক্ষানীতিতে প্রস্তাবিত তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স এবং উচ্চ মাধ্যমিক ইংরেজির অতিরিক্ত বোঝা বাতিলের বিষয়টি। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত স্টুডেন্ট ফোরাম আইয়ুব শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে পুরো আগস্ট মাস জুড়ে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলার কাজ চালাতে থাকে। শিক্ষা আন্দোলন প্রস্তুতির সময় ছাত্র নেতারা দেশব্যাপী এ কথা বোঝাতে সক্ষম হন যে, শিক্ষার অধিকার ও গণতন্ত্রের আন্দোলন একই সূত্রে গাঁথা।
প্রাথমিক প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ১০ আগস্ট ঢাকা কলেজের ক্যান্টিনে বিভিন্ন কলেজ প্রতিনিধিদের নিয়ে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভা থেকে ১৫ আগস্ট দেশব্যাপী ছাত্র ধর্মঘট ও ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। অবিরামভাবে চলতে থাকে শিক্ষানীতি বাতিলের দাবিতে মিছিল-সমাবেশ-বিক্ষোভ ও আইয়ুবের কুশপুত্তলিকা দাহসহ নানা কর্মসূচি। পরবর্তীতে আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি বাতিল করে ১৭ সেপ্টেম্বর দেশব্যাপী হরতাল কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। এই সময় স্টুডেন্ট ফোরামের পরিবর্তে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে নিয়ে গঠিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।
দেশব্যাপী হরতাল পালিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর। ছাত্রদের সঙ্গে সাধারণ মানুষও পিকেটিংয়ে অংশগ্রহণ করে। সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার হাজার মানুষ সমাবেশে উপস্থিত হয়। সমাবেশ শেষে মিছিল বের হয়। জগন্নাথ কলেজে গুলি হয়েছে এ গুজব শুনে মিছিল দ্রুত নবাবপুরের দিকে ধাবিত হয়। হাইকোর্টে পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে না গিয়ে মিছিল আব্দুল গনি রোড ধরে যেতে থাকে। পুলিশ তখন পিছন থেকে মিছিলে হামলা চালায়। লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস ও গুলি চালায়। পুলিশের সঙ্গে দ্বিতীয় দফা সংঘর্ষ বাধে ঢাকা কোর্টের সামনে। এখানেও পুলিশ ও ইপিআর গুলি চালায়। এতে প্রচুর আহত হয়, তিনজন শহীদ হয় এবং শত শত ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। বাবুল, গোলাম মোস্তফা ও ওয়াজিউল্লাহ শহীদ হন। ওই দিন শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশে মিছিলের ওপর পুলিশ হামলা চালায়। টঙ্গিতে ছাত্র-শ্রমিক মিছিলে পুলিশ গুলি চালিয়ে হত্যা করে সুন্দর আলী নামে এক শ্রমিককে। শেষ পর্যন্ত বুলেট, বেয়নেট আর রক্তচক্ষু কিছুই স্তব্ধ করতে পারেনি দামাল সন্তানদের দাবিকে।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ায় দেশ। রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রের মতো শিক্ষাক্ষেত্রও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় সুসংগঠিত হয়ে উঠতে থাকে। ২০১০ সালে প্রণীত হয় গণমুখী শিক্ষানীতি এবং সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় এই নীতি বাস্তবায়নের কাজ।
উন্নত আধুনিক ও গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শেখ হাসিনা সরকার ছিল; এখনও আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। মহান শিক্ষা দিবসের মাস সেপ্টেম্বরে আমাদের শপথ শহিদদের স্বপ্নসাধ আমরা বৃথা যেতে দেব না। শিক্ষাকে আমরা পণ্য হতে দেব না। সবার জন্য শিক্ষা অবারিত থাকবে। উন্মুক্ত থাকবে সব বয়সের, সব গোত্রের, সর্বজনের জন্য। শিক্ষা এলিট ক্লাসের মধ্যে সীমিত রাখা হবে না। সবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেওয়া হবে শিক্ষার আলো।
লেখক : উপাচার্য, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
"