রায়হান আহমেদ তপাদার
প্রযুক্তি
বিশ্বের অশনিসংকেত
শঙ্কার বিষয় হচ্ছে, সাইবার পরিসরে আসলে কোনো নিরাপত্তাই দুর্ভেদ্য নয়। তাহলে কেন আমাদের সাইবার নিরাপত্তাহীনতার মাঝে থাকতে হবে? অপরাধ ঘটলেও সেখানে প্রতিরোধ গড়ে তোলা জরুরি। অর্থাৎ প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ প্রযুক্তি দিয়েই করতে হবে। নতুন হামলা ঠেকাতে অনেক প্রতিষ্ঠানই ইতোমধ্যে সাইবার বিশেষজ্ঞ নিয়োগ করেছে। এ ছাড়া কম্পিউটারের নিরাপত্তা রক্ষায় কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশ্বব্যাপী সাইবার হামলা প্রতিরোধে সবাইকে সতর্ক করে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের সুবাদে পুরো বিশ্ব এখন গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা। গ্লোবাল ভিলেজের প্ল্যাটফরম ডিজিটাল ব্যবস্থার শত্রু তথা ক্ষতিকর দিক হচ্ছে সাইবার অপরাধ। সাইবার অপরাধ ইন্টারনেট এবং কম্পিউটার ব্যবহারের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ, যা এখন বিশ্বব্যাপী বিস্তার লাভ করছে। দিন দিন তা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, সাইবার অপরাধ বৃদ্ধির এই প্রবণতা যেকোনো দেশের জন্য অত্যন্ত আতঙ্কের। সাইবার ক্রাইমের মধ্যে রয়েছে প্রতারণা, ক্রেডিট কার্ডের নম্বর চুরি, ব্ল্যাকমেইল, পর্নোগ্রাফি, হয়রানি, হুমকি প্রদান, সাম্প্রদায়িক উসকানি, মিথ্যা, ভুল তথ্য ছড়ানো, অন্যের বিষয়গুলো নিজের দখলে নিয়ে আসা প্রভৃতি। সাইবার অপরাধীদের কবলে পড়ে অনেকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সামাজিকভাবে হেনস্তার মুখোমুখি হয়েছেন। সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি, প্রাণনাশের নজির ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা পরিপন্থী অনেক ঘটনাই ঘটছে।
অন্যদিকে সম্প্রতি বিশ্ব এক অভিনব সাইবার হামলা প্রত্যক্ষ করল। বলা হচ্ছে, দেশে দেশে চালানো এই সাইবার হামলা তথ্যপ্রযুক্তি তথা ডিজিটাল ব্যবস্থার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক অশনিসংকেত, যা ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ, নজিরবিহীন এবং বড় সাইবার হামলা! শতাধিক দেশ এই হামলার শিকার হয়েছে। গ্লোবাল ভিলেজের বাসিন্দা হিসেবে এই হামলায় আমরাও বিপন্মুক্ত নই। এ যেন একটি গ্রামে চোর, ডাকাত বৃদ্ধির মতোই উদ্বেগ। কতিপয় অসৎ লোকের জন্য গ্রামের অন্যরা ঘুমহারা। বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া এই সাইবার হামলাকে বিভিন্ন দেশের সরকারের জন্য একটি সতর্কবার্তা হিসেবে অভিহিত করেছে বিখ্যাত সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান মাইক্রোসফট। আর এই হামলার সূচনা ঘটে ‘রানসামওয়্যার’ নামক এক ধরনের ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন দেশের কম্পিউটারে সংরক্ষিত ফাইল ও তথ্যাদির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার মাধ্যমে। ফাইলপত্রের নিয়ন্ত্রণ
ফিরে পেতে দাবি করা হয় ৩০০-৬০০ ডলার মুক্তিপণ। রানসামওয়্যার এমন এক ধরনের ভাইরাস বা ম্যালওয়্যার যা কম্পিউটারে সংরক্ষিত ফাইলপত্রের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফাইলগুলো এনক্রিপ্টেড করে ফেলা হয়, যা ব্যবহারকারী দেখতে বা চালু করতে পারেন না। অনেক ক্ষেত্রে ফাইল বা ফোল্ডার পাসওয়ার্ড দিয়ে লক করে ফেলা হয়।
এই প্রজাতির ভাইরাস প্রোগ্রামগুলো এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে নিজে নিজেই ছড়িয়ে পড়তে সক্ষম। তাছাড়া যাদের আমরা হ্যাকার বলে চিহ্নিত করে থাকি। অর্থাৎ ডিজিটাল চোর। সাইবার হামলা কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের এক ধরনের ফাঁদে ফেলা ছাড়া আর কিছু নয়।
