ইয়াকুব আল মাহমুদ

  ২১ আগস্ট, ২০১৭

স্মরণ

আগস্ট ও জজ মিয়া

২১ আগস্ট, ২০০৪। বাংলাদেশের রাজনীতির একটি কালো অধ্যায়। তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে অব্যাহত জঙ্গি হামলার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের ‘সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও দুর্নীতিবিরোধী’ সমাবেশে গ্রেনেড হামলা হয়। হামলার মোড় অন্যদিকে ধাবিত করার জন্য নোয়াখালীর সেনবাগের সহজ-সরল জজ মিয়াকে দিয়ে নাটক সাজানো হয়। হামলার এক যুগেরও বেশি সময় অতিবাহিত হলেও এখনো এই নারকীয় হামলার বিচারকাজ শেষ হয়নি।

সেদিন আওয়ামী লীগের শান্তিপূর্ণ সামাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। হামলার অন্যতম অভিযুক্ত মুফতি হান্নানের ভাষ্যমতে, ঘড়ির কাঁটা তখন ৫টা পেরিয়ে গেছে। হামলার জন্য হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি), প্রায় ১৫ জন জামায়াত সদস্য ও অন্যান্য হামলাকারী প্রস্তুত।

শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর মঞ্চ থেকে নামার সময় তার ওপর হামলা চালানো হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু বলে শেখ হাসিনার বক্তব্য শেষ হলো। কিন্তু শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে নামলেন না। ফটো সাংবাদিকদের অনুরোধে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়েছিলেন। নির্দেশনা অনুযায়ী বক্তব্য শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেনেড ছোড়া হবে। গ্রেনেড ছোড়া হলো। কিন্তু শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে এতক্ষণে যেখানে যাওয়ার কথা, গ্রেনেড সেখানেই ফাটল। বিকট শব্দ শুনে মানুষ চারদিকে ছুটতে লাগল। পরপর ফাটতে লাগল গ্রেনেড। চারদিকে রক্তের স্রোত। মানুষের আর্তনাদ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা শেখ হাসিনার চারপাশে মানববেষ্টনী তৈরি করে ফেলল। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহকারী জাহাঙ্গীর আলম পুলিশ প্রটোকল না পেয়ে নিজেই পুলিশের গাড়ি ড্রাইভ করে শেখ হাসিনাকে নিরাপদ দূরত্বে নিয়ে যান। গাড়িতেও চারদিক থেকে গুলি করা হলো। পুলিশের কাঁদানে গ্যাস অপরাধীদের ওপর না পড়ে পড়ল জনসভায় আসা কর্মীদের ওপর।

মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ নেতাকর্মী নিহত হন। গ্রেনেডের স্পিøন্টারে পঙ্গুত্ব বরণ করে আওয়ামী লীগের তিন শতাধিক নেতাকর্মী। সাংবাদিক, সাধারণ মানুষও হতাহত হয়। বর্তমান মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ অনেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যর গ্রেনেডের স্পিøন্টারের বোঝা বহন করে বেড়াচ্ছেন।

এরপর হামলার মোড় অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য সাজানো হয় ‘জজ মিয়া নাটক’। ২০০৫ সালের ৬ জুন নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার বীরকোট গ্রাম থেকে থানায় ডেকে এনে দিনমজুর সহজ সরল জজ মিয়াকে গ্রেফতার করা হয়। এ মামলায় দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী বানিয়ে সিআইডির তিন কর্মকর্তা (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত) রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ, মুন্সি আতিকুর রহমান জজ মিয়াকে দিয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করে নেন। বিনিময়ে তার মাকে প্রতিমাসে দুই হাজার টাকা করে নিয়মিত প্রদান করেন তারা। জজ মিয়াকে গ্রেফতারের সময় তার মা জোবেদা খাতুনকে সিআইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছিলেন, আপনার ছেলেকে ঢাকায় নিয়ে যাচ্ছি। তাকে ভালো চাকরি দেব, আপনারা সুখে থাকবেন। সে অনুযায়ী সিআইডি বিশেষ সুপার রুহুল আমিনের কাছ থেকে প্রতিমাসে জোবেদা খাতুন টাকা নিয়ে আসতেন।

এক দিন সহজ-সরল জোবেদা খাতুন টিভিতে দেখলেন তার ছেলেকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। তখন মা বুঝলেন, তার ছেলেকে আসামি বানানো হয়েছে। এ সময় সেনবাগের কেশারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামে একদল সাংবাদিক আসেন সংবাদ সংগ্রহের জন্য। সাংবাদিকদের প্রশ্নে মায়ের অনুপস্থিতিতে জজ মিয়ার বোন খোরশেদা বেগম বলে ফেলেন, সিআইডির পক্ষ থেকে দেওয়া টাকা দিয়েই চলে তাদের সংসার। খোরশেদা বেগমের বক্তব্য সংয়োজন করে এ সময় ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রাজসাক্ষী জজ মিয়াকে নিয়ে সাংবাদিক রুদ্র মাসুদ রিপোর্ট উপস্থাপন করেন একটি জাতীয় দৈনিকে। ফাঁস হয়ে যায় জজ মিয়া নাটকের গোপন রহস্য। ২০০৬ সালের ২১ আগস্ট রিপোর্ট প্রকাশের পর বন্ধ করে দেওয়া হয় টাকা।

দীর্ঘ ৪ বছর ২ মাস ২৫ দিন কারাভোগের পর ২০০৯ সালের ২৬ জুলাই কাশিমপুর কারাগার থেকে মুক্তিপায় জজ মিয়া। কিন্তু এত দিনে ভিটেমাটি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল তার পরিবার। এখন রাজধানীর শনির আখড়ার এক বস্তিতে মা আর ছোট বোনকে নিয়ে বাস করছেন জজ মিয়া। তার মায়ের ভাষ্যমতে, শেখ হাসিনা সরকার তাদের কোনো খোঁজখবর নেয়নি। পর্দার আড়ালে চলে গেছেন জজ মিয়া নাটকের তথ্য উদ্ঘাটনকারী রুদ্র মাসুদ। পর্দার আড়ালে চলে গেছে গ্রেনেড হামলায় নিঃস্ব হয়ে যাওয়া জজ মিয়া।

অভিযোগ রয়েছে, এ হামলার পেছনে হাত রয়েছে বিএনপির নেতৃত্বাধীন তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের। তাদের ইন্ধনেই জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ (হুজি) ওই নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর দ্বিতীয় দফায় তদন্তে বেরিয়ে আসে এ প্রকৃত ঘটনা। মুফতি হান্নানের ভাষ্যমতে, লুৎফুজ্জামান বাবর, আবদুস সালাম পিন্টুর সম্পৃক্ততায় তাজউদ্দিন গ্রেনেড সরবরাহ করেন। বর্তমানে ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ দুটি মামলার বিচারকাজ চলছে। তবে বিচার কবে শেষ হবে এ মুহূর্তে তা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। অন্তত পরিবেশ তাই বলছে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist
Error!: SQLSTATE[42S02]: Base table or view not found: 1146 Table 'protidin_sangbad.news_hits_counter_2020_04_07' doesn't exist