কিন্তু বিস্ময়কর হচ্ছে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া, স্পেন, ইতালি, তাইওয়ানসহ অন্যান্য দেশের গুরুত্বপূর্ণ অনেক প্রতিষ্ঠান হামলার শিকার হয়েছে। যারা প্রযুক্তিগত দিক থেকে যথেষ্ট এগিয়ে। এতে ২৪ ঘণ্টায় ব্রিটেনের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও বিশ্বব্যাপী মালামাল পরিবহনকারী যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফেডএক্সসহ সারা বিশ্বে লাখ লাখ কম্পিউটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অন্যদিকে হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে জাতিসংঘের সচিবালয়, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (আইওসি), বার্তা সংস্থা এপির কম্পিউটারও। যদিও এ হামলা একসময় নিয়ন্ত্রণে এসেছে। তবে এ ধরনের হামলা এই বার্তা দেয়, বিশ্বের কোনো দেশই সাইবার জগতে নিরাপদ নয়। সেটা হোক উন্নত, উন্নয়নশীল কিংবা অনুন্নত দেশ। ডিজিটাল চোরদের কাছে আমরা সবাই জিম্মি। তারা যেকোনো সময় আঘাত হানতে পারে। উন্নত দেশই যখন একের পর এক এ ধরনের হামলার শিকার হচ্ছে, তখন প্রশ্ন জাগাটাই স্বাভাবিক তথ্যপ্রযুক্তি তথা ডিজিটাল ব্যবস্থার দিকে ধাবমান আমাদের মতো দেশগুলোর ভবিষ্যৎ কী? দেশের সর্বত্র কম্পিউটার নির্ভর ব্যবস্থা গড়ে উঠছে। সব তথ্য এখন কম্পিউটারে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। কিন্তু এই ডিজিটাল তথ্যের নিরাপত্তা কে দেবে? ইতোমধ্যেই আমরা নেতিবাচক অনেক কিছুই লক্ষ্য করেছি। যদি তথ্যভা-ার স্বরূপ কম্পিউটারটিই বেদখলে যায়, তাহলে আমাদের অসহায়ত্ব বোধ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। কম্পিউটারে সংরক্ষিত ডেটাগুলোর কোনো নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
বাংলাদেশও এ ধরনের হামলার বাইরে নয়। উন্নত দেশগুলোই যখন হামলার শিকার হয়েছে, সেখানে বাংলাদেশে এই আশঙ্কা অমূলক নয়। কিন্তু আতঙ্কের বিষয় হচ্ছে উন্নত দেশগুলোই সাইবার হামলার প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হিমশিম খাচ্ছে, তাহলে আমাদের মতো দেশগুলোর কী হবে? এমন এক সময় এ ধরনের হামলা ঘটল যখন আমরা ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। দিন দিন বাড়ছে ডিজিটাল পরিধির আওতা। তথ্য-প্রযুক্তিকে সর্বদিক থেকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। উন্নত প্রযুক্তির অনেক কিছুই আমাদের হাতে আসেনি। কাজেই বাংলাদেশের জন্য এই ধরনের হামলা উদ্বেগের। এদিকে এই নজিরবিহীন সাইবার হামলার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের ধরতে ‘আন্তর্জাতিক তদন্ত’ প্রয়োজন বলে মনে করে ইউরোপোল। হামলা এখানেই শেষ নয়। হামলার শিকার হওয়ার ঝুঁকি এখনও আছে বলে সতর্ক করেছে ইউরোপোল। ইউরোপোল সাইবার-ক্রাইম টিম (ইসিথ্রি) হামলার ঝুঁকি কমাতে এবং এরই মধ্যে ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায়, হামলার শিকার দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজে করবে বলেও জানান ইউরোপোলের কর্মকর্তারা। এ ধরনের হামলা আরো ঘটবে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে মাইক্রোসফট বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের দুই লাখেরও বেশি কম্পিউটার ‘রানসামওয়্যার’ সাইবার হামলার শিকার হওয়ার ঘটনাটিকে কম্পিউটার প্রযুক্তি বিষয়ে মানুষকে আরো বেশি সজাগ হওয়ার কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে। এই হামলার সময় হ্যাকাররা
পুরনো সংস্করণের উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম যেসব কম্পিউটার ব্যবহার করা হতো মূলত তাদেরকেই টার্গেট করেছে। কিন্তু হামলার আশঙ্কার কথা বারবার বলা হলেও হামলা প্রতিরোধ কিংবা মোকাবিলা করার মতো ব্যবস্থা কিন্তু ব্যাপক ও গুরুত্বসহকারে সামনে আসছে না। সে লক্ষ্যে দেশে দেশে শক্তিশালী সাইবার নিরাপত্তার বলয় গড়ে তোলার এখনই সময়।
লেখক : গবেষক ও সমাজবিশ্লেষক
"